ঢাকায় পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক ভালো না হওয়ায় শোধনাগারটি চালু হওয়ার পর থেকে কখনও পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারেনি, এখন এর ভবিষ্যৎ নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
Published : 18 Feb 2025, 01:23 AM
পদ্মা নদীর যে স্থান থেকে ঢাকা ওয়াসার পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগারের জন্য পানি তোলা হয়, তার কাছেই জেগেছে বিস্তীর্ণ চর।
চরের কারণে সেখানে সরু হয়ে গেছে নদীর ধারা। চরটি আরও বিস্তৃত হলে সেই ধারাটি বন্ধ হয়ে পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সেক্ষেত্রে প্রকল্পের দ্বিতীয় শোধনাগারটিও আর চালু করা যাবে না বলে আশঙ্কা করছে ঢাকা ওয়াসা।
এ অবস্থায় শোধনাগারের পানির উৎস ঠিক রাখতে পদ্মা নদীর ওই ধারাটি খননের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঢাকা ওয়াসা থেকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে শুরু করা পদ্মা-যশলদিয়া প্রকল্প ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর অর্থনৈতিক পরিষদের জাতীয় নির্বাহী কমিটি-একনেকে অনুমোদিত হয়।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে চীন সরকার।
২০১৬ সালে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের অক্টোবরে তা চালু হয়। সেখান থেকে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি ঢাকায় আসার কথা।
তবে ঢাকায় পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক ভালো না হওয়ায় শোধনাগারটি চালু হওয়ার পর থেকে কখনো পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারেনি। এখন পানির উৎসমুখে চর পড়ায় শোধনাগারের ভবিষ্যৎ নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পদ্মার গতিপথ বদলের আশঙ্কার মধ্যে যশলদিয়ায় শোধনাগারের পানি সংগ্রহের সেই স্থানে (ইনটেক পয়েন্টে) নদীর প্রবাহ বাড়ানোর উপায় বের করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সভা আয়োজনের অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা ওয়াসা।
২০২৪ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালকের কাছে এ বিষয়ে একটি চিঠি পাঠান ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনার পরিচালক।
চিঠিতে বলা হয়, মুন্সীগঞ্জের যশলদিয়ায় অবস্থিত এই শোধনাগারে পরিশোধিত পানি দুই হাজার মিলিমিটার ব্যাসের প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের মাধ্যমে ঢাকায় সরবরাহ করা হয়। ঢাকার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের প্রায় ৪০ লাখ মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা মেটায় এই শোধনাগারে পরিশোধিত পানি।
ঢাকা ওয়াসার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, যশলদিয়ায় ৪৫ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতার আরও একটি পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। ফলে ঢাকা শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভূগর্ভস্থ উৎসের পরিবর্তে ভূ-উপরিস্থ উৎস কেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনায় রূপান্তরিত হবে।
চিঠিতে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ মহাপরিকল্পনা হালনাগাদ করার অংশ হিসেবে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংকে দিয়ে সম্প্রতি সমীক্ষা করিয়েছে ঢাকা ওয়াসা।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর প্রভাবে নদীর প্রধান ধারাটি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এছাড়া যশলদিয়া ইনটেক পয়েন্টের সামনে থাকা আগের চর এবং নতুন করে জেগে ওঠা চর মিলেমিশে নদীর পূর্ব তীর লাগোয়া মূল প্রবাহ মারাত্মকভাবে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।
ওয়াসা বলছে, শোধনাগারের পানির উৎসের সেই ধারাটি অচিরেই স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। ফলে পদ্মা পানি শোধনাগার বন্ধ হওয়ার ‘হুমকিতে’ আছে।
ঢাকা মহানগরে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্বে থাকা সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় দৈনিক পানির চাহিদা ২৬৫ কোটি থেকে ২৭০ কোটি লিটার। তবে ঢাকা ওয়াসা দাবি করে, সংস্থাটির পানি উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ২৭৫ কোটি লিটার।
ঢাকায় যে পানি সরবরাহ করা হয়, তার ৬৭ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। ৯৯৭টি পানির পাম্প দিয়ে তোলা হয় এই পানি। ৩৩ শতাংশ পানি আসে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে। ঢাকার চাঁদনীঘাট, সায়েদাবাদ পর্যায়-১, সায়েদাবাদ পর্যায়-২, মুন্সীগঞ্জের পদ্মা-যশলদিয়া ও সাভারের ভাকুর্তা শোধনাগার থেকে এই পানি আসে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের গন্ধর্বপুরে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতার একটি শোধনাগার তৈরি হচ্ছে, যেখানে মেঘনা নদী থেকে পানি এনে শোধন করা হবে। আর পদ্মায় দ্বিতীয় শোধনাগার থেকে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদনের আশা করছে ঢাকা ওয়াসা।
ওয়াসা বলছে, ঢাকা মহানগরের ২ কোটি মানুষের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার স্বার্থে পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পের প্রথম পর্যায় চালু রাখা এবং দ্বিতীয় পর্যায় নির্মাণ করা জরুরি।
