আগুনে নিহত ৫: জোড়াতালির মাইক্রোতে যাত্রী ১৮, গতি ১১০ এর উপরে

দুর্ঘটনার পরপরই চালক গাড়ি থেকে নেমে যান, আর পেছনে পুড়ে মরতে হয় যাত্রীদের।

গোলাম মর্তুজা অন্তুজ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2023, 05:04 PM
Updated : 14 March 2023, 05:04 PM

ময়মনসিংহের ত্রিশালে রোববার গভীররাতে যে মাইক্রোবাসে আগুনে ধরে পাঁচজন নিহত হন; তার জীবিত যাত্রীরা বলছেন, লক্করঝক্কর সেই গাড়িটি তখন ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলছিল। ১১ আসনের গাড়িটিতে ৪ শিশু, চালকসহ মোট ১৮ আরোহী ছিলেন। সেই সঙ্গে ছিল ৫০ কেজির চালের বস্তা, ব্যাগসহ অন্যান্য মালামাল।

প্রাণে বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের ভাষ্য, চালক একটি বাসকে ওভারটেক করার চেষ্টায় ছিলেন, তখনই একটি চাকা পাংচার হলে গাড়িটি কাঁপতে থাকে, কিছুটা নিয়ন্ত্রণহীনও হয়ে পড়ে। তখন চালক জানান, ব্রেক কাজ করছে না। এরপরই গাড়িটি একটি পিলারে ধাক্কা খায়। ধাক্কার পরপরই চালক গাড়ি থেকে নেমে যান। আর পেছনে পুড়ে মরতে হয় যাত্রীদের।

দুই দশকের পুরনো মাইক্রোবাসটি ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া পথে বাসের মতোই নিয়মিত চলাচল করত বলে জানান এর মালিক ও যাত্রীরা। ধোবাউড়া উপজেলার মুন্সীরহাটে গাড়িতে ওঠার পর চালককে তার জোড়া দিয়ে গাড়ির ভেতরে কিছু একটা মেরামত করতেও দেখেন যাত্রীরা। তারা জিজ্ঞেস করলে চালক বলেন, “ওইডা কুনো সমস্যা না”। দুর্ঘটনার পর থেকে পলাতক চালক আল মামুন।

এই ঘটনায় পাঁচজনের প্রাণহানি ছাড়াও দগ্ধ হয়ে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আরও তিনজন। কয়েকজন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন।

ওই গাড়িতে মুন্সীরহাট থেকে উঠেছিলেন আসাদুজ্জামান শাহীন ও নাসিমা আক্তার। হাতেমুখে জখম আর পোড়া ক্ষত নিয়ে আগারগাঁওয়ের বাসাতেই রয়েছেন এ দম্পতি। প্রাণে বেঁচে এলেও চোখের সামনে সহযাত্রীদের পুড়ে মরার সেই দৃশ্য চোখ বন্ধ করেও দেখতে পাচ্ছেন নাসিমা।

তাদের ভাষ্য, চালকের খামখেয়ালির কারণেই এই দুর্ঘটনা। নাসিমা বসেছিলেন গাড়ির দ্বিতীয় সারির মাঝে, আর চালকের ঠিক পাশের আসনে আরেকজনের সঙ্গে চাপাচাপি করে বসতে হয়েছিল শাহীনকে। প্রতিজন ৪০০ টাকা ভাড়ায় মুন্সীরহাট থেকে ওই গাড়িতে উঠেছিলেন এই দম্পতিসহ তাদের পরিবারের পাঁচজন। সঙ্গে একটি শিশুও ছিল। দুর্ঘটনায় আহত ও দগ্ধ হয়েছেন সবাই, সঙ্গে থাকা ৯ বছরের শিশুটির হাতের অনেকখানি পুড়ে গেছে। তার আতঙ্ক কাটছে না।

শাহীন বলেন, “আমরা গাড়িত উঠছি তহন রাইত ১১টা বাজে। মুইনসিং পর্যন্ত রাস্তায় জ্যাম আছিল, আমি পাশে বইসা মিটারের কাঁটা দেখতাছি ৬০ এর উপ্রে চলতে পারতাছে না। মুইনসিং পার হওয়ার পর ডাইভার ব্যাডার পাগল হইয়া গেল গা!”

