কমিশনের ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে, বলেন কমিশনের একজন সদস্য।
Published : 06 Feb 2025, 01:27 AM
প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারকদের নিয়োগ এবং বিচারক হিসেবে নিয়োগের যোগ্যতা পরিবর্তনসহ বিচার বিভাগকে নির্বাহীন বিভাগের প্রভাবমুক্ত রাখার সুপারিশে করেছে এ বিষয়ে গঠিত সংস্কার কমিশন।
সে জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো সংশোধনেরও সুপারিশ এসেছে কমিশনের কাছ থেকে।
এছাড়া স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস, স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা, বিভাগীয় শহরে হাই কোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ, জেলা আদালতের সম্প্রসারণ, আইনের সংস্কার, আইন শিক্ষার সংস্কার, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধ এবং আদালত অঙ্গন দলীয়করণ মুক্ত রাখাসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন।
বুধবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস কাছে প্রতিবদনটি হস্তান্তর করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় তার কাছে প্রতিবেদন পেশ করেন সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সদস্যরা।
কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক বলেছেন, ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য ৩২টি অধ্যায়ে সার্বিক সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা ক্ষেত্রে সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে আট সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয় গত ৩ অক্টোবর।
কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সংবিধান-সংশোধনী শীর্ষক দফায় সংবিধানের ৪৮(ক), ৫৫(২), ৯৪ ও ৯৫ অনুচ্ছেদ সংশোধন এবং নতুন বিধান ৯৫ক অনুচ্ছেদ সংযোজন করতে বলা হয়েছে।
৪৮(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে সীমিত করে নিয়োগ কমিশনকে ক্ষমতায়িত করার কথা বলা হয়েছে।
৫৫(২) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা থেকে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকদের নিয়োগের বিষয়কে পৃথক করার সুপারিশ করা হয়েছে।
৯৪ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারকদের সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির মতকে প্রাধান্য দেওয়া এবং আপিল বিভাগের ন্যূনতম বিচারক সংখ্যা সাত করার সুপারিশ করা হয়।
৯৫ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন, অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির কোনো স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকবে না বা নির্বাহী বিভাগের কোনো প্রভাব থাকবে না।
সংবিধানে নতুন ৯৫ক অনুচ্ছেদ সংযোজনের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ কমিশনের বিধান করার সুপারিশ করা হয়।
আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ
সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধনীর মাধ্যমে রাজধানীর বাইরে প্রতিটি বিভাগীয় সদরে হাই কোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে হাই কোর্ট বিভাগের এখতিয়ারের পূর্ণাঙ্গতা বা অবিভাজ্যতা এমনভাবে বজায় রাখতে হবে, যেন স্থায়ী বেঞ্চগুলো স্থাপনের কারণে দেশের সর্বত্র কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাই কোর্ট বিভাগের এখতিয়ার কোনো ভৌগলিক সীমারেখা দ্বারা বিভাজিত না হয়, এবং রাষ্ট্রের একক চরিত্র ক্ষুণ্ন না হয়।
এছাড়া উপজেলা সদরের ভৌগলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, জেলা-সদর থেকে দূরত্ব ও যাতায়াত ব্যবস্থা, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বিন্যাস এবং মামলার চাপ বিবেচনা দেশের বিভিন্ন উপজেলায় জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ ও প্রথম শ্রেণির বিচারিক হাকিম আদালত স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে।
আইনের সংস্কার
ফৌজদারি আইনে বিদ্যমান জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি এবং বিচারিক হাকিমদের শাস্তি প্রদান ও জরিমানার এখতিয়ার বৃদ্ধি করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বাদীর আরজি ও বিবাদীর জবাবের বক্তব্য হলফনামার মাধ্যমে দেওয়ার বিধান করতে আইন সংশোধন; দেওয়ানি মামলার বিচারপূর্ব এবং বিচার শুরুর পরের স্তরগুলোর বিধানসমূহ যথাযথ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা স্বল্প সময়ে নিষ্পত্তি, আদালতের সিদ্ধান্ত কার্যকরভাবে প্রয়োগ এবং সাক্ষী ও ভুক্তভোগীর সুরক্ষা, দণ্ড শুনানি, সাজা দেওয়ার নীতিমালা ইত্যাদি বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়ণের সুপারিশ করা হয়েছে।
আইন শিক্ষার সংস্কার
এ সংক্রান্ত সুপারিশে রয়েছে, আইন শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন দেখভালের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্র আইন শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা। ওই বোর্ড কর্তৃক আইন শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
মাধ্যমিক শ্রেণিতে আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা এবং উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে আইনকে একটি বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়।
মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধ
মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধ বিষয়ে একটি বাস্তবানুগ আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে নিবিড় ও ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
বিচারাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তকরণ
বিচারাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার জন্য আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী বা অন্য কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের সব ধরনের সভা-সমাবেশ বা মিছিল নিষিদ্ধকরণের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং বিচারাঙ্গনে আইনজীবীদের সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাকে নিরুৎসাহিত করা এবং বার সমিতি নির্বাচন রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
মামলাজট কমানো
অধিক সংখ্যক ফৌজদারি আপিল, ফৌজদারি রিভিশন, দেওয়ানি আপিল ও দেওয়ানি রিভিশন নিষ্পন্নাধীন আছে, এমন জেলাগুলোতে অবসরপ্রাপ্ত সৎ, দক্ষ এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জেলা জজগণকে দুই/তিন বছর মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
গ্রাম আদালতের সমস্যা দূর করার উদ্যোগ
গ্রাম আদালত গঠনের ক্ষেত্রে সমস্যা দূরীকরণ এবং গ্রাম আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম বিচারিক মান রক্ষার জন্য করণীয় নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে।
এ লক্ষ্যে গ্রাম আদালত পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা এবং গ্রাম আদালতের উপর বিচারিক তত্ত্বাবধান ও তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের সভাপতিত্বে একটি তদারকি কমিটি গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে।