রমনার শিশু চত্বর: বড়দের কারণে শিশুরাই যেখানে বঞ্চিত

বিরক্ত এক অভিভাবক বলেন, “এটা কমনসেন্সেরও বিষয়। তাদের (বড়দের) জন্য বাচ্চাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অথচ বাচ্চাদের নির্বিঘ্নে খেলার কথা ছিল।”

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Feb 2024, 05:26 AM
Updated : 2 Feb 2024, 05:26 AM

রমনা পার্ক সংস্কার করে শিশুদের বিনোদনের জন্য যে চত্বর করা হয়েছিল, এক বছর যেতে না যেতেই তার অবস্থা যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে।

বেশ কিছু খেলনা এরই মধ্যে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, কিছু অনুপযোগী হয়ে যাওয়ার পথে। সেগুলোতে চড়ে ব্যথাও পাচ্ছে শিশুরা। অভিভাবকরা বিরক্ত।

যে তিনটি দোলনা সেখানে আছে, তার কোনোটি বড়দের ভার বহন করার মত না। কিন্তু শিশুদেরকে অপেক্ষায় রেখে বড়রা তাতে চড়তে থাকেন।

তিনটির মধ্যে দুটি দোলনার শেকল ছিঁড়ে যাওয়ার পর তা বেঁধে রাখা হয়েছে কোনো রকমে। ফলে শিশুরা আর ভারসাম্য রাখতে পারে না, তারা তাতে বসতেও চায় না। এই সুযোগে আরো পেয়ে বসছেন বড়রা।

পার্কের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা গণপূর্ত বিভাগ জানে এই অবস্থা। তাদের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেছেন, তারা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন, শিশু চত্বরে নিরাপত্তা কর্মী দেওয়া হয়েছে, আরো ব্যবস্থা নেবেন।

শিশু চত্বরের নিরাপত্তায় আনসার সদস্য দেওয়া হলেও তারা প্রায় সময়ই সেখানে থাকেন না, আর থাকলেও বাধা দেন না। তাদের ভাষ্য, একার পক্ষে পুরোটা দেখা সম্ভব নয়।

দৃষ্টিনন্দন এই পার্কটি ২০২২ সালের শেষে খুলে দেওয়ার পর শিশুদের মন কেড়ে নেয়। দূর দূরান্ত থেকে কেবল বাবা-মা নয়, স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গেও দল বেঁধে আসতে থাকে শিশুরা।

সেই চত্বরে দোলনা ছাড়াও আছে জাইলোফোন, রাইডার, ক্লাইম্বিং রোপ, ঝুলন্ত সেতু, স্লাইডারসহ নানা কিছু। এর সবই ব্যবহার করা যায় বিনা পয়সায়।

কিন্তু এখন সেসব খেলনাই কেবল ভালো আছে, যেগুলো বড়রা ব্যবহার করতে পারে না বা যেগুলোতে তাদের আগ্রহ নেই।

দেড় ঘণ্টায় যা দেখা গেল

মঙ্গলবার বিকালে পার্কে গিয়ে দেখা গেল, কিছু তরুণ-তরুণী দোল খাচ্ছেন দোলনায়, সি-সতেও তারাই।

এমনকি ছোট্ট শিশুদের জন্য উপযুক্ত স্লাইডারেও ওপর থেকে নিচে নামছেন বড়রা। কেউ আবার শিশুদের বিশ্রামের জন্য রাখা আসনে বসে গল্প করছেন। দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের কাউকে বাধা দিতে দেখা যায়নি। তিনি বলতে গেলে পুরো সময় ব্যস্ত ছিলেন ফোন নিয়ে।

শিশুদের রাইডে চড়া বড়দের ভাষ্য, ছোটরা না থাকলে বা কম থাকলে খেলনায় চড়তে ‘অসুবিধা নেই’। ওজনের ভারে যে খেলনাগুলো নষ্ট হতে পারে, তাও মানতে নারাজ তারা।

এসব ঘটনায় অভিভাবকরাও বিরক্ত, কিন্তু কিছু বললে উল্টো দুর্ব্যবহারের কারণে চুপসে যেতে হয় তাদের।

তিনটি দোলনার দুটির এক পাশের শেকল ছেঁড়া। ছেঁড়া দুটি দোলনার কাজ চলছে একপাশে শেকল বেঁধে।

দুটি জাইলোফোনের মধ্যে একটির সব মেটাল বাটন খুলে ফেলা হয়েছে, অপরটির কিছু অবশিষ্ট আছে। বাদ্যযন্ত্রটি বাজানোর চারটি লাঠির মধ্যে নেই তিনটি।

