“আমাগো কি দেহার কেউ আছে? আমরা মইরা গেলেই কার কী আহে যায়,” বলেন কার্গোর চালক মাইনুদ্দিন।
Published : 04 May 2024, 12:12 AM
জাহাজের পাটাতন থেকে পাড়ে ঠেকানো সরু তক্তা বেয়ে হাঁটতে যেখানে পা কাঁপে, সত্তরোর্ধ্ব তছিরন আক্তার সেখানে চলছিলেন মাথায় ৩০ কেজি ওজনের টুকরি নিয়ে।
বছরের পর বছর এভাবে ঢাকার আমিন বাজারের কয়লাঘাটে কাজ করছেন এই নারী। এখন শরীরে কুলায় না বয়সের ভারে। চার সদস্যের সংসারের বোঝা তার ঘাড়ে।
চট্টগ্রাম থেকে আসা এমভি খুরশিদা-২ কার্গো থেকে কয়লা নামাতে গিয়ে তীব্র গরমে হাঁপিয়ে উঠছিলেন তছিরন। মাথায় কয়লার টুকরি নিয়েই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “মরণের আগ পর্যন্ত কাম কইরা যাওন লাগব, কারণ না খায়া মরা বেশি কষ্ট।”
আমিন বাজারেই এক ছেলে, পুত্রবধূ আর এক নাতনিকে নিয়ে সংসার বিধবা তছিরনের। মাদকাসক্ত ছেলের দুর্ঘটনার পর সঞ্চয়ের সবটাই গেছে তার চিকিৎসায়। ঘর ভাড়া বাবদ চার হাজার টাকা আর চড়ামূল্যের বাজারে তিন বেলা খাবার যোগাতেই এখন নাকাল অবস্থা তার।
সংসার কীভাবে চলে- এমন প্রশ্নে হতাশার ছাপ ভেসে ওঠে চোখেমুখে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পোলাডা অসুস্থ। বউয়ের বচ্চাডা ছোড। বউ বাইত থাহে। আমি যাই কামাই, তা দিয়া সংসার চালাই। এই পৃথিবীতে আমাগী দেখার লিইগা কেউ নাই।”
তছিরনের সঙ্গে আলাপের সময় আরেক শ্রমিক ইয়াসমিন আক্তার বলেন, “বুড়ি হইলে কী হইব? উনার হাতেই চলে সংসার। জামাই নাই। পোলাডা ভালা না। তাই এই বয়সেও কাম কইরা খাওন লাগে।
“বেশি করতে পারে না। দিনে ৩০০ এর মত কামায়।”
চলমান দাবদাহের মধ্যে আমিনবাজার কয়লাঘাটে জাহাজ থেকে কয়লা নামাচ্ছিলেন তছিরনের মত অন্য নারীরাও। শিশু সন্তানদের নদী পাড়ে রেখেই কাজ করছিলেন তারা। ঘেমে-নেয়ে একাকার হলেও পুরুষের সঙ্গে সমানতালে চলে তাদের কাজ।
কয়লাঘাটে কথা হয় এমভি খুরশিদা-২ কার্গোর চালক মাইনুদ্দিনের সঙ্গে। শ্রমিকদের ছবি তুলতে দেখে কাছে এসে বলেন, “এই যে আমনেরা আমাগো ছবি তুলেন, ভিডিও করেন। মে দিবস না কী দিবস নিয়াও লেখেন হুনি। কই আমাগো তো একটা টেহা বাড়ে না। আমাগো কি দেহার কেউ আছে? আমরা মইরা গেলেই কার কী আহে যায়?”
কয়লাঘাটের শ্রমিকদের যে ব্যাপক কায়িক পরিশ্রম করতে হয়, সে কথাই জানালেন মাইনুদ্দিন। তার ভাষ্য, “দুই দিন লাগে চট্টগ্রাম থেকে আসতে। এই মালের কাজ করা এত সহজ না। নিয়া আসাও কষ্ট অনেক। আবার আনলোড করাও ঠেলা আছে।”
‘গরমে ৩০০-তে হাঁপায়া যাই’
দেড় বছর ধরে আমিন বাজারের কয়লাঘাটে কাজ করছেন সুনামগঞ্জের ইয়াসমিন আক্তার। জানালেন, শীতে কাজ বেশি করতে পারেন বলে আয়ও হয় বেশি। তবে গরমে প্রাণ যায় অবস্থা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শীতের দিনে (আয়) হাজারের উপরে উঠাইতে পারি। গরমে ৩০০ (টাকা) উঠাইতে হাঁপায়া যাই। আর কয়েকদিন পরে পরে অসুস্থ হইয়া যাই, ওষুধ খাইয়াতো টাকা শ্যাষ হইয়া যায়।”
বছর তিনেক আগে স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ায় এখন দুই মেয়েকে নিয়ে দিনাতিপাত করছেন নুরুন্নাহার আক্তার। সংসার চালাতে কাজ করছেন কয়লাঘাটে। তবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাজে যোগ না দিলেও ঘোরাফেরা করছিলেন কয়লাঘাটেই।
নুরুন্নাহার জানান, ২৯ এপ্রিল কাজ শেষে বাড়ি ফিরেই হঠাৎ জ্বর চলে আসে। সঙ্গে ঠান্ডা-কাশি। এরপর দুদিন কাজে আসতে পারেননি। বৃহস্পতিবার ঘাটে গেলেও কাজ করতে পারেননি।
