হজ নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকা ৬৮২ জনের মধ্যে আটকে থাকা ৩৬৪ জনের হজে যাওয়ার পথও খুলেছে, বলেছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম সচিব।
Published : 08 Jun 2024, 11:53 PM
এবারের হজে ৬৮২ জন হজযাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে একটি এজেন্সির মোনাজ্জেমের দায়িত্বে থাকা লুৎফর রহমান ফারুকীকে নিষিদ্ধ করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়; যার মালিকানাধীন হজ এজেন্সির অনুমোদন আগেও বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে বাতিল করা হয়েছিল।
এ ব্যক্তির জালিয়াতির কারণে ব্যাংক অর্থ স্থানান্তর না করায় বিপুল সংখ্যক এসব হজযাত্রীর হজে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। যাদের মধ্যে সবশেষ ধাপে ৩৬৪ জনের হজে যাওয়ার পথও খুলেছে ব্যাংক তাদের টিকেটের টাকা ছাড় করায়।
শনিবার সন্ধ্যায় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. মঞ্জুরুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “মোনাজ্জেমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রতারণার অভিযোগে মোনাজ্জেমকে হজ কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আর বাকি ৩৬৪ জনেরও অর্থছাড় করেছে প্রিমিয়ার ব্যাংক।”
ধর্ম মন্ত্রণালয় লুৎফরকে ‘দেশ বিরোধী’ আখ্যায়িত করে ভবিষ্যতে ওমরাহ ও হজের সব ধরনের কার্যক্রমে নিষিদ্ধ করেছে। গত বৃহস্পতিবার যুগ্ম সচিব মঞ্জুরুল হক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্ত সবাইকে জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে লুৎফরের সঙ্গে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন না করতেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
গাজীপুর এয়ার ট্রাভেলস লিমিটেড নামে লাইসেন্স বাতিল হওয়া একটি এজেন্সির স্বত্বাধিকারী লুৎফুর এবার নর্থ বেঙ্গল ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস নামের একটি হজ এজেন্সির মোনাজ্জেমের দায়িত্বে ছিলেন।
নর্থ বেঙ্গল লিড এজেন্সি হিসেবে এবার ৬৮২ জনকে হজে পাঠানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। লুৎফুর এসব হজযাত্রীদের টিকেটের অর্থ নিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিলে তাদের হজযাত্রা অনিশ্চিতা তৈরি হয়।
পরে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে দুই দফায় তাদের জটিলতা নিরসন করে হজে পাঠানোর পদক্ষেপ নেওয়ার তথ্য দেন যুগ্ম সচিব মঞ্জুরুল।
হজের ক্ষেত্রে একজন মোনাজ্জেমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। হজের আইন ও নিয়ম কানুন জানা এ ব্যক্তি নিযুক্ত এজেন্সির হয়ে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
এদিকে লুৎফরের প্রতারণার তথ্য জানার পরও তাকে মোনাজ্জেম নিযুক্ত করায় নর্থ বেঙ্গল ট্রাভেলসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল কাদিরকে গত শুক্রবার কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে মন্ত্রণালয়। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তাকে জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল্লাহ আল কাদির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আসলে উনার প্রতারণার বিষয়টি জানতাম না। এটা নিয়ে আমরাও বেকায়দায় পড়েছি।”
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে কল করা হলে লুৎফর ফোন ধরেননি। দ্বিতীয় দফায় কল করা হলে তা বন্ধ করে দেন তিনি।
লুৎফুরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এ বছর আবারও মোনাজ্জেম হয়েও হজযাত্রীদের মক্কা-মদিনায় বাড়ি ভাড়া না করে, ভিসা না করে এবং বিমান টিকিট কেনার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ না করে লুৎফর গোপনে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন।
“তার এমন প্রতারণার কারণে সৌদি আরবে সরকারের সম্মান নষ্ট হচ্ছে। তার এহেন কাজ দেশ বিরোধী, যা হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনা আইন ২০২১ অনুসারে অনিয়ম ও অসদাচারণ এবং কার্যক্রম সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার অন্তরায়।”