শিশুদের গাছে ওঠার অভিজ্ঞতা পেত যে ক্লাইম্বিং রোপ থেকে, তার রশিগুলো চারদিক আটকানো ছিল আংটায়। বড়দের ভারে সবগুলো আংটা থেকে ছিঁড়ে গেছে। শিশুরা না বুঝে যদি সেই রশিতে উঠতে যায়, তারা ঝুলে পড়ে যায় অথবা পড়ে গিয়ে ব্যথা পায়।

রোপ ব্রিজের একটি পাটাতন ছাড়া সবই নাই হয়ে গেছে। একমাত্র সি-সটিও শিশুদের ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। এর কারণ একপাশে ভারসাম্য ধরে রাখার হাতল খুলে নিয়েছে কেউ একজন। সেখানে বসলে পিছলে পড়ে যেতে হয়।

ডিম্বাকৃতির একটি চেয়ার, যেটিতে ক্লান্ত শিশুদের বসার কথা। কিন্তু সেখানে বসে থাকতে দেখা গেল বড়দের। এদের মধ্যে একজন ছিলেন আবার পার্কের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক আনসার সদস্য।

তার সামনেই ছোটরা অপেক্ষায়, বড়রা খেলনা নিয়ে মেতে। তবে কাউকে তিনি বাধা দেননি।

‘এটা তো কমনসেন্সের বিষয়’

ছেলে শাহরিয়ারকে নিয়ে মালিবাগ থেকে ঘুরতে যাওয়া তাহমিনা আক্তার এসবে ভীষণ বিরক্ত।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কয়েকদিন আগে গাছে ওইটা (ক্লাইম্বিং রোপ) দিয়ে উঠার সময় ছেলেটা পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। এখন আর এখানে নিয়ে আসতে নিরাপদ বোধ করি না। কিন্তু সে কান্নাকাটি করে, তাই নিয়ে এসেছি। বড় বড় এরা আসে এখানে, চড়ে; ভাঙার পর চলে যায়। জিনিসগুলা ঠিক করা উচিত।”

ধূপখোলার বাসিন্দা রমজান আহমেদ প্রায়ই মেয়ে মাঈশা জান্নাত রোজাকে নিয়ে এখানে আসেন।

তিনি বলেন, “সে আনন্দ পায়। কিন্তু বাদ্যযন্ত্রটার লাঠি না থাকায় সে বাজাতে পারে না। দ্রুত ঠিক করা উচিত।”

সংস্কারের পাশাপাশি শিশু চত্বরে বড়দের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়ে লাকি জামান বলেন, “এটা কমনসেন্সেরও বিষয়। তাদের জন্য বাচ্চাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অথচ বাচ্চাদের নির্বিঘ্নে খেলার কথা ছিল।”

যেসব খেলনা আংশিক বা পুরোপুরি ভেঙে গেছে, সেগুলো কেন মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না, সেই প্রশ্নও করছেন অভিভাবকরা। এগুলো মেরামতে খুব বেশি খরচ হওয়ার কথা না, কেবল আন্তরিকতার বিষয়- এ কথাও বলছিলেন তারা।

শেখ পারভেজ নামে এক অভিভাবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেকগুলো জিনিস মেরামত করা দরকার। বাচ্চারা পরে গিয়ে ব্যথা পাবে। তারা এখন আর তেমন বিনোদনও পাচ্ছে না।”

গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এটাও পরিকল্পনায় আছে। এর কত খরচ লাগবে তার হিসাব করতে হবে। এরপর তা পাস হবে। তখন কাজ শুরু হবে।”

সেটি কবে- এই প্রশ্নে মাহবুবুর রহমান বলেন, “ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একটু সময় লাগবে।”

অনার্স পড়ুয়া সামিয়া মনে করেন এসব খেলনা তার জন্যও।

সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সামিয়া রহমান তার বয়সী একজনকে নিয়ে সি-সোতে দুলছিলেন।

এসব খেলনায় বড়রা খেললে সেগুলো নষ্ট হতে পারে, তা মানছেন না তিনি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মনে করি না, আমি এত ভারী। আমার ওজনের বাচ্চাও আছে। এখানে কি মানা আছে যে বড়রা এসে খেলতে পারবে না?”

আরেক তরুণী তারিন বাকি বড়দের দেখিয়ে জানতে চাইলেন, “ওরা চড়লে আমার চড়তে অসুবিধা কোথায়?”