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “আমাগো ধোবাউড়া রুটের একটা বাস আছে ‘সিয়াম’, সে সেইটারে ওভারটেক করতে চায়। আমি পাশে বইসা দেখতাছি, কাঁটা ৬০ থিকা ৮০তে উঠল। আমি কইলাম এই তুমি গতি কমাও, পরে সামলাইতে পারবা না। আমি কিন্তু একটা ড্রাইভার। হেই ব্যাডায় কয়, ‘চুপ কইরা বইন, কিছু হইতো না’।

“এরপর দেহি, কাঁটা ১১০ এর উপ্রে। এই সময়ই চাক্কা একটা পাংচার হইল। চাক্কা বাইরাইতাছে, গাড়ি কাঁপতাছে। আমি কই, ব্রেক মারো, ব্রেক মারো। হেই ব্যাডায় কয়, ‘ব্রেক তো হইতাছে না, এহন কী করবাম’। গাড়ির গতি মনে হয় এট্টু কমছে। এই টাইমে ব্যাডায় গিয়া পিলারে মাইরা দিল। হেরপর নিজে গাড়িত্তে নাইমা গেলো গা।”

শাহীন জানান, চালকের বেপরোয়াপনা দেখে তিনি নিজের আসনটি জড়িয়ে ধরেছিলেন, সাবধান করেছিলেন পেছনে থাকা স্বজনদেরও। সে কারণে গাড়ির প্রাথমিক ধাক্কাটা তারা সামলে ওঠেন ভালোভাবেই। কিন্তু ধাক্কার পরই গাড়ির ভেতরে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, এরপর পেছনের আসনের নিচ দিয়ে আগুনের শিখা আসতে থাকে।

এ সময় চালক সব যাত্রীদের ফেলে নিজের পাশে দরজা খুলে বেরিয়ে যান। কিন্তু বাম পাশের দরজাটি খুলছিল না। তখন শাহীন ও তার সহযাত্রী মিলে লাথি দিয়ে ফেটে যাওয়া উইন্ডশিল্ড খুলে ফেলেন। শাহীনের সহযাত্রী সেদিক দিয়ে লাফ দিয়ে নেমে মাঝের দরজাটি খুলে দেন। আর শাহীন তার পেছনে থাকা স্ত্রী নাসিমার কোলের ৯ বছরের ভাগ্নিকে টান দিয়ে তুলে নিয়ে সামনের ফাঁকা দিয়ে ফেলে দেন, নিজেও নেমে পড়েন।

সেই বিভীষিকার বর্ণনায় নাসিমা বলেন, “গাড়ি ধাক্কা মারার পর দেহি-নিচে দিয়া আগুন আহে। আমার স্বামী কয়, বাইরাও, আমি দেহি ওড়নায় আগুন লাইগা গেছে। সামনের পোলাডা আইসা দরজা খুইলা দিল, পরে আমারে ধাক্কা দিয়া গাড়ি থিকা ফেলছে আমার স্বামী।”

শাহীন জানাচ্ছেন, গাড়ির সামনের দুই আসনে চালকসহ তারা তিনজন বসেছিলেন। এরপরের সারিতে তার পরিবারের তিন নারী ও ৯ বছরের এক শিশু ছিল। পরের সারিতে চার ব্যক্তি ও এক শিশু এবং একদম শেষের সারিতে দুই দম্পতি বসেছিল, তাদের কোলে ছিল ২ শিশু।

ঘটনার পর গাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারি থেকে যাত্রীরা কোনোরকমে বের হতে পারলেও পেছনের সারির লোকেরা সেখানে দগ্ধ হন।

সেই মুহূর্তের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে নাসিমা বলেন, “আমি শুনতে পাইতাছি, পিছনের লোকগুলান ‘বাঁচান বাঁচান’ চিল্লাইতাছে। গাড়িতে তহন দাউ দাউ আগুন, বিকট শব্দে কী যেন বাস্ট হইল।

“আর আমরা নামছি, পরেই গাড়িটাও গড়ায়া গড়ায়া খাদে গেল গা। ক্যামনে বাঁচামু লোকগুলানরে! তয় ডাইবার যদি না পলাইয়া শুধু দরজাটা খুইলা দিত, তাইলে হয়তো ওগোরেও বাঁচান যাইতো।”

শাহীন বলছেন, দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগে ময়মনসিংহ বাইপাস থেকে গাড়িতে অকটেন ও সিএনজি ভরেছিলেন চালক। কথা ছিল ত্রিশালে একটা বিরতি দেওয়া হবে। কিন্তু বাসকে ওভারটেক করতে মরিয়া চালক বিরতি না দিয়ে গতি বাড়াতেই থাকেন।

শাহীন-নাসিমা দম্পতির আত্মীয় জেবুননেসা, তার মেয়ে মাহফুজা আক্তার গাড়িতে ছিল। তারা দুজনই আহত হয়েছেন।

জেবুন্নেসা বলেন, “আমি শুনতে পাইতাছি, শাহীন ভাই ডাইবাররে কইতাছে আস্তে চালাইতে। আর হেই ব্যাডায় খালি কয় ‘চুপ কইরা বইন’। গাড়ির এতো জোরে চালাইছে, বলার মতো না। অ্যাকসিডেন্টের আগে দিয়া ডাইবারে কয় ‘ব্রেক হইতাছে না’।”

