কেয়ার মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের কী হবে?

বিএমডিসির অনুমোদন, নীতিমালা অনুসারে পর্যাপ্ত ফ্লোরপ্লেস ও অবকাঠামো না থাকার পরও কেয়ার মেডিকেলে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 August 2022, 03:10 AM
Updated : 19 August 2022, 03:10 AM

কক্সবাজার থেকে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন মো. আবদুল্লাহ। কিন্তু কলেজের অব্যবস্থাপনায় বছরখানেক পরেই তার স্বপ্নভঙ্গ হতে শুরু করে।

২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া চতুর্থ বর্ষের এই শিক্ষার্থী জানান, ভর্তির বছরখানেক পরেই তার মেডিকেল কলেজে শিক্ষকের সংখ্যা কমতে থাকে, সেই সঙ্গে চিকিৎসা শিক্ষার পরিবেশও অনুপযোগী হয়ে উঠে।

“আমাদের কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষক নাই, একাডেমিক ও ক্লিনিক্যাল বিষয়ে পড়ানোর মতো শিক্ষক আমরা পাই না। এখানে কোনো অধ্যাপক নাই। আমাদের হাতে-কলমে কিছুই শেখানো হয় না। হাসপাতালে পর্যাপ্ত রোগী নেই, যাদের মাধ্যমে আমরা মেডিকেল শিক্ষা প্র্যাকটিস করব। আমাদের ক্লিনিক্যাল কোনো ক্লাস হয় না। প্রফেশনাল পরীক্ষার জন্য রোগী ভাড়া নিয়ে আসা হয়।”

আবদুল্লাহ বলেন, চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তার সৌদি আরব প্রবাসী বাবা অনেক কষ্ট করে তাকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তা ফিকে হয়ে যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে গত ৬ অগাস্ট থেকে শিক্ষার্থীরা কলেজের বিএমডিসি’র অনুমোদন না থাকা এবং একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় মাইগ্রেশনের দাবিতে আন্দোলন করছে।

বৃহস্পতিবার এই মেডিকেল কলেজে গিয়ে কোনো শিক্ষককেই পাওয়া যায়নি। দেখা মেলেনি অধ্যক্ষ বা চেয়ারম্যানের।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কেয়ার মেডিকেলে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কোনো অনুমোদন নাই। নীতিমালা অনুসারে পর্যাপ্ত ফ্লোরপ্লেস ও অবকাঠামো না থাকার পরও এই মেডিকেলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হয়েছে।

বিভিন্ন অনিয়মের কারণে এই মেডিকেলের ২১৬ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

২০১৩ সালে কেয়ার মেডিকেল কলেজ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে চুড়ান্তভাবে অনুমোদন পায়। ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নবায়ন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও অনুমোদন দেয়।

এর ধারাবাহিকতায় ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করায় বেসরকারি মেডিকেল কলেজটি।

তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা-২০১১ এর বাস্তবায়নের শর্ত পূরণ না হওয়ায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কেয়ার মেডিকেল কলেজে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়।

পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ হাই কোর্টে রিট আবেদন করে। এতে সাময়িক বন্ধের উপর স্থগিতাদেশ দেয়।

এর ভিত্তিতে ২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এইসব শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেজিস্ট্রেশন পেয়ে এমবিবিএস কোর্সে পড়াশুনা করছেন। কিন্তু বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন না পাওয়া ও তালিকাভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ইন্টার্নশিপ করতে পারছেন না।

এ জটিলতার কারণেই মাইগ্রেশন বা অন্য মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর চেয়ে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা।

কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী সিলভিয়া মিম ১৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে কেয়ার মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। এছাড়া প্রতিমাসে ৮ হাজার টাকা করে বেতন দিতে হয়েছে তাকে।

পড়াশুনার মান দিন দিন কমতে থাকায় এবং বিএমডিসির অনুমোদন না থাকায় বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন বলে জানান তিনি।

সিলভিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এত টাকা খরচ করে মেডিকেলে ভর্তি হলাম। অথচ এখন আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। জানি না আমরা অন্য মেডিকেলে মাইগ্রেশনের সুযোগ পাব কিনা। আমরা স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে চিঠি দিয়ে এসেছি। ওনারা আমাদের বিষয়টি দেখলে আমরা হয়ত অন্য মেডিকেল থেকে এমবিবিএস শেষ করতে পারব।”

