ঈদযাত্রায় চেনা ভিড় নেই বাস টার্মিনালে

বাস ছাড়ছে সময়মত, রাস্তায় জট নেই; তবে অনেক কোম্পানিই বেশি ভাড়া আদায় করছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2023, 03:24 PM
Updated : 19 April 2023, 03:24 PM

ঈদ করতে ঢাকা ছাড়ছে কর্মব্যস্ত মানুষ, তবে বাস টার্মিনালে সেই উপচেপড়া ভিড় নেই।

রাস্তায় যানজট না থাকায় ঈদের ছুটির প্রথম দিন বুধবার সকাল থেকেই নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে গেছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটের বাস। আরিচা-পাটুরিয়া ঘাট হয়ে যাত্রা করা মানুষও যানজটে পড়েনি।

আর পদ্মা সেতু হওয়ায় দক্ষিণের বেশির ভাগ মানুষ গাবতলী বাসস্ট্যান্ড ছেড়ে সায়েদাবাদ টার্মিনালমুখী হয়েছেন।

শ্যামলী পরিবহনের গাবতলী কাউন্টারের ব্যবস্থাপক মো. মানিক বলেন, "গাবতলীর বাজার আগের মত নাই, সায়েদাবাদ চলে গেছে। দক্ষিণবঙ্গ, খুলনা, বাগেরহাট এসব রুটের যাত্রী সব এখন সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে যায়।

“গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে অগ্রিম টিকেটের যাত্রীদের ভিড় ছিল, আজ সকালেও কিছু যাত্রী এসেছে। কিন্তু আশানুরূপ না। যারা আগে টিকিট নিছে তারাই আসছে।"

উত্তরের গাড়ি ছাড়ছে ঠিক সময়ে

কল্যাণপুরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন কাউন্টারে এসে জড়ো হওয়া যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, টিকেট কাটা থেকে শুরু করে যথাসময়ে গাড়ি পাওয়ার ক্ষেত্রে এবার তারা স্বস্তি পেয়েছেন৷ এখন যাতে যাত্রাপথে যানজটে ভুগতে না হয়, সেই প্রত্যাশা তাদের।

রংপুর যেতে শ্যামলী পরিবহনের টিকেটে কেটেছেন ফজলে রাব্বি। তিনি বললেন, “আগের মত এবছর ভিড় নেই। কাউন্টারে দুঘণ্টা আগে এসে টিকেট কেটেছি। বাড়তি ভাড়াও দিতে হয়নি। কাউন্টারের প্রতিবছর যে ভোগান্তি হয়, সেটাও পোহাতে হয়নি।"

শ্যামলী পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারের ব্যবস্থাপক আনিছুর রহমান বলেন, ঈদযাত্রার চাপ শুরু হয়েছে মূলত মঙ্গলবার থেকে।

“ছাত্রছাত্রী, পরিবার সব ধরনের মানুষই যাত্রা শুরু করেছে। ১৭ তারিখ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত সব গাড়ির সিট ফিলাপ আছে। যানজট না থাকায় গাড়িগুলো ঠিক টাইমে ছাড়ছে এবং আমরাও সব রুটে দুই শতাংশ পর্যন্ত গাড়ি বাড়িয়ে টিকেট বিক্রি করছি। এখনও যানজট নেই, আর ঈদের আগে না হলে- আশা রাখছি যাত্রীরা নির্বিঘ্নে যাত্রা করতে পারবে।"

জয়পুরহাটগামী রনি বাস পেয়েছেন ঠিক সময়েই। তিনি বলেন, "এবার জ্যামের খবর পাই নাই। ঠিক টাইমেই গাড়ি আসছে। টিকেটও আগেই পাওয়া গেছে।"

হানিফ পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারের সিনিয়র স্টাফ মো. ফারুক বলেন, "আমরা আগেই টিকেট বেচছি। রানিংয়ের জন্য ধরে রাখি নাই। আগে যারা টিকেট নিছে, তারাই যাচ্ছে। যে কয় ট্রিপ ছাড়ার কথা, সবই ফুল হয়ে যাচ্ছে। যাত্রী চাহিদা থাকলে ট্রিপ বাড়তে পারে।"