যশোরের বাসিন্দা লুৎফরের অফিস মতিঝিলে। তিনি গাজীপুর এয়ার ট্রাভেলস লিমিটেড নামের একটি এজেন্সির স্বত্বাধিকারী, যেটির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল আগে।
মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বিভিন্ন সময়ে হজযাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ, হজযাত্রীদের হজে না নেয়া, ‘আকবর হজ গ্রুপ’ নাম দিয়ে হজযাত্রীদের সাথে প্রতারণা, হজে নিয়ে কষ্ট দেয়া ইতাদি নানা কারণে উল্লিখিত এজেন্সির হজ লাইসেন্সের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।”
এবারের প্রতারণার বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হজযাত্রীদের টাকা প্রিমিয়ার ব্যাংকে জমা রেখে এর বিপরীতে ঋণ নিয়ে তিনি পালিয়ে যান।
এতে বলা হয়, নিজের এজেন্সির কার্যক্রম না থাকায় লুৎফর চলতি বছর নর্থ বেঙ্গল ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস নামে একটি হজ এজেন্সির মোনাজ্জেম নিযুক্ত হন। সেটি লিড এজেন্সি হিসেবে হজ কার্যক্রমে অংশ নেয়। কিন্তু লিড এজেন্সি হিসেবে অংশ নিলেও নর্থ বেঙ্গল ট্রাভেলসের নিজস্ব নিবন্ধিত কোন হজযাত্রী ছিল না।
“পরে আরেক এজেন্সি মাজিদ ট্রাভেল ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক ২৫৪ জন নিবন্ধিত হজযাত্রীকে নর্থ বেঙ্গল ট্রাভেলসের নামে হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া, মেসার্স শিকদার এয়ার ট্রাভেলস নামে অন্য আরও একটি এজেন্সির নিবন্ধিত ৪২৮ জন যাত্রীকে ও আল রিসান ট্রাভেলস এজেন্সি লিমিটেড নামের আরেক এজেন্সিতে স্থানান্তর করা হয়। আর সবগুলো প্রতিষ্ঠানের লিড এজেন্সি হিসেবে কাজ করে নর্থ বেঙ্গল ট্রাভেলস।”
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “নর্থ বেঙ্গল ট্রাভেলসের অধীনস্থ দুই এজেন্সির ৬৮২ জন কর্তৃত্ব নেন লুৎফর। তারপর হজযাত্রীদের বিপরীতে প্রিমিয়ার ব্যাংকের মহাখালী শাখা হতে ঋণ নেন তিনি। এরপরই দেশ থেকে পালিয়ে যান তিনি।
“অন্যদিকে অর্থ ফেরত না পাওয়ায় এসব হজযাত্রীদের উড়োজাহাজ ভাড়ার জমাকৃত ১৩ কোটি টাকা অর্থ ছাড়ে বিলম্ব করে প্রিমিয়ার ব্যাংক। ৬৮২ জন সৌদি আরব যাওয়া নিয়ে পড়েন অনিশ্চয়তায়।”
পরে মন্ত্রণালয়ের অন্তত তিন দফা চিঠি চালাচালির পর ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা করে ৩১৮ জনের প্লেন ভাড়ার ৬ কোটি ১৯ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ টাকা স্থানান্তর করে ব্যাংকটি। বাকি ৩৬৪ জন অনিশ্চয়তার মধ্যেই পড়ে থাকেন।
এর আগে ব্যাংক থেকে টাকা হস্তান্তর না করা প্রসঙ্গে প্রিমিয়ার ব্যাংকের মহাখালী শাখার ব্যাবস্থাপক মো. ইলিয়াস হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, জটিলতা নিরসনে কাজ চলছে।
“আমাদের হেড অফিস এটা নিয়ে কাজ করছে। তারা যেভাবে নির্দেশনা দেবে, সেভাবেই আমরা কাজ করব। তবে বিষয়টি আসলে যেভাবে সামনে এসেছে সেরকম না। একটু জটিলতা হয়েছিল কাস্টমারের সঙ্গে। আমাদের এখান থেকেই কিন্তু সর্বোচ্চ সংখ্যক হজযাত্রী নিবন্ধন করেন।”
শনিবার যুগ্মসচিব মঞ্জুরুল হক বলেন, বাকি ৩৬৪ জন হজযাত্রীর টাকাও প্রিমিয়ার ব্যাংক স্থানান্তর করেছে। এতে তাদের হজে যাওয়ার অনিশ্চয়তা কেটেছে।
তবে নর্থ বেঙ্গল ট্রাভেলসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল কাদির জানাতে পারেননি বাকি ৩৬৪ জন হজযাত্রী কবে ও কোন ফ্লাইটে যেতে পারবেন।
তিনি বলেন, “আমি যতটুকু জানি, তাদের সবকিছু ওকে হয়েছে। দুই-একদিনের মধ্যেই তারা সৌদি আরব যেতে পারবেন।”
এদিকে শনিবার সকালে হজ পালন ও ব্যবস্থাপনা পরিদর্শনের উদ্দেশে দেশত্যাগের আগে ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান বলেছেন, “হজ ব্যবস্থাপনায় যেসব এজেন্সি ও ব্যাংক হজযাত্রীদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার চেষ্টা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যার অপরাধ যতটুকু, তার ততটুকু শাস্তি হবে।”
আরও পড়ুন:
হজ নিয়ে ভোগান্তি: দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস মন্ত্রীর