মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় দূরে স্বজনের বাড়িতে যাওয়াও সমস্যা সংকুল হয়ে পড়েছে।
Published : 27 Aug 2024, 01:01 AM
ফেনীর ফুলগাজীর বাসিন্দা মহিউদ্দিন আহমেদ চাকরি করেন চট্টগ্রামে। বন্যার ভয়াবহ খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ির পথ ধরেন। মিরসরাইয়ের বারইয়ার হাট পৌঁছতেই লেগে যায় শুক্রবার। সেখান থেকে হেঁটে মহিপাল হয়ে ৫-৬ ঘণ্টায় পৌঁছেন ফুলগাজী।
তার বাবা মায়ের বাড়িতে থাকার সুযোগ ছিল না। বাবা-মা ও এক বোনকে খুঁজে পান একটি স্কুলে। বাড়ির কোনো জিনিসপত্র নিয়ে আসতে পারেননি। এখন বাড়ির পানি নেমে গেলেও সেখানে থাকার অবস্থায় নাই। স্বজনদের স্কুলে রেখেই তিনি ধনের চট্টগ্রামের পথ।
পাঁচদিন পর নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি। ভেসে উঠতে শুরু করেছে ডুবে থাকা বাড়িঘর। কিন্তু সেগুলোতে মানুষ গিয়ে উঠবে, সেই সুযোগ নেই। পানির স্রোতে নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় সবকিছু। তাই আশ্রয়কেন্দ্রেই কাটছে দিন, যারা ছাড়ছেন তারা কাছে বা দূরে স্বজনদের বাড়িতে ছুটছেন।
এ যেন এক অনিশ্চয়তাকে পেছনে ফেলে আরেক অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ানো।
ফুলগাজীর বাংলাবাজার এলাকা থেকে স্ত্রীসহ চট্টগ্রামে ছেলের বাসায় যাচ্ছিলেন ষাটোর্ধ্ব নূর ইসলাম।
তিনি বলেন, “কোনোমতে বাঁচি আছিলাম, বাড়ি-ঘরে থাকার মত অবস্থা নাই। এখন চিটাগংয়ে ছেলের বাসায় যাইতেছি। এমনে আশ্রয়কেন্দ্রে আর কয়দিন?”
এই স্বজনের বাড়িতে ছোটার আগে তাদেরকে জানানোর সুযোগও পাচ্ছেন না বেশিরভাগ মানুষ। তারা বাড়িতে গিয়ে তাদেরকে পাবেন কিনা, সেই বিষয়টিও অনিশ্চিত।
এই জানাতে না পারার কারণ হল বন্যার ব্যাপকতায় বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকায় যোগাযোগও করা যাচ্ছে না ফোনেও।
ফেনী শহর থেকে পানি নেমে গেলেও এখনও পানি আটকে আছে বিভিন্ন সড়কে। শহর থেকে বের হয়ে অন্য উপজেলার দিকে যেতে চাইলেই এখনও ভাঙতে হচ্ছে হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পর্যন্ত।
এ অবস্থায় ত্রাণবাহী ট্রাক ছাড়া সেসব উপজেলার সঙ্গে চলাচলের নেই কিছু। কোথাও কোথাও পানি নেমে যাওয়ায় নৌকাতেও পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে হেঁটেই চলতে হচ্ছে মানুষকে।
ফেনী শহর থেকে স্টেডিয়াম রোডের অনেকদূর পর্যন্ত বাইক চালিয়ে ভাতিজাকে নিয়ে এসেছিলেন আব্দুর রহিম। ফুলগাজীর মুন্সিরহাটে ছোটভাইয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকদের খবর নিতে যাবেন। সামনে আরও বেশি পানি থাকায় বাইক পাশে রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তিনি বলেন, “একটু খবর যদি নিতে পারতাম তাহলেই হইত। তারা আছে নাকি নাই তাই তো জানি না। বেঁচে থাকলে আলহামদুলিল্লাহ আর নইলে ইন্নালিল্লাহ কওন ছাড়া তো কোনো উপায় নাই।”
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তিনি বলেন, “বাসায় চলি যাই। গিয়ে বাইক রাখি, অন্যভাবে যাওন যায় নাকি দেখি।”
শহরের ২৫০ শয্যা হাসপাতাল মোড়ে ত্রাণবাহী ট্রাকের ভিড়, এখান থেকে ফেনীর বিভিন্ন উপজেলায় ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এসব ট্রাকে অনুরোধ করে উঠে যাচ্ছেন স্বজনদের খোঁজ করতে যাওয়া অনেকেই। আবার কেউ আশে-পাশের এলাকা থেকে এসে ভিড় করেছেন ত্রাণের আশায়।
জামাল উদ্দিন নামে একজন জানান, তার বোনের বাড়ি পরশুরাম এলাকায়। বন্যার শুরু থেকেই তাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এতদিন খোঁজ নিতে যাওয়ার উপায় ছিল না, তাই পানি কমায় রওনা দেন বোনের বাড়ির পথে।
জামাল বলেন, “কারো কোনো খোঁজ পাইতেছি না, গিয়ে দেখি কই আছে তারা। খোঁজ পাইলে সাথে করে নিয়া আসব।”
ত্রাণের সন্ধানে আসা শহরের পাঠাননগর এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল বলেন, “সবাই ত্রাণ নিয়ে দূরে চলে যায়। আমরা শহরের কাছে কিন্তু আমার ঘরে বুক সমান পানি। রান্না-বান্নার কোনো অবস্থা নাই, বাইরেও কিনে খাওয়ার মতও খাবার নাই। কিন্তু আমাদের কেউ দেখে না।“
অনেকের অভিযোগ, দূর অঞ্চলে ত্রাণ ও পানি পৌঁছাচ্ছে খুবই কম। বেশিরভাগ ত্রাণ বিতরণকারীরা শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ত্রাণ দিয়ে চলে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দা দুলাল মিয়া বলেন, “অনেকেই বাইরে থেকে এসে রোড-ঘাট চেনে না। কাছাকাছি এলাকায় ত্রাণ দিয়ে চলে যাচ্ছে। এতে কেউ দেখা গেছে ১০ বার পাচ্ছে, আবার কেউ পাচ্ছেও না।“
পুরো পথ সড়কে পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে না, আবার নৌকায়ও যাওয়া যাচ্ছে না। সড়কেরও কিছু জায়গায় শুকনো, আবার কিছু জায়গায় কোমর পানি। সড়কের অংশটুকু যাওয়ার জন্য ট্রাক লাগছে আবার আশে-পাশে যেতে নৌকা লাগছে।
ব্যাংক লেনদেনের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় সমস্যা হচ্ছে বলেও তথ্য মিলেছে।
বেসরকারি দাতব্য সংস্থা আল খায়ের ফাউন্ডেশনের রাশেদ মেহেদী বলেন, “আমরা কাজ করার জন্য রেডি আছি, কিন্তু আমাদের প্রধান সমস্যা ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারছে না। আমরা আরও ব্যাপকভাবে ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে পারতাম যদি এ সমস্যাটা না থাকত।
“ব্যক্তিপর্যায়ে যারা ত্রাণ দিচ্ছেন, তাদের অবশ্য এই সমস্যা নেই। তারা নিজেরা নিজেরা টাকা তুলে কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের লেনদেন তো সব ব্যাংকে, এটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। অন্তত এই পরিস্থিতিতে কাজ করার জন্য আমাদের লেনদেনের সীমাটা তুলে দেওয়া উচিত।”