শাহীন-নাসিমা পরিবারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ভাগ্নি আনিকা।

দুর্ঘটনায় এই পরিবারের সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছে ৯ বছরের আস্তিয়া আক্তার আনিকা। শিশুটি মুখ, হাত ও মাথায় আঘাত পায়। হাত ও মাথার চুল আগুনে পুড়ে যায়। দুর্ঘটনার পর থেকে শিশুটি আতঙ্কগ্রস্ত বলে জানাচ্ছেন স্বজনেরা।

মালিকের ভাষ্য

গাড়ির মালিক ঢাকার কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরের মো. রিপন। তার ভাষ্য, দু্টো ঋণ করে সাড়ে ৬ লাখ টাকায় এক স্বজনের কাছ থেকে গত নভেম্বরে গাড়িটি নিয়েছেন। কিন্তু পুরো টাকা দিতে না পারায় গাড়ির নাম বদল হয়নি। কথা ছিল এই মাসে আরও ৩০ হাজার টাকা দেবেন। এর মধ্যেই এই ঘটনা।

রিপনের দাবি, “২০০৪ মডেলের হাইয়েস সুপার জিএল মাইক্রোবাসটি পুরনো হলেও সেটিতে কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ ছিল না। গাড়িটিতে ৯২ লিটারের একটি সিএনজি সিলিন্ডার লাগানো ছিল।

“দুর্ঘটনার পরেও সিলিন্ডারটি অক্ষতই রয়েছে। অর্থাৎ সিলিন্ডার বিস্ফোরণের যে কথা বলা হচ্ছে সেটি সত্য নয়।”

চালকের গাফিলতিতেই যে এ দুর্ঘটনা তা মানছেন মালিক রিপন। তিনি জানান, এক সপ্তাহ আগে চালক হিসেবে আল মামুনকে নিয়োগ করা হয়। মামুনের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার নাগলা পশ্চিম ভাট্টা গ্রামে, বয়স চল্লিশের কোঠায়। রিপনেরও কয়েক আত্মীয় যাত্রী হিসেবে ছিলেন ওই গাড়িতে।

রিপনের ধারণা, উচ্চ গতিতে গাড়িটির সামনের চাকা পাংচার হওয়ায় সেটি ডানে-বামে ঘোরানো যাচ্ছিল না, আর সেই মুহূর্তে ব্রেক কাজ না করায় দুর্ঘটনাটি ঘটে।

গাড়ির যান্ত্রিক বা বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে আগুন লাগলো কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে মাইক্রোবাসটির মালিক বলেন, “পুরান গাড়ি, তারে কিছু কাটাছেঁড়া আছে। সিএনজি করা ছিল। তবে বড় কোনো সমস্যা ছিল না।”

রিপন জানান, তার এই পুরনো মাইক্রোবাসটির ঢাকায় তেমন ভাড়া হয় না। সপ্তাহে তিন দিন ধোবাউড়া রুটে বাসের মতো যাত্রী বহন করে। গাড়িটি কেবল রাতের বেলাতেই যাত্রী বহন করত।

ওই রুটে এমন শ’খানেক মাইক্রোবাস চলাচল করে। এসবের বেশির ভাগের ফিটনেস নেই বলে জানান রিপন। পাশাপাশি নিজের গাড়িটিকে ‘তুলনামূলক ভালো ও কাগজপত্র আপডেটেড’ বলে দাবি করেন তিনি।

অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা

পুলিশের ত্রিশাল থানার ওসি মাইন উদ্দিন জানিয়েছেন, এই ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় একটি মামলা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত মামলার কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

ওসি বলছেন,“ ঢাকা থেকে ধোবাউড়া রুটে অনেকগুলো মাইক্রোবাস চলে বলে শোনা যায়। এই মাইক্রোবাসটি সেরকম কি না- আমরা এখনও জানতে পারিনি।”

দুর্ঘটনার আগে চালক খুবই বেপরোয়া চালাচ্ছিলেন জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মাইন বলেন, “আমরা এখানকার একজনকে পেয়েছি, যিনি ওই গাড়ির যাত্রী ছিলেন। তিনি বলছেন, ‘চালক খুব বেপরোয়া ছিল, আর এমন সময়ই গাড়ির ব্রেক কাজ করছিল না।’ পরে চালক নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পিলারে ধাক্কা দেয়।”

আরও পড়ুন

Also Read: ত্রিশালে মাইক্রোবাস উল্টে আগুন, ৪ জনের মৃত্যু