‘নীরব এলাকায়’ দিনের বেলায় যেখানে শব্দের মাত্রা থাকার কথা ৫০ ডেসিবলের নিচে, সেখানে জরিপে পাওয়া গেছে ১০১.৭ ডেসিবল।
Published : 04 Mar 2024, 10:48 PM
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকার যেসব জায়গাকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানেও নির্ধারিত সীমার দ্বিগুণ মাত্রার উচ্চ শব্দ থাকছে বলে উঠে এসেছে এক জরিপে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন-পরিজা’ সোমবার রাজধানী রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে জরিপের এই ফলাফল প্রকাশ করে।
এই জরিপের অংশ হিসেবে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা শহরের ৪৫টি জায়গার শব্দের মাত্রা মেপে দেখেছে পরিবেশবাদী সংগঠনটি।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, নীরব এলাকায় দিনে (ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা) শব্দের মাত্রা ৫০ ডেসিবলের নিচে এবং রাতে (রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা) ৪০ ডেসিবেলের নিচে থাকার কথা।
কিন্তু পরিজার জরিপে নীরব এলাকায় দিনে নির্ধারিত সীমার দ্বিগুণেরও বেশি এবং রাতে আড়াই গুণের বেশি মাত্রার শব্দ পাওয়া গেছে বলে সংগঠনের সভাপতি, পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান জানান।
তিনি বলেন, আবাসিক এলাকায় তারা দিনের বেলায় নির্ধারিত সীমার দেড় গুণ এবং রাতে দ্বিগুণ মাত্রার শব্দের উপস্থিতি পেয়েছেন।
মিশ্র এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে নির্ধারিত সীমার দেড় গুণের বেশি; আর রাতে দুই গুণের বেশি।
বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ও রাতে শব্দের মাত্রা নির্ধারিত সীমার চেয়ে দেড় গুণ বেশি পাওয়া গেছে জানিয়ে পরিজা সভাপতি বলেন, নীরব এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি সচিবালয় এলাকায়। সেখানে ১০১.৭ ডেসিবল পর্যন্ত তী্ব্রতার শব্দ পাওয়া গেছে জরিপে। আর রাতে ধানমন্ডি ল্যাবএইড এলাকায় সবচেয়ে বেশি, ১০১.৫ ডেসিবল মাত্রার শব্দ পাওয়া গেছে।
মিশ্র এলাকায় দিনে সবচেয়ে বেশি, ১০৩.৮ ডেসিবল মাত্রার শব্দ পাওয়া গেছে বাংলামোটর এলাকায়। রাতে লালবাগ সেকশনে সর্বোচ্চ ১০১.৫ ডেসিবল পর্যন্ত মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে।
নীরব এলাকা কী?
বিধিমালায় বলা হয়েছে- হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত বা একই জাতীয় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এবং এর চারপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ এলাকাকে চিহ্নিত করে (বিধি-৪ অনুযায়ী) সাইনবোর্ড স্থাপন করে সংরক্ষণ করতে পারবে।
২০১৯ সালে সচিবালয় ও এর আশপাশের এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করা হয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, “শব্দদূষণের ফলে মানুষ কেবল শ্রবণশক্তি হারায় না, নানা ধরনের জটিল রোগেও মানুষ আক্রান্ত হয়। আমাদের সকলের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে অতি দ্রুত সরকারকে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।”
তিনি বলেন, “মানুষের শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি শব্দ সৃষ্টি হলে সেটাই শব্দদূষণ। শব্দদূষণ মানুষের স্নায়ুগুলো ধবংস করে দেয়। ক্রমাগত শব্দদূষণের ফলে কানের টিস্যুগুলো আস্তে আস্তে বিকল হয়ে পড়ে। তখন মানুষ আর স্বাভাবিক শব্দ কানে শুনতে পায় না।
“বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন নগর-মহানগরে এমনকি কোনো কোনো গ্রামীণ জনপদেও শব্দদূষণের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। শব্দদূষণের কুফল বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব এবং শব্দদূষণ প্রতিরোধে যথাযথ প্রশাসনিক নজরদারি ও পদক্ষেপের ঘাটতির কারণেই এমনটি হচ্ছে।”
পরিজা ঢাকা মহানগরীর যে ৪৫টি স্থানে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে মানিক মিয়া এভিনিউ, আসাদ গেইট, বাংলামোটর, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, পল্টন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, আজিমপুর, কলাবাগান, ধানমণ্ডি, পান্থপথ, রাসেল স্কয়ার, ধানমন্ডি ২৭, কলেজ গেইট, শ্যামলী, আগারগাঁও, পলাশী, লালবাগ সেকশন, নাজিরাবাজার, সচিবালয় এলাকা।
নীরব এলাকায় দিনে ৮৪.৫ থেকে ১০১.৭ ডেসিবল এবং রাত্রিকালে ৯৬.৪ থেকে ১০১.৫ ডেসিবল শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে। আবাসিক এলাকায় দিনে ৮২.০ থেকে ৯১.০ ডেসিবল এবং রাতে ৮৩.০ থেকে ৯১.৬ ডেসিবল শব্দের মাত্রা পওয়া গেছে।
মিশ্র এলাকায় দিনে ৯১.০ থেকে ১০১.৫ ডেসিবল এবং রাতে ৮৯.০ থেকে ১০৩.৮ ডেসিবল শব্দ পাওয়া গেছে। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৯২.০ থেকে ৯৭.০ ডেসিবল এবং রাতে ৯১.০ থেকে ৯৯.০ ডেসিবল শব্দের মাত্রা মিলেছে।
এছাড়া বাসের ভিতর শব্দের মাত্রা পরিমাপ করেছে পরিজা। তাতে ৮০.৪ থেকে ৮৩.৯ ডেসিবল শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে।
বাংলামোটরে ১০৩.৮ ডেসিবল; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ৮৬.০০ থেকে ৯৪.০০ ডেসিবল; সচিবালয় এলাকায় ৯৬.০০ থেকে ১০১.৭ ডেসিবল শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে জরিপে।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালানো; উচ্চ শব্দসৃষ্টিকারী হর্ন ব্যবহার থেকে বিরত থাকা; উচ্চ শব্দের হর্ন আমদানি বন্ধ করা; নীরব এলাকায় হর্ন না বাজানো এবং অন্যান্য এলাকায় অপ্রয়োজনে হর্ন না বাজানোর জন্য মোটরযান ড্রাইভারদের উদ্বুদ্ধ করা, বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা; মোবাইল কোর্ট পরিচালনা; সরকারি বিধিবিধান সবার মেনে চলাসহ একগুচ্ছ সুপারিশ তুলে ধরা হয় পরিজার সংবাদ সম্মেলনে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বলের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে নগর গবেষক মো. জাহাঙ্গীর আলম, পরিজার সহসভাপতি ক্যামেলিয়া চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হাসান উপস্থিত ছিলেন।