ফিরে দেখা: ২০২২ সালেও শেষ হয়নি দুই প্রকল্পের ‘যন্ত্রণা’

বিআরটি প্রকল্পের কাজ ৮২ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সার্বিক কাজ এগিয়েছে ৫৬ শতাংশ।

ওবায়দুর মাসুমজ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2022, 05:06 PM
Updated : 30 Dec 2022, 05:06 PM

ঢাকাকে আরও বাসযোগ্য করতে, রাজধানীবাসীর দৈনন্দিন যাতায়াতের সুবিধা এবং রাজধানীর সঙ্গে আশপাশের শহর ও শহরতলীর যোগাযোগ নির্বিঘ্ন করতে এক বছরের ব্যবধানে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দেয় সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়। 

দশক পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি এ দুই প্রকল্পের কাজ। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের খরচ, বেড়েছে রাজধানীবাসীর ভোগান্তি। 

আলোচিত এ দুই প্রকল্পের প্রথমটি - ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে নির্মাতা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১১ সালে। পরের বছর ২০১২ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় প্রকল্প- ঢাকা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পের কাজ। 

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে তেমন আলোচনা না থাকলেও বিআরটি প্রকল্প গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার উত্তরাংশসহ গাজীপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের ভোগান্তির বড় কারণ। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা রেখে নির্মাণকাজ না চালানোয় এরইমধ্যে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে এ প্রকল্পে।

সবচেয়ে আলোচিত দুর্ঘটনা ঘটে গত অগাস্ট, ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে নিহত হয় পাঁচজন। 

এখন পর্যন্ত দুই প্রকল্পের অগ্রগতি বলতে - গত নভেম্বরে বিআরটি প্রকল্পের একটি অংশে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। আর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে বনানী পর্যন্ত কাজ শেষের পথে। সরকার চাইলে এই অংশে যান চলাচল শুরু করতে পারবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের পরিচালক।

গার্ডার দুর্ঘটনায় আলোচিত বিআরটি প্রকল্প 

বিআরটি প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করা হয় ২০১২ সালে। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। পরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে ডিসেম্বরের শেষেও চালু হচ্ছে না বিআরটি প্রকল্প। 

এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের খরচ হচ্ছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। 

বিআরটির নির্মাণকাজে দীর্ঘসূত্রতা রাজধানীবাসীর ভোগান্তির অন্যতম কারণ। প্রতিদিন টঙ্গীর দত্তপাড়ার বাসা থেকে ঢাকায় অফিস করেন সাংবাদিক মাহবুবুল আলম কবীর। তিনি বলেন, “কাজ শুরুর পর থেকে বিআরটি প্রকল্পের কারণে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ওই পথের হাজারো যাত্রীর।

“খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়কের এখানে-সেখানে গর্ত, প্রায়ই রাস্তার অর্ধেক বন্ধ করে কাজ করা এবং যানবাহন নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থাপনার কারণে ওই সড়কে রাতদিন যানজট লেগে থাকে।” 

মাহবুবুল আলম কবীর বলেন, “আমি প্রায়ই অফিসের গাড়িতে আজমপুর এসে নামি। সেখান থেকে বাসে টঙ্গী কলেজগেট পর্যন্ত ১৫ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু রাতে আমি প্রায়ই হেঁটে আসি। কারণ এমন জ্যাম হয় বাসের স্টার্ট বন্ধ করে বসে থাকেন চালক। এই সময়ে আমি হেঁটেই চলে আসি। কারণ বাসে উঠলে বাসায় পৌঁছুতে ফজরের আজানও হয়ে যেতে পারে।”

গত ১৫ অগাস্ট ঢাকার উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার পড়ে পাঁচজন নিহত হলে আলোচনায় আসে এ প্রকল্প। 

ওইদিন রাজধানীর জসিমউদ্দিন বাস স্ট্যান্ডের কাছে সড়কে বিআরটি প্রকল্পের কংক্রিটের গার্ডার ক্রেইন দিয়ে তোলা হচ্ছিল ট্রেইলারে। ভারসাম্য হারিয়ে ক্রেন একদিকে কাত হয়ে ওই ট্রেইলারের পাশ দিয়ে টঙ্গীমুখী সড়কে চলমান একটি প্রাইভেটকারের ওপর পড়ে গার্ডারটি।

ভারী ওই গার্ডারের চাপে মুহূর্তে চ্যাপ্টা হয়ে যায় গাড়িটি। মৃত্যু হয় পাঁচজনের। 

ঘটনার পর ওই ক্রেনের চালক, ঠিকাদার কোম্পানি চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের (সিজিজিসি) এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। 

ক্রেন চালকসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়। তবে তারা জামিনে বের হয়ে এসেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

ওই ঘটনায় পুলিশ এখনো তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দিতে পারেনি।

এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোহসিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই মামলার আসামিরা জামিনে আছেন। এখনও তদন্ত চলছে।” 

তদন্ত কতদিনে শেষ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা সরকারি মামলা, তদন্ত শেষ করার কোনো নির্ধারিত সময় নেই।”

গত ৬ নভেম্বর গাজীপুরের টঙ্গী ফায়ার সার্ভিস থেকে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং পর্যন্ত ফ্লাইওভারের ঢাকামুখী দুইটি লেইন খুলে দেওয়া হয়। ওই অংশ দিয়ে শুধু ঢাকামুখী যানবাহন চলতে পারে। 

ওইদিন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, “বিআরটি প্রকল্পের কাজ আগামী জুন নাগাদ শেষ হবে।”

গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, “গত নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি ৮২ দশমিক ২৫ শতাংশ। আগামী জুলাই মাসে ওই রুটে বাস চালুর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন তারা। 

“এ প্রকল্পটি কয়েকটি ধাপে শেষ হবে। আসছে জানুয়ারিতে টঙ্গী পর্যন্ত নিচের সড়কটি গাড়ি চলাচলে সম্পূর্ণ উপযোগী হবে। ফ্লাইওভারসহ বাকি কাজ শেষ করতে এপ্রিল-মে মাস চলে যাবে। জুলাইয়ে গাড়ির প্রথম চালান চলে আসবে, তখন আংশিকভাবে বাস চালু করবো।”

Also Read: বিআরটি প্রকল্প: দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ, জীবনেরও ঝুঁকি

Also Read: এক বিআরটিতেই বারবার গার্ডার দুর্ঘটনা

Also Read: গার্ডার চাপায় চিড়ে চ্যাপ্টা গাড়ি, ভেতরেই গেল ৫ প্রাণ

Also Read: গার্ডার দুর্ঘটনা: ঠিকাদারের ‘গাফিলতি’ পেয়েছে তদন্ত কমিটি

Also Read: বিআরটি: টঙ্গী থেকে উত্তরা পর্যন্ত আংশিক খুললো

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে 

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প শুরু হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে। কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে এই পথ কুতুবখালীতে গিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মিলবে।

প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে, ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) এ প্রকল্পে বিনিয়োগ ও নির্মাণ কাজের দায়িত্বে আছে ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। 

বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত সড়ক পথের মোট দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এছাড়া ৩১টি র‌্যাম্পসহ ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ওভারপাসসহ মোট ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার জুড়ে এই পথ নির্মাণ করা হচ্ছে। 

তিনটি ধাপে চলছে এ প্রকল্পের কাজ। প্রথম ধাপে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বনানী রেল স্টেশন পর্যন্ত অংশের দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দ্বিতীয় ধাপে বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। তৃতীয় ধাপে মগবাজার রেলক্রসিং থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে। 

২০১১ সালে ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পর ওই বছরের ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ভিত্তি স্থাপন করেন।

কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতায় কাজ আটকে থাকে দুই বছর। 

নকশা পরিবর্তন ও মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করে সরকার। চুক্তি সংশোধনের পর ওই বছরই শুরু হয় ভূমি জরিপ। 

২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর এবং ২০১৫ সালের ১৬ অগাস্ট দুই দফা এর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিমানবন্দর থেকে বনানী হয়ে তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত অংশে গার্ডারের ওপর ডেস্ক স্লাব বসানো হয়েছে। তার ওপর করা হয়েছে পিচ ঢালাই। 

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে যাওয়ার দুটি র‌্যাম্পও নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া কুড়িল, আর্মি গলফ ক্লাব এবং বনানী অংশের র‌্যাম্পের কাজও শেষের দিকে। এই অংশে র‌্যাম্পের সঙ্গে নিচের সড়কের সংযোগ বাকি রয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক এএইচএম শাখাওয়াত আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, প্রথম ধাপের ৯২ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপের ৪৫ শতাংশ এবং তৃতীয় ধাপের ২ শতাংশ কাজ হয়েছে। সব মিলিয়ে গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের অগ্রগতি ৫৬ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুনে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। 

“মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত অংশে মাটি পরীক্ষা, টেস্ট পাইল করা হয়েছে। আর বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত যানবাহন চলাচলের উপযোগী হয়েছে। 

“বিমানবন্দর থেকে পুরো অংশে ডেস্ক স্লাব বসিয়ে তার ওপর অ্যাসফল্ট কোটিং করা হয়েছে। এই অংশে বিমানবন্দর থেকে কামাল আতাতুর্ক পর্যন্ত গাড়ি নামতে পারবে। আবার কেউ বনানী থেকে উঠে কুড়িল এবং বিমানবন্দরে নামতে পারবে।”