পদ্মা পানি শোধনাগারের অবস্থান মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার যশলদিয়ায়। ওই শোধনাগারের ঠিক এক কিলোমিটার দূরে পদ্মার তীরে করা হয়েছে ‘ইনটেক পয়েন্ট’।
ইনটেক পয়েন্ট থেকে যন্ত্রের মাধ্যমে পানি তোলা হয়। ওই পানি একটি পাইপের মাধ্যমে শোধনাগারে আসে। শোধনের পর তা সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে ঢাকায় আসে।
প্রকল্পটি নেওয়ার সময় বাঘরা বাজার থেকে কামারগাঁও, ভাগ্যকুলের পাশ দিয়ে ছিল পদ্মা নদীর প্রবাহ।
তবে গত কয়েক বছর ধরে বাঘরা বাজার এলাকা থেকে পদ্মায় চর পড়তে শুরু করে। এখন শুকনো মৌসুমে বাঘরা বাজার থেকে পূর্বদিকে অন্তত ১০ কিলোমিটার জুড়ে চরের বিস্তার। চরটি বিভিন্ন জায়গায় সর্বোচ্চ আড়াই কিলোমিটার পর্যন্ত চওড়া।
সম্প্রতি শোধনাগারের ইনটেক পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, ওই পয়েন্টের উল্টোদিকে চর জেগেছে। এর সামনের নদীর পানিও কমে গেছে। পদ্মার এই ধারাটি পশ্চিমে ভাগ্যকুল বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত। এরপর চর, চরের জমিতে কৃষিকাজ চলছে।
ইনটেক পয়েন্টের কাছে নদীতে গোসল করছিলেন স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা। তারা বলছিলেন, কামারগাঁও ও ভাগ্যকূল বাজারের মাঝামাঝি থেকে একটি ধারা আছে, তবে এর উজানে বালাসুর থেকে বাঘরা বাজার পর্যন্ত পুরোটাই চর। ফলে উজান থেকে পানি ভাটির দিকে যেতে পারে না।
বর্ষা মৌসুমে পদ্মার এই ধারাটি প্রবাহমান থাকলেও শুকনো মৌসুমে গভীরতা কমে যায় বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
যশদিয়ার বাসিন্দা আবদুল হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুকনা মৌসুমে পদ্মার পানি অনেক কমে যায়। আমাদের থেকে কিছু দূর সামনে হাঁটু পানি। হেঁটে যাওয়া যায়। ড্রেজিং না করলে এই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পানি পাওয়া যাবে না।”
মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) মো. তাওহীদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে তিনি দেখেছেন, ২০১৬-১৭ সালের পর থেকে নদীর ওই স্থানে চর পড়তে শুরু করে এবং এখন তা আয়তনে অনেক বড় হয়েছে।
“পদ্মা সেতু তৈরি ও সেতু রক্ষার জন্য এই এলাকায় বেশকিছু কাজ করা হয়েছে। এই চর সেটার প্রভাবেও হতে পারে।”
তাওহীদুল ইসলাম বলেন, ওয়াসার কাছ থেকে খননের অনুরোধ পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি করা হয়েছে।
“সেখানে যে কাজ করা দরকার সেটা কারিগরি হওয়ার কারণেই গবেষণা করতে হবে। কারণ সেখানে পদ্মা ব্রিজের বিষয় আছে। খনন করতে হলে পদ্মা ব্রিজের কাছ থেকেই করতে হবে।”
সেক্ষেত্রে সেতু কর্তৃপক্ষের মতামত লাগবে জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই প্রকৌশলী বলেন, “দুই তিনটা মন্ত্রণালয়ের বিষয় হওয়ায় একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি একটা মিটিংও করেছে। উনারা সিদ্ধান্ত নেবে বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা হবে।”
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, পদ্মা নদীর মূল প্রবাহ আর ইনটেক পয়েন্টের মাঝখানে একটি সরু ধারা তৈরি হয়েছে। এ কারণেই প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
“পানির মূল প্রবাহ তো চরের বাইরে। ওই মূল প্রবাহ থেকে পানি আমাদের ইনটেক পয়েন্টে আনার জন্যই ড্রেজিং করতে হবে। এজন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় একটা মিটিং হবে। এই পর্যন্ত অগ্রগতি।”
তিনি বলেন, “সেখানে পানি প্রবাহ কমে গেলে আমাদের প্ল্যান্টের কার্যকারিতা কমে যাবে। আমরা আশা করছি, আমাদের শোধনাগার বন্ধ হবে না। এর আগেই আমরা একটা ব্যবস্থায় যাব।”
ঢাকা ওয়াসার একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দৈনিক ৪৪ কোটি লিটার পানি আসার কথা ছিল। কিন্তু এখন গড়ে দৈনিক ২২ থেকে ২৫ কোটি লিটার পানি আসছে।
“এখন যে অবস্থায় আছে তাতে দুই-চার বছরের মধ্যে ইনটেক পয়েন্টের সামনে চর পড়ে যাবে। ঢাকায় পানি সরবরাহ হুমকিতে পড়বে।
“এখানে নদীর গতিপথ, পানির প্রবাহ নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা করা হয়নি। তাকসিম এ খানের নেওয়া এই প্রকল্পটি ছিল একটি হরিলুটের প্রকল্প।”
ঢাকা ওয়াসার এমডির দায়িত্বে থাকার সময় তাকসিম খান অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা কারণে বারবার সংবাদের শিরোনাম হলেও, বহুবার তার পদত্যাগ আর অপসারণের দাবি উঠলেও কাজ হয়নি কোনো কিছুতেই। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকা ওয়াসায় তাকসিম যুগের অবসান ঘটে।
তাকসিম এ খান ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পান। টানা সপ্তম মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সময় ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এরপর ১৫ অগাস্ট তিনি পদত্যাগ করেন।
তাকসিমের সময় নেওয়া পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পটির কাজ শুরুর আগে প্রয়োজনীয় সমীক্ষা হয়েছিল কি না এমন প্রশ্নে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “এটা আমি এই মুহূর্তে বলতে পারব না। ফিজিবিলিটি স্টাডি তো অবশ্যই হয়েছে। নইলে তো এত বড় প্রজেক্ট হওয়ার কথা না।”