পরে তিনি আবার বলেন, “বাচ্চা তো কম। আর নষ্ট হলে আমরা জরিমানা দিয়ে যাব।”

সিদ্ধেশ্বরীর বাসিন্দা ১৮ বছর বয়সী মিশুকে ঘুরে ঘুরে সব রাইডেই চড়তে দেখা গেল।

শিশুদের রাইডে কেন চড়ছেন জানতে চাইলে তিনি উল্টো প্রশ্ন রাখলেন, “তাহলে কোথায় যাব আমরা? আমরা তো এত বড় না।”

ডিম্বাকারের চেয়ারে বন্ধুদের নিয়ে বসে ছিলেন কামরাঙ্গীচরের মেহেদী হাসান মিরাজ। সপ্তাহে দুই-তিন দিন তার পা এখানে পরে।

মিরাজ বলেন, “এমনি বসলাম আমরা, শিশু বাচ্চা আসলে উঠে যাব। এটা আমাদের মাথায় আছে। আমরা তো ঘুরতে আসছি, বসতে আসিনি।”

চত্বরের এক কোনার দোলনায় চড়ে দোল খাচ্ছিলেন দুজন নারী। তাদের ছবি তুলছিলেন মধ্যবয়সী এক পুরুষ। সেই পুরুষের পাশেই দাঁড়িয়ে দোল খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল একটি শিশু।

মধ্যবয়সী আবু সাঈদ বলেন, “চলে যাব, আর বসব না। পিক (ছবি) তোলার জন্য আসছিলাম আরকি।”

তবে বড়দের এমন আচরণের মধ্যেও দেখা গেল শিশু সাফানকে বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেষে দায়িত্ব নিয়ে লাঠিটা ঠিক জায়গায় রেখে যেতে।

সাফান এখানে নিয়মিত আসে তার বাবার সঙ্গে। বাবা বললেন, “ওর মধ্যে এগুলোর প্রতি একটা মায়া তৈরি হয়েছে। কিন্তু বড়রা এই জিনিসগুলো নষ্ট করছে। এগুলো তো তাদের না। এদের সচেতন হওয়া উচিত। কারণ এটা তো সবারই পার্ক। এটা ঠিক থাকলে কালকে আরেকজন আসবে।”

দুই ঘণ্টা পার্ক বন্ধ রাখা নিয়েও প্রশ্ন

পার্কটি প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা বন্ধ থাকে। এই সময়ে পার্কের ভেতরে থাকা মানুষদের বের হয়ে যেতে বারবার তাড়া দিতে থাকেন আনসার সদস্যরা। কিন্তু শিশুরা তা মানতে চায় না, কান্নাকাটি করে।

শেখ পারভেজ নামে এক অভিভাবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। কারণ পার্ক কেন বন্ধ থাকবে? অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে আসে। তো এই দুই ঘণ্টা তারা কোথায় বসে থাকবে? একটা মানুষ ক্লান্ত, তার বসার বা বিশ্রামের জায়গা তো পার্কই, ভর দুপুরে তো আর কোথাও যেতে পারবে না।”

গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য বিরতি থাকে। তারপর কর্মীদের খাওয়া-দাওয়ার বিষয় আছে। তবে আমাদের মাথায় আছে, বিরতির সময় এক ঘণ্টা কমিয়ে আনার।”

তবে কবে থেকে সময় কমবে- সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখনও পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে, চূড়ান্ত হয়নি।”

‘গতানুগতিক’ বক্তব্য কর্তৃপক্ষের

সুন্দর চত্বরটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? গণপূর্তের কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বললেন, ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তারা নিচ্ছেনও।

বাচ্চাদের খেলনাগুলো বড়দের দখলে চলে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “এটা আমরা মনিটর করব। সেজন্য লোকও দেওয়া হয়েছে।”

‘সেই লোক তো কিছু করছেন না, আবার থাকেনও না’- এই প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর রহমান বললেন, “সেটাও মনিটর করা হবে।”

এই কর্মকর্তা যে নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগের কথা বললেন, তাদের একজনকে পাওয়া গেল দেড় ঘণ্টার পর্যবেক্ষণকালে। তার পোশাকে নাম লেখা হুমায়ুন। কিন্তু পুরো নাম বলতে রাজি হলেন না।

চোখের সামনে শিশুদের জিনিসগুলো নষ্ট করছে বড়রা। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু বলছিলেন না। উল্টো শিশুদের বিশ্রামের জায়গায় বসে ফোন টিপছিলেন, ভিডিও কল করছিলেন, সেলফি তুলছিলেন।

তার দাবি, কারা পার্কে এসেছে খেলছে বা বসছে, তা তার নজরে পড়ছে না।

হুমায়ুন বলেন, “আপনাকে বলব আপনি ভেতরে প্রবেশ কইরেন না, আপনি বললেন যে; একটু ঘুরে চলে যাব। এখন ঘুরার জন্য তো আমি নিষেধ করতে পারি না।”

চত্বরটির আয়তন তার দৃষ্টি সীমার চেয়ে বড়- এমন দাবি করে তিনি বলেন, “একদিকে দেখলে আরেক দিক দিয়ে চড়ে, ওদিক দেখলে ওদিক দিয়ে চড়ে। কয় দিক দিয়ে যাওয়া যাবে বলেন?”