যাত্রীদের কেউ কেউ বললেন, গেল কয়েকবছর ধরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার বাস রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ছাড়ার ফলে এক জায়গায় আর চাপ পড়ছে না।

গাবতলী টার্মিনালে শাহ ফতেহ আলী পরিবহনের এক কর্মী বলেন, "এখন উত্তরবঙ্গের গাড়ি ভাগ হয়ে মহাখালী টার্মিনাল, আব্দুল্লাহপুর, গাজীপুর, চন্দ্রা থেকে ছাড়ে৷ সায়েদাবাদ থেকেও কিছু গাড়ি যায়। এজন্য ঈদের চাপ এক জায়গায় পড়ে না।”

দক্ষিণের চাপ কম গাবতলীতে

বেসরকারি চাকরিজীবী কিষাণ চন্দ্র সরকার ঝিনাইদহ যেতে রয়েল এক্সপ্রেসের টিকেট কেটেছিলেন আগেভাগেই। পুরনো অভ্যাস ছাড়তে না পারায় দীর্ঘযাত্রা সঙ্গী করে আরিচাঘাট হয়েই যাচ্ছেন।

তিনি বললেন, "এদিক দিয়ে গিয়ে অভ্যাস, তাই এদিকে দিয়েই যাচ্ছি। আমি আগে টিকেট কেটেছিলাম, তাই এদিক দিয়ে এলাম। পদ্মা সেতু দিয়ে গেলে সোয়া তিন ঘণ্টায় যাওয়া যায়। এদিকে তার ডাবল সময় লাগে। প্যাসেঞ্জারতো আগের তুলনায় কমে গেছে এদিকে। আগে যে ভিড় হত, সেই ভিড় আর এখন নেই।”

সাকুরা পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার রিপন হাওলাদার বলেন, "আগে গাবতলী থেকে আমাদের ৫০ গাড়ি যাইত, এখন যায় ১০ গাড়ি। বেড়িবাঁধ দিয়ে বাবুবাজারের রাস্তাটা হয়ে গেলে গাবতলীর গাড়ি পদ্মা সেতু ব্যবহার করতে পারবে, তখন আবার এই টার্মিনালে দক্ষিণবঙ্গের যাত্রী বাড়বে।"

গাবতলী টার্মিনালে আশানুরূপ যাত্রী না পাওয়ার কথা জানালেন পূর্বাশা পরিবহনের টিকেট মাস্টার সাইফুল ইসলামও।

রয়েল এক্সপ্রেসের টিকেট মাস্টার সুফিয়ান বলেন, "এবার ভিড় হয় নাই। গাড়ি শুধু ফুল হয়ে যাচ্ছে। এক্সট্রা কোনো ট্রিপ বাড়ার প্রশ্নই আসে না। এসব ট্রিপেই লাভ-লস নিয়ে টানাটানি।"

ভিড় বেড়েছে সায়েদাবাদে

শফিকুল ইসলাম নামে এক যাত্রী বলেন, "বাগেরহাট যাব। পদ্মা সেতু হওয়াতে এখন এদিক দিয়ে সুবিধা। অনেক কম সময় লাগে৷ এক সপ্তাহ আগেই টিকেট কেটে রেখেছি।"

খুলনাগামী ইমাদ পরিবহনের যাত্রী রমজান আলী বলেন, এই পথে ঈদের সময় বরাবরই ভিড় থাকে। পদ্মা সেতু হওয়ার আগে ভিড় থাকত। তখন ঘাট পার হয়ে যেতে হত।

“এখন অল্প সময়ে যাওয়া যায়, তাই অনেক নতুন নতুন গাড়ির কাউন্টার হয়েছে। এবার অগ্রিম টিকেট নিয়েছি, তবে এবার কোনো বাড়তি ভাড়া দিতে হয়নি।”

