“আল্লাহ আমাদেরকে টিকিয়ে রাখবেন- এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা আমাদের দাওয়াতের ময়দানে অবিচল থাকব। কারো কোন বক্তব্যের আমরা পরোয়া করি না, প্রতিবাদও করব না,” বলছেন কাকরাইল মারকাজের ইমাম।
Published : 05 Nov 2024, 04:16 PM
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ থেকে তাবলীগ জামাতের একাংশের তরফে সাদপন্থিদের নিষিদ্ধ করাসহ ৯ দফা দাবি জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার ‘ওলামা-মাশায়েখদের ইসলামি মহাসম্মেলন' থেকে এসব দাবি তুলে ধরেছেন শায়খুল হাদিস পরিষদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও বেফাক মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক।
এই সম্মেলনে জমায়েত হন তাবলীগের অপর পক্ষ জুবায়েরপন্থিরা, যারা নিজেদের ‘শুরায়ে নিজাম’ পরিচয় দিয়ে থাকেন।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাবলিগ জামায়াতের দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ঘোষণায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরে সরকারের ‘মধ্যস্থতায়' সাদপন্থিরা তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন।
সোমবার দুই পক্ষকে নিয়েই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সভার উদ্যোগ নেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। সেখানে সাদপন্থিরা এলেও অন্যরা আসেননি। ওই বৈঠকে এবারও দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়।
আগে এক মঞ্চ থেকে একবারই বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন হত। কিন্তু দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভি এবং বাংলাদেশের কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের আহমদের অনুসারীরা নিজেদের মধ্যে বিভেদে জড়িয়ে পড়েন ২০১৯ সালে।
এক পর্যায়ে দুই পক্ষ বিশ্ব ইজতেমা দুইবারে করার সিদ্ধান্ত নেন। মাঝে কোভিড মহামারীর কারণে ইজতেমা দুই বছর বন্ধও রাখা হয়। পরে ২০২২ সাল থেকে ফের ইজতেমা হচ্ছে দুই পর্বের আয়োজনে।
এর মধ্যেই মঙ্গলবারের সমাবেশ থেকে এক পক্ষকে নিষেধাজ্ঞার দাবি জানাল অপর পক্ষ।
সোহরাওয়ার্দীর সমাবেশের শেষভাগে শায়খুল হাদিস পরিষদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও বেফাক মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক ৯ দফা দাবি তুলে ধরেন-
১. কওমি শিক্ষাকে দারুল উলুম দেওবন্দের আওতায় পরিচালনা করতে হবে এবং তাবলিগ নিয়ে বিচ্ছিন্ন মহলের সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।
২. সাধারণ শিক্ষা সিলেবাসে ধর্মশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৩. আলেমদের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের যাবতীয় মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৪. শাপলা চত্বরের গণহত্যায় জড়িত আসামিদের দেশে এনে শাস্তি নিশ্চিত এবং সারাদেশে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৫. ২০১৮ সালে টঙ্গী ময়দানে সাদপন্থিদের নৃশংস আক্রমণের বিচার করতে হবে।
৬. সাদপন্থিরা নবী করিম (স.)-সহ সাহাবীদের সমালোচনা করে আসছে। সাদ তাবলিগের নীতিমালা উপেক্ষা করে আসছে। সেই কারণেই মাওলানা সাদকে দেশে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই তাকে আসতে দেওয়া হবে না।
৭. ‘আলেমপন্থিদেরই’ সরকার ঘোষিত দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা করতে দিতে হবে।
৮. কাকরাইল মসজিদ সাদপন্থিদের কোনো কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না। কাকরাইল থেকে কেবল ‘শুরায়ে নিজাম’ পরিচালিত হবে।
৯. ‘অভিশপ্ত’ কাদিয়ানিদের অবিলম্বে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে।
বেলা দেড়টার দিকে মোনাজাতের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় এই মহাসম্মেলন। মোনাজাত পরিচালনা করেন শাহ মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী।
এর আগে বাংলাদেশ নেজামে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক বলেন, আসন্ন বিশ্ব ইজতেমা ঘিরেও সাদপন্থিদের ‘ষড়যন্ত্র' চলছে।
“বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে স্বঘোষিত আমির সাদ ও তার অনুসারীরা বিশৃঙ্খলা করার পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা কোনোভাবেই সেটি হতে দেব না। তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র যেকোনো মূল্যে আমরা ব্যর্থ করে দেব। বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে আজকের সম্মেলন থেকে ওলামায় কেরামের পক্ষ থেকে যে ঘোষণা দেওয়া হবে, সরকারকে সেই নির্দেশনা মানতে হবে। এর বাইরে কারও সিদ্ধান্ত তৌহিদী জনতা মানবে না।"
অনুষ্ঠানে মাওলানা আব্দুল হামিদ বলেন, “বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে সরকার দুই পক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। আমি বলব- কীসের পরামর্শ; এই সম্মেলন থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে, সরকারকে এটাই বাস্তবায়ন করতে হবে। ভিন্ন কোনো চিন্তা করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।"
হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ আল হাবিব বলেন, “আমরা ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এ সরকারকে বসিয়েছি। কেউ যদি রক্ত চক্ষু দেখায়, তবে আমরা তাদের চক্ষু উপড়ে ফেলব।
“জাতির পথপ্রদর্শক হবে আলেমরা। তাবলিগের রাহবারও আলেমদের থেকেই হবে, অন্য কেউ নয়।"
জানতে চাইলে কাকরাইল মারকাজের ইমাম মুহাম্মাদ আযীমুদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সম্মানিত উলামায়ে কেরামের কোনো বক্তব্যে আমরা সামান্যতমও বিচলিত নই। তারা এর আগেও এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ আপন মেহেরবাণীতে হকের উপর থাকার কারণে বাংলাদেশে আমাদেরকে টিকিয়ে রেখেছেন।”
সাদপন্থি এই মুফতি বলেন, “আগামীতেও আল্লাহ আমাদেরকে টিকিয়ে রাখবেন- এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা আমাদের দাওয়াতের ময়দানে অবিচল থাকব। কারো কোন বক্তব্যের আমরা পরোয়া করি না, প্রতিবাদও করব না।”
এদিন সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে বাস ও ট্রাকে ভরে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ লোকজন সম্মেলনস্থলের দিকে যেতে শুরু করে। সকাল ১০টার দিকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানমুখী রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। শাহবাগ মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে দেয় পুলিশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে সব ধরণের যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে জানান শাহবাগ মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট আব্দুল বাতেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে লাখো মানুষের জমায়েতের চাপ পড়ে বাইরের সড়কগুলোতেও। প্রেস ক্লাব, মৎস্যভবন থেকে শাহবাগ হয়ে সায়েন্সল্যাব এবং শাহবাগ থেকে বাংলামোটর দিকের সড়কের পেরিয়ে এই বাড়তি জটলার প্রভাব পড়েছে সারা ঢাকাজুড়ে।