পেঁয়াজ ছাড়া যা দিয়ে চলে মণিপুরী রান্না, কী এই ‘ন্যান্নাম’?

ন্যান্নাম দেখতেও পেঁয়াজ গাছ বা পেঁয়াজের পাতার মতো; মূলত পাতাগুলোই রান্নায় ব্যবহার করেন মনিপুরীরা।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2023, 03:55 AM
Updated : 8 June 2023, 03:55 AM

বাজারে পেঁয়াজের দাম উত্তাপ ছড়ালেও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মণিপুরী সমাজে তার কোনো আঁচই নেই; কারণ তাদের রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহারই নেই। ‘ন্যান্নাম’ নামে এক জাতীয় উদ্ভিদ মুখরোচক করে তাদের রান্না, তাতে পেঁয়াজের সব পুষ্টিগুণই রয়েছে বলে জানিয়েছেন এক গবেষক।

সিলেটের মাছিমপুর, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে মণিপুরী সম্প্রদায়ের বাস; তাদের প্রায় সব বাড়িতেই এই ‘ন্যান্নাম’ গাছ দেখা যায়। নিজেদের রান্নার চাহিদা মেটাতেই তারা এগুলো বাড়ির আঙিনা বা আশেপাশে চাষ করে থাকেন।

মণিপুরীদের বেশি দেখা যায় মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায়। ওই এলাকায় ন্যান্নাম গাছ দেখলেই বোঝা যায়, সেটা মণিপুরী কারও বাড়ি। বাড়ির আঙিনায় ন্যান্নাম গাছ থাকাটা খানিকটা ঐতিহ্যের অংশও বলে মনে করেন তারা।

এই এলাকার স্থানীয় মণিপুরীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুদীর্ঘকাল থেকে তারা রান্নায় ন্যান্নাম ব্যবহার করেন। চলটা কবে শুরু হয়েছিল, তা জানা যায় না। বাণিজ্যিকভাবে চাষ না হলেও ধনী-গরিব প্রায় সব বাড়িতেই এটি দেখা যায়।

মণিপুরী নারীরা বলছেন, পেঁয়াজের পুরো স্বাদই পাওয়া যায় ন্যান্নাম ব্যবহারে। ফলে প্রায় সব মণিপুরী ন্যান্নাম ব্যবহার করেন।

ন্যান্নাম দেখতে পেঁয়াজ গাছ বা পেঁয়াজের পাতার মতেই। মূলত গাছের পাতা তুলে রান্নায় ব্যবহার করা হয়।

কমলগঞ্জের মৈতৈ মণিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ও পাঙান সম্প্রদায়কে নিয়ে ‘মণিপুরী সমাজে জনউদ্ভিদ গবেষণা’ শিরোনামে ২০০১-২০০২ সালে একটি গবেষণা করেছিলেন লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ। গবেষণায় তিনি ৯৭টি উদ্ভিদের সন্ধান পান, যা মণিপুরী সমাজে নানাভাবে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ‘ন্যান্নাম’ও রয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে পাভেল বলেন, “পেঁয়াজের পাতার মতো দেখতে পাতাগুলো মূলত মসলা হিসেবেই মণিপুরীরা রান্নায় ব্যবহার করে থাকে। তারা একে বলে ‘য়ৗন্নাম’, ‘ন্যান্নাম’ এবং ‘নাকুপ্পি’।

“কোনো বাড়িতে এই গাছের উপস্থিতি মণিপুরী সমাজের কাছে বাড়িটি মণিপুরী বাড়ি চেনার একটি ‘জনউদ্ভিদ’ নির্দেশনাও। এই পাতা জলের সঙ্গে সিদ্ধ করে খেলে প্রস্রাবের সমস্যা দূর হয়।”

পাভেল বলেন, মণিপুরীদের একটা বড় অংশ নিরামিষাশী, তাদের অনেকেই পেঁয়াজ-রসুন খান না। প্রথাগত মণিপুরী খাদ্য হিসেবে তারা ন্যান্নাম ব্যবহার করেন। পেঁয়াজের সব পুষ্টিগুণই ন্যান্নামের মধ্যে রয়েছে। তবে এতে পেঁয়াজের মতো ঝাঁজ নেই।

রান্নায় এই উদ্ভিদ ব্যবহারে সবাইকে উৎসাহী করা গেলে তা পেঁয়াজের বিকল্পই শুধু নয়, বরং খাদ্যাভাসে বৈচিত্র্য আনতে পারে বলে মনে করেন এই গবেষক।

“এখন যেমন এককভাবে আধিপত্য তৈরি করেছে পেঁয়াজ, সেটি কমে আসবে। খুব সহজেই অনেকে বাড়ির আঙিনায় এটি চাষ করতে পারবেন।”
মণিপুরী সমাজে ন্যান্নামর একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে, ফলে বাণিজ্যিকভাবে এটি ব্যবহার করতে গিয়ে যেন তাদের সেই ঐতিহ্য নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন পাভেল পার্থ।

কেবল বাংলাদেশের মণিপুরী সম্প্রদায়ই নয়; ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, মিজোরাম এবং মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের কিছু এলাকায়ও এই জাতীয় উদ্ভিদের ব্যবহার রয়েছে বলেও জানান তিনি।

তবে দেশের মসলা গবেষণা কেন্দ্রে এই ন্যান্নাম নিয়ে কোনো কাজ হয়নি বলে জানিয়েছেন ম‌‌‌সলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. জুলফিকার হায়দার প্রধান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ন্যান্নাম নিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ হয়নি। তবে চিভ নামের একটা মসলার জাত নিয়ে আমাদের কাজ হয়েছে। চিভের স্বাদও অনেকটা দেশীয় মসলা পেঁয়াজ-রসুনের মতো।”

ন্যান্নামের বিষয়ে খোঁজ নেবেন জানিয়ে জুলফিকার বলেন, “আমরা সাধারণত প্রচলিত মসলাগুলো নিয়েই কাজ করি। ন্যান্নাম নামে যে পাতা বা উদ্ভিদটির কথা বললেন, সেটি সম্পর্কে আমরা খোঁজ নেব। তারপর এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে।”

কমলগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এখানে এক বছরের মতো এসেছি। আমিও দেখেছি, এখানকার মণিপুরীরা ন্যান্নাম ব্যবহার করেন। এর সাথে একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও আছে।

“খাসিয়া, গারো সম্প্রদায় কিন্তু আবার এটা ব্যবহার করে না। তাই এর জন্য বড় পরিসরে গবেষণা দরকার। ন্যান্নামের পুষ্টিগুণ, উৎপাদন প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে যদি বড় পরিসরে গবেষণা হয়, তবে বাজারজাতকরণের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।”