তার ভাষ্য, “দুই মেয়ের মদ্যে ছোটডারে মাদরাসায় দিছিলাম। আইয়া (উচ্চমাধ্যমিক) পড়ছে। আর বড়ডারে সিক্স পর্যন্ত পড়াইয়া পরে বিয়া দিছি। এখন তারও বাচ্চা হইছে, সে বাচ্চা নিয়া আমার এখানেই থাহে।
“কাম করতে না পারলে সংসার চালাইতে পারি না, আর এখন অসুস্থ হইয়া তিন দিন ধরে কাম করতে পারি না। খুবই কষ্টে আছি। যা কামাই, তা ওষুধেই যায়। কয়েকদিন পরে পরে অসুস্থ হইয়া যাই। জীবনডা খুব কষ্টের।”
এক টুকরি কয়লা ফেললেই একটা করে টালি পান শ্রমিকরা। কয়েনের মত সেই টালি দেওয়ার কাজ করেন বাছিরন আক্তার। তার মজুরি দিনে সাত-আটশ টাকা।
তুলনামূলক পরিশ্রম কম হলেও টানা কাজ করতে বাছিরনকে। বিশ্রামের সুযোগ নেই।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “একটা করে টুকরি ফেললে একটা করে টালি দেই। যার যতক্ষণ কুলায়, ততক্ষণ কাম করে। বেডিরা খুব বেশি কাম করতে পারে না। তারা কাম কইরা আয় করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। আর বেডা মানুষ কাম কইরা আয় করে ৬০০ থেইকা ৮০০ টাকার বেশি “
শীতের তুলনায় গরমে কষ্ট বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, “এই গরমে বইসা থাকলি পরেই তো গা ঘাইমা যা। আর রইদে এইহানে কাম করলে তো শইল জ্বালাপোড়া করে।”
টালি দেওয়া হয় মূলত কোন শ্রমিক কয় টুকরি কয়লা ফেললেন, সেই হিসাব রাখার জন্য। টালি প্রতি বা টুকরি প্রতি শ্রমিকরা পান পাঁচ টাকা। কখনো দর কমেও আসে। এখন মানুষ কম-বেশি বিবেচনায় পাঁচ থেকে সাত টালিতেও ধরা হয় ২০ টাকা।
শ্রমিক মো. মুখলেছুর রহমান বলেন, “গতকাল কাজ করছি ৬০০ টাকার। কিন্তু আজ শরীলে আর কুলায় নাই। দুপুর পর্যন্ত করছি, ৩০০ টাকা পাইছি। জাহাজ আইছে ছয় দিন আগে। ছয় দিন ধরে মাল নামাইতাছি। বছরে ৬ থেকে ৭ মাস কাজ চলে। নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত চলে। আর বাকি সময়ে আমাদের অন্য কাজ করা লাগে।
“এখানে আগে এক থেকে প্রায় ২ হাজার টাকা আয় হত। এখন পাশের সর্দারের কার্গোতে ক্রেন লাগাইছে। ক্রেন দিয়া কয়লা আনলোডের কাজ সারে। এতে আমাদের কাজ কমাইয়া দিছে। তাই আয়ও কমে গেছে।”
‘কলিজাডা শুকাইয়া যায়’
আমিনবাজার কয়লাঘাটে সর্দার আছেন তিনজন। তাদের একজন মজিদ মিয়া বলেন, “কয়লা আনলোডের কাজ সকালে শুরু হয়ে সন্ধ্যায় শেষ হয়। শ্রমিকরা তাদের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করে। কেউ সকালে কিছুক্ষণ কাজ করেই বাদ দেয়, আবার কেউ দুপুর পর্যন্ত করে। আবার কেউ কেউ করে সারা দিন।
“যে যতটুকু কাজ করবে, ততগুলো টালি পাবে। আর টালি অনুযায়ী তাদের টাকা দেওয়া হবে।
টালির দর আগের চেয়ে কমেছে কিনা- জানতে চাইলে মজিদ মিয়া বলেন, “না না, আগের চেয়ে কমানো হয়নি। আগে যা ছিল এখনো তাই আছে।”
শ্রমিক পারভিন আক্তার বলেন, “ছয় টালি ফালাইলি পাই ২০ টাকা। আগে একটার লিগা পাইতাম পাঁচ টাকা। এহন টাকা কমাইয়া দিছে। এই গরমে খুব কষ্ট অয় কাম করতে। কলিজাডা একেবারে শুকাইয়া যায়। পুরা দিন কাম করতে পারি না।”
কয়লা ব্যবসায়ী শরীফা এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, “শ্রমিকের সংখ্যা যখন বেশি থাকে তখন ছয় টালি ২০ টাকা। মাঝে মাঝে এটা সাতেও চলে যায়। আর শ্রমিকের সংখ্যা যদি কম থাকে, তাহলে পাঁচ টালিতে ২০ টাকা পায়।
“শ্রমিকদের এ কাজ খুবই কষ্টের। কয়লা ভর্তি টুকরি ওজন হয় ২৫ থেকে ৩০ কেজি। সেটা কার্গো থেকে মাথায় করে উঠিয়ে এনে ড্রাম ট্রাকে ফেলার কাজটা বেশ পরিশ্রমের।”
শ্রমিকদের অসুস্থার প্রসঙ্গ তুললে সর্দার মজিদ মিয়া বলেন, “আল্লাহর রহমতে অসুস্থ হয় না তারা। আসলে এই কাজ একটু কঠিন হইলেও তারা তো অভ্যস্ত।”