হোতা ফ্রাঙ্কির বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসাতে থাকতেন চক্রের অন্যরা।
Published : 28 Jan 2024, 10:24 PM
কোকেন পাচারের অভিযোগে একটি চক্রের কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, গ্রেপ্তাররা দেশে অফিস নিয়ে কোকেন পাচারের কারবার খুলে বসেছিলেন।
বাংলাদেশে কোকেনের তেমন ব্যবহার না থাকায় সংস্থাটির কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, তৃতীয় কোনো দেশে পাচারের জন্য ঢাকায় এ মাদক আনা হয়।
তবে গন্তব্য দেশের নাম তারা এখনো জানতে পারেননি। সহযোগী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে এই পথটি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
রোববার তেজগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির মহাপরিচালক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী।
বুধবার আফ্রিকার দেশ মালাউইর নাগরিক নোমথানডাজো তোয়েরা সোকোকে আট কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেনসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিনই বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের কুকুর উত্তরার একটি হোটেলে তানজানিয়ার নাগরিক মোহাম্মেদি আলীর কাছে মাদক শনাক্ত করে, যাকে ২০০ গ্রাম কোকেনসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদেরকে একই চক্রের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, এই কয়েক দিনে চক্রটির সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা পাঁচটি দেশের নাগরিক। চক্রটির হোতা নাইজেরিয়ার নাগরিক জ্যাকব ফ্রাঙ্কি পরিচিতদের কাছে ‘ডন ফ্রাঙ্কি’ নামে পরিচিতি।
এই ব্যক্তি বাংলাদেশে নাইজেরীয় কমিউনিটির প্রেসিডেন্টও। তাকে তার সহযোগীরা ‘বিগ বস’ বলে ডাকে। ৯ বছর ধরে বাংলাদেশে বসবাস করা ফ্রাঙ্কি ৯ মাস আগে বাংলাদেশ ছেড়েছেন। এখন তিনি নাইজেরিয়ায় বসে বিভিন্ন দেশের মাদক বহনকারীদের মধ্যে সমন্বয় করছেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফারুকী জানান, গত বুধ ও বৃহস্পতিবার কোকেনসহ যে দুই বিদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে চক্রটির সন্ধান মিলেছে।
তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে আছেন-ডন ফ্রাঙ্কির ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান আপেল (২৭), সহযোগী সাইফুল ইসলাম রনি (৩৪), ক্যামেরুনের নাগরিক কেলভিন ইয়েঙ্গে এবং নাইজেরিয়ার ননসো ইজেমা পিটার ওরফে অস্কার (৩০) ও নাডুলে এবুকে স্ট্যানলি ওরফে পোডস্কি (৩১)।
ফারুকীর ভাষ্য, শুরুতে ধরা পড়া সোকো ও মোহাম্মেদি আলীর ডিজিটাল ডিভাইস বিশ্লেষণ করে তাদের চক্রের প্রধান ডন ফ্রাঙ্কির নাম পাওয়া যায়। ফ্রাঙ্কি নামমাত্র গার্মেন্ট ব্যবসার আড়ালে মূলত কোকেন চোরাচালানে যুক্ত।
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে এ চক্রের অন্যতম সদস্য ক্যামেরুনের নাগরিক কেলভিন ইয়েঙ্গেকে গ্রেপ্তার করা হয়। কোকেনের চালান বাংলাদেশ পর্যন্ত পৌঁছানোর বিষয়টি সমন্বয় করছিলেন ইয়েঙ্গে। তার সঙ্গে সমন্বয় করেই বাংলাদেশে আসেন মোহাম্মেদি।
তানজানিয়ার এ নাগরিক ধরা পড়ার পর ইয়েঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নেন, তবে তার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ইয়েঙ্গের কাছ থেকেও ডন ফ্রাঙ্কির বিষয়ে তথ্য মিলেছে জানিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণের ডিজি ফারুকী বলছেন, এরপর ডন ফ্রাঙ্কির বাংলাদেশের সমন্বয়কারী সাইফুল ইসলাম রনির বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে রনিকে আটক করা হয়।
রনি একটি এগ্রো মেশিনারিজ কোম্পানির পরিচালক, দুই বছর ধরে তিনি ডন ফ্রাঙ্কির সঙ্গে মাদক কারবারে যুক্ত হন। তার কাজ ছিল মাদক বহনকারীদের দেশে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় আমন্ত্রণপত্র (ইনভাইটেশন লেটার) তৈরি ও ভিসার পাওয়ার বিষয়টি তদারকি করা।
ম্যাসপেক্স নামে একটি কাগুজে কোম্পানির প্যাডে রনি এসব আমন্ত্রণপত্র তৈরি করতেন, যা দেখিয়ে অন অ্যারাইভাল ভিসা পেতেন আফ্রিকান মাদক বহনকারীরা। তাদের হোটেল রিজার্ভেশনের দায়িত্বও ছিল রনির।
রনির মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও অন্যান্য ডিভাইস বিশ্লেষণ করে একাধিক এমন আমন্ত্রণপত্র এবং ফ্রাঙ্কির সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ফারুকী।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রনির কাছ থেকেই ডন ফ্রাঙ্কির বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার অফিস কাম বাসার ঠিকানা পাওয়া যায়। তাকে নিয়ে সেখানে অভিযানে গেলে কোকেন পারিবহনে ব্যবহৃত পাঁচটি লাগেজ ও ৭০ গ্রাম কুশ (এক ধরনের মাদক) পাওয়া যায়।