ইমাদ পরিবহনের টিকেট মাস্টার আশুতোষ বলেন, “আগে যারা টিকেট নিয়েছে, তারাই এখন যাচ্ছে। নতুন করে লোকজন এসেছে, সকালে সবাইকে টিকেট দেওয়া যায়নি।"

খুলনা রুটে চলা চৌধুরী সুপার সার্ভিসের যাত্রী মো. রিপনের গাড়ি সায়েদাবাদ থেকে বের হতেও সময় লেগেছে প্রায় দেড় ঘণ্টা।

এই দেরির ব্যাপারে ওই বাসের টিকেট ম্যানেজার মো. বশির বললেন, "টার্মিনালে গাড়ির সিরিয়াল। গাড়িতে খুব বেশি যাত্রী হচ্ছে তা বলা যাবে না।”

লম্বা লাইন নেই মহাখালীতে

মহাখালী টার্মিনালে বরাবর দীর্ঘ লাইন হয় ময়মনসিংহ রুটের বড় কোম্পানি এনা ট্রান্সপোর্টের সামনে। এই কাউন্টারের টিকেট মাস্টার মো. শহিদ বললেন, "এবার রাস্তায় জ্যাম খুবই কম। আগে যেটা হতো গাড়ি গাজীপুরের জ্যাম ঠেলে আসতে পারত না।

“এবার গাড়ি আছে অনেক। তবে প্রতিবছর কাউন্টারে যে লম্বা লাইন থাকে, সেটা নেই৷ যাত্রী ভিড় আছে, তবে গাড়ি রাইট টাইমে থাকায় লাইন হচ্ছে না।"

শহিদের এই কথার সমর্থন মিলল মহাখালী টার্মিনালে এনা কাউন্টারের সামনে ১০-১৫ মিনিট ধরে লাইনে দাঁড়ানো শিক্ষার্থী রেজাউল করিমের কথায়। ঈদের ছুটিতে যেতে চান নিজের বাড়ি ময়মনসিংহে।

রেজাউল বলেন, "প্রতিবছরের মত দীর্ঘ লাইন এবার হয়নি। অল্প সময়েই কাউন্টারের সামনে চলে এসেছি।"

নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ রুটে চলা পল্লী মাহি বাসের টিকেট মাস্টার রেজাউল করিম বলেন, "সব সিট ফিলাপ। ঈদের যাত্রী ভালোই হচ্ছে। আসার টাইমে জ্যাম পাই নাই, যাওয়ার টাইমেও থাকবে না আশা করি।"

নেত্রকোণার কাশিগঞ্জে যেতে শাহজালাল এক্সপ্রেসের টিকেট কাটা মো. টুটূল মিয়া বলেন, "এই বছর অত একটা ভিড় ঠেলা লাগছে না৷ ট্রেনেও তো সুবিধা ভালো।"

শেরপুরগামী সোনার বাংলা পরিবহনের টিকেট বিক্রেতা খায়রুল ইসলাম অবশ্য খুশি না। তার ভাষায়, "যাত্রী কই? এম্নে তো লাইন থাহে। এইবার ত লাইন টাইন দেহি না। মানুষ অহন ডিজিটাল। নাইডের গাড়িতে অনলাইনে টিকেট কাইট্টা যায়গা।"

বাড়তি ভাড়ার অভিযোগ

গাবতলী টার্মিনাল থেকে অরিন ট্রাভেলসে গাইবান্ধা অভিমুখে যাত্রা করা আহসান হাবীবের এবার বাড়তি ভাড়া কিংবা দেরিতে গাড়ি ছাড়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে অনেক যাত্রীই অভিযোগ করেছেন বাড়তি ভাড়া আদায়ের।

চুয়াডাঙ্গা যেতে পূর্বাশা পরিবহনের টিকেট নেওয়া বেসরকারি চাকরিজীবী মালিক সওগাত বলেন, "বাড়তি ভাড়া তো অগ্রিম টিকেটেই নিয়ে নিয়েছে। ১১০০ টাকার এসি বাসের টিকেট বিক্রি করেছে ১৪০০-১৫০০-১৬০০ টাকায়৷"

