Published : 02 May 2025, 06:47 PM
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য দখল বিষয়ে পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রধান আ ল ম ফজলুর রহমান যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিকে একেবারেই তার ‘ব্যক্তিগত’ বলে অভিহিত করেছে সরকার।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাবেক প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানের ওই বক্তব্য ঘিরে ভারতে ব্যাপক তোলপাড়ের মধ্যে শুক্রবার এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
আগের দিন বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও তার ওই বক্তব্যকে ব্যক্তিগত হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ সরকার এটা পরিষ্কার করতে চায়, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, সেগুলো সম্পূর্ণরূপে তার ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে দেওয়া।
“এসব মন্তব্য বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান বা নীতির প্রতিফলন নয় এবং সে কারণে, সরকার কোনোভাবে এই বক্তব্যকে সমর্থন করে না, কিংবা প্রকাশও করে না।”
ফজলুর রহমানের বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানকে না মেলানোর আহ্বানও জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “বাংলাদেশ সব দেশের সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসী হামলার পর প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে ভারতের সাত রাজ্য দখল নিয়ে ফজলুর রহমানের বক্তব্য আলোচনার জন্ম দেয়।
২৯ এপ্রিল এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, “ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করলে বাংলাদেশের উচিৎ হবে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্য দখল করে নেয়া। এব্যাপারে চীনের সাথে যৌথ সামরিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন বলে মনে করি।”
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তার এ বক্তব্য ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। ওই খবরগুলোতে ফজলুর রহমানকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য নিয়ে চীনে সফরে মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যকেও টানা হয়েছে ওই সংবাদগুলোতে।
২৮ মার্চ বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতে গিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বেইজিংয়ে চীনা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, “ভারতের সাত রাজ্য, ভারতের পূর্বাঞ্চলে, যেগুলোকে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়ে থাকে… ভারতের ভূবেষ্টিত অঞ্চল। সমুদ্রে যাওয়ার কোনো উপায় তাদের নেই। এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক আমরা।
“ফলে, এটা বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। এটা চীনের অর্থনৈতিক বর্ধিতাংশ হতে পারে। বিভিন্ন জিনিস নির্মাণ, উৎপাদন করুন, বাজারজাত করুন; জিনিসপত্র চীন নিয়ে আসুন কিংবা সারাবিশ্বে পাঠিয়ে দিন।”
মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য ঘিরে ভারতের রীতিমত হৈ চৈ শুরু হওয়ার তার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান বলেছিলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের এমন কথা ‘প্রথম’ নয়; আর ওই বক্তব্য ছিল ‘সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’।
সরকার দূরত্ব বজায় রাখলেও থামছেন না তিনি
ভারতের সাত রাজ্য দখল নিয়ে ফজলুর রহমানের বক্তব্য ঘিরে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার এটিকে তার ব্যক্তিগত বক্তব্য হিসেবে অভিহিত করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের মত তিনিও বলেছিলেন, অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কোনোভাবেই একমত পোষণ করে না অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশ সব দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে সম্মান করে।
সরকারের এমন বক্তব্যের পরও ফেইসবুকে আরও দুটি পোস্ট দিয়ে নিজের আগের বক্তব্য বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেন আ ল ম ফজলুর রহমান।
সেনা কর্মকর্তা ফজলুর রহমান তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক থাকার সময়ে ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তের বড়াইবাড়ি গ্রামে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল।
ওই সংঘর্ষে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ'র ১৬ জন সৈন্য নিহত হয় এবং তৎকালীন বিডিআরের ২ জন সৈন্য নিহত হয়।
ওই পোস্টে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাবেক প্রধান বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ভারতের মুসলমানদের ‘পুশ’ ঠেকানোর চিন্তা থেকে এসেছে তার এ বক্তব্য।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক পোস্টে তিনি লেখেন, “এবারে নরেন্দ্র মোদী সরকার পেহেলগামে নিজেরা পর্যটকদের হত্যা করে পাকিস্তানের উপরে দোষ চাপিয়ে পাকিস্তান আক্রমণ করে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছে।
“যদি ভারত পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয় তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি ভারতের হুমকি কি পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে কল্পনা করতে পারেন! তাই পাকিস্তানকে সামরিকভাবে রক্ষা করা এখন আমাদের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।”
তিনি আরও লেখেন, “এর মানে এই নয় যে আমাদেরকে পাকিস্তানের বন্ধু হতে হবে। এটা একটা স্ট্র্যাটেজিক বিষয়। পারস্পরিক নির্ভরতার বিষয়।
“যদি ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করে তবে চীনের সঙ্গে মিলে ভারতের উত্তর পূর্ব সাত রাজ্যকে দখলে নেয়া এটা ভারতের পাকিস্তান আক্রমণের রিজিওনাল ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া। যাতে ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করতে উৎসাহিত না হয়।”
বৃহস্পতিবার রাতে আরেকটি পোস্টে ফজলুর রহমান লিখেছেন, “...আমার কাছে সব চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এই উপমহাদেশে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা। মুসলমান বান্ধব মানুষদের স্বার্থ রক্ষা করা। কে কি ভাবলো তা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নাই।”
ওই রাতে আরেক পোস্টে পাকিস্তান প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক মাসকাওয়াথ আহসানের একটি পোস্ট নিজের নিজের ফেইসবুক আইডিতে শেয়ার করেন ফজলুর রহমান।
মাসকাওয়াথের ওই পোস্টে বলা হয়, “ভারতের সেনা প্রধান বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে মন্তব্য করলেন, সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি জুলাই বিপ্লবকে মৌলবাদীদের অভ্যুত্থান বলে তকমা দিলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিয়মিত বাংলাদেশ বিরোধী প্রোপাগান্ডা করলেন, পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ বিজেপি নেতা বাংলাদেশ আক্রমণের ঘোষণা দিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত চলে এলেন, ভারতের মিডিয়ায় ময়ূখেরা চট্টগ্রাম ও রংপুরকে আলাদা করে নেয়া বিষয়ে মানচিত্র এঁকে জল্পনা কল্পনা করলেন; ভারতের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন টক শোতে বসে।
“এসব বিষয়ের প্রতিবাদ জানিয়ে একটি শব্দ লেখেননি যারা, তারা যখন বাংলাদেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ভারতের সেভেন সিস্টারস সংক্রান্ত মন্তব্য শুনে ফেসবুক হিতোপদেশে ভরিয়ে ফেলেন; তখন মনে হয় অত্যাচারী চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে কাঁপতে কাঁপতে কেরানি আনোয়ার হোসেন তার ছেলেকে বলছে, চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে লাগতে যাসনে, আমরা গরিব আমরা অসহায়।”