এই শিক্ষার্থী জানান, প্রতিষ্ঠানটিতে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন- আলাদা রিডিং রুম, ল্যাব ফ্যাসিলিটি, ল্যাব পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মাইক্রোস্কোপ, এনাটমিক্যাল, প্যাথলোজিক্যাল, ল্যাবরেটরি সামগ্রী নাই। স্থায়ী ল্যাব টেকনিশিয়ান নেই। প্রফেশনাল পরীক্ষার সময় ভাড়া করে লোক আনা হয়। কিন্তু এসব নিয়ে মেডিকেল কর্তৃপক্ষের কোন মাথাব্যথা নাই।

সিলভিয়া বলেন, “বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর বিএমডিসির ও ঢাকা মেডিকেলের অনুমোদন লাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন থাকার কারণে প্রফেশনাল যে পরীক্ষাগুলো, সেগুলো আমরা দিতে পারছি। সময়মতো পরীক্ষাগুলো নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যখন ফাইনাল দেওয়ার পরে আমরা ইন্টার্ন করার জন্য বিএমডিসির অনুমোদন চাইব, তখন বিএমডিসি আমাদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিচ্ছে না। কারণ আমাদের মেডিকেলের অনুমোদন নাই।”

তিনি বলেন, “আমরা এখানে বেশিরভাগই ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থী। এখানে আমাদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা জামানত নেওয়া হয়েছিল হোস্টেলের কথা বলে। আমরা যখন হোস্টেলে উঠতে গেলাম, তখন আমরা দেখলাম হাসপাতালের বিল্ডিংয়ের একটা ওয়ার্ডের রোগীদের বেডগুলো আমাদের দেওয়া হয়েছে। আমরা বাসা থেকে সবকিছু নিয়ে আসায় ওখানে উঠলাম। এর মধ্যে একদিন রাত ৯টায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায় যে, হাসপাতাল ভিজিটে আসবে, তোমরা বের হয়ে যাও। আমাদের ব্যাগ-ব্যাগেজ বের করে দেয়।

“পরে মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পে ব্যবস্থা করে দেয়। ১৫-২০ জন আমরা অনেক কষ্ট করে থেকেছি। সকালেই আমরা চলে আসি। আবার ১৫-২০ দিন পর আবারও বের করে দেয়। হোস্টেল নিয়ে অনেক ভোগান্তির পরে আমরা বাইরে থাকি।”

এই কলেজের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীদের গত বছরের নভেম্বর থেকে ইন্টার্নশিপ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিএমডিসির অনুমোদন না থাকায় নয় মাসেও তা শুরু হয়নি।

এই ব্যাচের শিক্ষার্থী জিওন জানান, বিএমডিসি থেকে বার বার সমস্যা সমাধান করতে বলা হলেও কর্তৃপক্ষ আশানুরূপ কিছুই করেনি।

“আমাদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত ও হুমকির মুখে। ইন্টার্নের সুযোগ না পেলে আমরা ডাক্তার হিসেবে স্বীকৃতি পাব না। অন্য মেডিকেলে আমরা মাইগ্রেশন করে যেতে পারব কিনা এটা পুরোপুরি নির্ভর করছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ওপর। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও বিএমডিসি যদি চায় তাহলে আমাদের অন্য কোথাও মাইগ্রেট করে দিতে পারবে। নইলে আমাদের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বৃথা যাবে। এতগুলো বছর, এতগুলো টাকা, আমাদের মূল্যবান সময়গুলো বৃথা যাবে।”

এই শিক্ষার্থী জানান, হাই কোর্টে করা আবেদন তুলে নেওয়া, কলেজে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো, ল্যাব সুবিধা নিশ্চিত করা, হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ানোসহ বেশ কিছু শর্ত দেয় বিএমডিসি। সেগুলো পূরণ হলেই বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশনের অনুমতি দেবে কেয়ার মেডিকেল কলেজকে।

“আমাদের কাছ থেকে চার মাস সময় নিয়েছিল চেয়ারম্যান পারভীন ফাতেমা ম্যাম। চার মাস পরে ১২ অগাস্ট যখন ওনার সাথে দেখা করতে গেলাম, উনি আমাদের কোন মেয়েকেই ঢুকতে দেয়নি। ছেলেদের সাথে কথা বলেছেন। দেড় ঘণ্টা নিজের মত কথা বলেছে, কারও কথা না শুনে, অভিভাবকদেরও অপমান করে বের করে দিয়েছে। বাজে ব্যবহার করেছে।”

দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কাফিউল করিম পিয়াস বলেন, “করোনার মধ্যে আমরা অনলাইনে ক্লাস করেছি। দু-তিন মাস ক্লাস হল ঠিকমতো। এরপর থেকেই টিচাররা যাওয়া শুরু করল। আমাদের মূল বিষয় অ্যানাটমি। অথচ এটার কোনো প্রফেসর বা অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর আমাদের এখানে নাই। দুজন প্রভাষক আছে, তাও একজন কিউরেটর। ক্লাস নেওয়া তার কাজ না। আরেকজন হিসটোলোজির টিচার। পড়ানোর মতো কোনো টিচার না। সব বিভাগেই প্রফেসর বা অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর থাকা উচিৎ। কিন্তু আমাদের এখানে সেটা নাই।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় কেয়ার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক গোলাম মুর্শেদ সুমন বলেন, তারা শিক্ষার্থীদের মাইগ্রেশন চেয়েছিলেন।

“আমাদের চেয়ারম্যান ও অধ্যক্ষ ম্যাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত নিয়ে সাইন নিয়েছে। ওটা ওরা জমা দিয়েছে।”

আন্দোলনকারীদের বিষয়ে তার ভাষ্য, “এখানে সব ব্যাচ ইনভলভ না, অনেকেই কেয়ারে থাকতে চায়। কিন্তু ওরা জোর করে সবার কথা লিখে নিয়েছে।”

বিএমডিসি ইন্টার্ন ব্যাচের অনুমোদন ‘খুব শিগগিরই’ দেবে বলে আশা করে মুর্শেদ সুমন বলেন, “বিএমডিসির প্রেসিডেন্ট মাহমুদ হাসান স্যার দেশের বাইরে থাকায় এই প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে। উনি আসলে একটা মিটিং করে আমাদের অনুমোদন দিয়ে দেবে।

“স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, যেসব কলেজে ভর্তি স্থগিত রয়েছে, তাদের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত দেবে। এটা শিক্ষার্থীরা জানে, তারপরও তারা আন্দোলন করছে। ওরা যে দাবি করেছে, সেটা কিন্তু আমরা মেনে নিয়েছি।”

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা. এ কে এম আহসান হাবীব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে মেডিকেল কলেজগুলোর ভর্তি স্থগিত রাখা হয়েছে, তাদের বিষয়ে খুব শিগগিরই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর, বিএমডিসিসহ সকল স্টেক হোল্ডারদের উপস্থিতিতে একটি মিটিং হবে। সেখানে এ মেডিকেল কলেজগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

তবে তিনি ভর্তির আগেই এই বিষয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতন থাকার উপর জোর দিচ্ছেন।

“শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কোনো কিছু না জেনে এমন মেডিকেলে ভর্তি করানো ঠিক না। এই মেডিকেলগুলোর বিষয়ে আমাদের ওয়েবসাইটেও আছে। সেখান থেকে তারা জানতে পারত।”

কেয়ারের শিক্ষার্থীরা মাইগ্রেশনের সুযোগ পাবে কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “তাদের অনুমোদন নাই এটা ঠিক, কিন্তু যে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হল, তাদের কোনোকিছু না জেনে ভর্তি হওয়াটাও ঠিক হয়নি। আমরা এর আগে দুটি মেডিকেল বন্ধ করে দিয়েছি। সেখানকার শিক্ষার্থীদের অন্য মেডিকেল কলেজের অধীনে মাইগ্রেট করিয়ে।

“এরকম সিদ্ধান্ত হলে শিক্ষার্থীদের মাইগ্রেশন করিয়ে দেওয়া হবে। আমরা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মানবিক কারণে মাইগ্রেট করে থাকি। দেখা যাক মিটিংয়ে কী সিদ্ধান্ত হয়।”

বিএমডিসি’র অনুমোদনের বিষয়ে বিধিবদ্ধ সংস্থাটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দীন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা কিছু শর্ত দিয়েছিলাম কেয়ার মেডিকেলকে। সেগুলো পূরণ হলেই তারা অনুমোদন পাবে। আমাদের সংস্থার প্রেসিডেন্ট দেশের বাইরে আছেন। উনি দেশে আসলে আমরা একটি সভা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।”