সেখানে বাড়ি মালিকের সঙ্গে কথা বলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জেনেছেন, ডন ফ্রাঙ্কি ৯ মাস আগেই দেশ ছেড়েছেন। তার অবর্তমানে তার ভাই উইসলি এবং ফ্রাঙ্কির ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান আপেল ওই বাসায় থেকে মাদক কারবার দেখাশোনা করছেন।
বুধবার কোকেন চালান আটকের সংবাদ পেয়েই তারা আত্মগোপনে চলে যান। পরে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসাদুজ্জামান আপেলকে বারিধারা থেকে আটক করা হয়। আটকের পরে আপেল জানান, বাংলাদেশে কোকেনের চালান ঢোকার পর তা পুনরায় প্যাকেট করা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব ছিল তার। তবে ডন ফ্রাঙ্কির ভাই উইসলিকে পাওয়া যায়নি।
ডিজি ফারুকী বলেন, “আমরা জেনেছি সে দেশ ছেড়েছে, হয়তো সে প্রতিবেশী কোনো দেশে গিয়ে থাকতে পারে।”
আপেলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয় নাইজেরিয়ার নাগরিক ননসো ইজেমা পিটার ওরফে অস্কার ও নাডুলে এবুকে স্ট্যানলি ওরফে পোডস্কিকে। তারা সবাই ডন ফ্রাঙ্কির বাসাতেই থাকতেন।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান ফারুকী বলেন, “একটা হোটেল ৭ দিনের জন্য বুক করে তারা অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে আসছে। হোটেল থেকেই তারা বিভিন্ন জায়গায় যায়।
“পরে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনের মধ্যে একজনের পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। ভিসার মেয়াদ শেষে তারা বাংলাদেশে থেকে গেছে।”
কোকেনের গন্তব্য কোথায়?
ঢাকায় চক্র গড়ে বসলেও এই কোকেনের শেষ গন্তব্য বাংলাদেশ নয় জানিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলছেন, “আমাদের বা দেশের অন্য সংস্থাগুলোর অভিযানে বাংলাদেশে তেমন কোকেন সেবনকারী পাওয়া যায় না। সে কারণে ধারণা করি, তারা বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে।
“মালাউইর নাগরিক সোকো ঢাকায় আসার আগে তার দেশ থেকে ইথিওপিয়ায় গিয়েছে। সেখান থেকে দোহা হয়ে ঢাকায় এসেছে। বাংলাদেশ থেকে পাশের ইন্ডিয়াসহ যে কোনো দেশে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। আমাদের যে আন্তর্জাতিক সাহায্যকারী যারা রয়েছে, তাদের আমরা বলেছি এই রুটটি চিহ্নিত করার জন্য। তারা এর পরবর্তী অংশগুলো দেখছে।”
ডন ফ্রাঙ্কির এ সিন্ডিকেট বিগত বছরগুলোতে কী পরিমাণ মাদক পাচার করেছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিজি ফারুকী বলেন, “যেহেতু ফ্রাঙ্কিকে ধরা যায়নি, তাই এটা এখনো জানা সম্ভব হয়নি। তবে এর মধ্যে সে আরেকটা বিজনেসে যুক্ত হয়েছে, যার কারণে সে রনিকে যুক্ত করেছে।
“রনি কিছু গার্মেন্টেসের কাজ করতো। বায়ার হিসেবে পোশাক কিনে অন্য দেশে পাঠায়, বিশেষ করে প্লেয়ারদের জার্সি তারা সরবরাহ করে। এর মধ্যে তার আরও কোনো অবৈধ ব্যবসা ছিল কি না সেটাও দেখা হচ্ছে।”
জাতিসংঘের ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম সংশ্লিষ্ট দপ্তরের (ইউএনওডিসি) ‘গ্লোবাল কোকেন রিপোর্ট ২০২৩’ অনুযায়ী, বিশ্বে কোকেন উৎপাদন হয় মূলত দক্ষিণ আমেরিকায়। আর বেশির ভাগ ব্যবহারকারী ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বিভিন্ন দেশ ঘুরে ব্যবহারকারীদের হাতে যায় কোকেন।
তারা কি তল্লাশি ফাঁকি দিতে পারে?
মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলছেন, “বিমানবন্দরে নামার পর নিয়মিত তল্লাশিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। মালাউইর নাগরিক সোকোর বিষয়ে তিনদিন আগে ছবিসহ তথ্য পাঠায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।”
তারা লাগেজে যে কৌশলে মাদক বহন করছেন, তাতে বিমানবন্দরের প্রচলিত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ধরা পড়ার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান ফারুকী।
তিনি বলেন, “লাগেজে (কোকেন বহনের জন্য) একটা চেম্বার করেছে। লাগেজের সেই চেম্বারে কার্বন কাগজ দিয়ে মুড়ে কোকেন আনা হয়েছে। রাংতা কাগজে বা কার্বন পেপারে মোড়ানো হলে সেটা বিমানবন্দরে স্ক্যানিংয়ের সময় স্ক্রিনে আসে না।”
এ বিষয়ে জানতে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের মহাপরিচালক ফারুকী বলছেন, “এই লাগেজগুলোর বিষয়ে আমরা তথ্য নিচ্ছি। আমরা ইন্ডিয়ার সাথে যোগাযোগ করেছি।
“যুক্তরাষ্ট্রের যে ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিসেট্রশন রয়েছে, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ হচ্ছে। বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে এরকম লাগেজ নিয়ে তারা কতোজন পাস করেছে।”