সায়দাবাদ থেকে কুমিল্লা-নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর রুটে চলা বিভিন্ন কোম্পানির বাসে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বাড়তি দামে টিকেট বিক্রির অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।

মো. সোহাগুল ইসলাম রুবেল নামের এক যাত্রী বলেন, "আজ ভোরে কুমিল্লার বিভিন্ন বাস কাউন্টারে ভিড় হয়েছে৷ এশিয়া এয়ারকনে (এসি বাস) যে ভাড়া অন্যসময় ৩০০ টাকা, তা ৪০০ টাকা করে নিয়েছে।"

বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ এসেছে এশিয়া লাইন, আল আরাফাহ, হ্যালো ট্রাভেলসের নামেও।

সায়েদাবাদ টার্মিনালে বাগেরহাটগামী ফাল্গুনী বাসের যাত্রী শফিকুল ইসলাম বলেন, "ঈদ হিসেবে কিছু বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। আগে ছিল ৬০০ টাকা, এখন ভাড়া নিচ্ছে ৭০০ টাকা।"

সিলেটগামী আল-মোবারাকে বাসে টিকেট কাটা যাত্রী মো. সাকিব জানালেন, তিনি আগে টিকেট কাটেননি, কাউন্টারে এসে কিনেছেন। আগে ছিল ৬৫০ টাকা, এখন ৮০০ টাকা নিয়েছে।

বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগের বিপরীতে যুক্তি দিয়ে পূর্বাশা পরিবহনের টিকেট মাস্টার সাইফুল ইসলাম বলেন, "নন এসি বাসে বিআরটিএ যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাই নেওয়া হচ্ছে। এসি বাসের ক্ষেত্রে বাসগুলো গিয়ে ফাঁকা আসে। এই খরচ পোষাতে সব পক্ষের সাথে কথা বলেই ভাড়া দুই তিনশ টাকা বাড়ানো হয়েছে।"

টার্মিনালে বিশৃঙ্খল পার্কিং

রাস্তায় যানজট না থাকলেও টার্মিনালগুলোতে বাস বের হতে ও ঢুকতে লাগছে অতিরিক্ত সময়। যাত্রী ওঠাতে বিশৃঙ্খল পার্কিংয়ের কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন।

কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে বের হয়ে মূল রাস্তায় পৌঁছাতেই একেকটি বাসের এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগছে। মহাখালী টার্মিনাল থেকে বাস বের হওয়া ও ঢোকার ক্ষেত্রে সৃষ্ট যানজট পৌঁছেছে নাবিস্কো মোড় পর্যন্ত। এ টার্মিনাল থেকে ময়মসিংহের নানা রুটে চলা বাসগুলোকে রাস্তা থেকেই যাত্রী তুলতে দেখা গেছে।

এ টার্মিনালে দায়িত্ব পালন করা এক ট্রাফিক কর্মকর্তা বলেন, “ভাই আমাদের জীবন শেষ। এরা কথা শুনতেই চায় না। ইফতারের পর সব একসাথে বের হয়ে জ্যাম বাধিয়ে বসে আছে।”

টার্মিনালে ট্রাফিক শৃঙ্খলা নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, “বাস একসাথে রাস্তায় যেখানে ৫টা থাকার কথা, সেখানে টার্মিনাল থেকে একসাথে বের হচ্ছে ১০টা। টার্মিনালে ১০০টা থাকার কথা হলে ৫০০টা থাকছে। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি গাড়ি থাকলে একটু বিশৃঙ্খলা হবে।

“যাত্রাবাড়ীর দিকে একটু সমস্যা হচ্ছে। সেখানে আমরা রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। আজকে-কালকে একটু প্রেশার থাকবে। একবার হাইওয়েতে উঠে গেলে আর সমস্যা হবে না। আমরা যথেষ্ট লোক নিয়োগ করেছি, কিন্তু মানুষ কথা শুনলে মানানো যায়। এরা শুনতে চায় না। সবাই আগে যেতে চায়।”