Published : 05 May 2025, 05:01 PM
এক যুগ আগে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছিল, তার অর্ধেক মামলায় পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে অভিযোগের ‘সত্যতা না পাওয়ার’ কথা বলে।
আর এসব চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা পড়েছে গত অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে।
ঢাকার আদালতের প্রসিকিউশন বিভাগের সাধারণ নিবন্ধন শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ওই ঘটনার পর রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, রমনা, শাহবাগ ও যাত্রাবাড়ী থানায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৫১টি মামলা দায়ের হয়।
এর মধ্যে ২৫টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। তদন্তে ‘অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি মর্মে’ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। ২৪ মামলার তদন্ত চলছে। তবে দুই মামলায় স্থগিতাদেশ রয়েছে।
নারী উন্নয়ন নীতি ও শিক্ষা নীতির বিরোধিতা করে ২০১০ সালে গড়ে উঠেছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। তবে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ আন্দোলনের পাল্টায় রাজপথে নেমে সংগঠনটি বেশি পরিচিতি পায়।
শাহবাগের আন্দোলনের বিপরীতে ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলে সমাবেশ ডাকে সংগঠনটি। সেদিন তারা সমাবেশ শেষ করে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শাপলা চত্বরেই অবস্থান নেয়। ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতা শুরু হলে বাণিজ্যিক এলাকা অচল হয়ে পড়ে।
তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সরে যেতে অনুরোধ করে। তবে হেফাজত কর্মীরা নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘাতের মধ্যে মতিঝিল-পল্টন ও আশপাশের এলাকায় সরকারি প্রতিষ্ঠান, যানবাহন, ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরে সেই রাতে যৌথ অভিযান চালিয়ে তাদের মতিঝিল থেকে সরানো হয়।
শাপলা চত্বরের সেই অভিযানে ৬১ জন নিহত হন বলে সে সময় এক প্রতিবেদনে দাবি করে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’। যদিও পুলিশ দাবি করে, রাতের অভিযানে কেউ মারা যাননি, আর দিনভর সংঘাতে নিহতের সংখ্যাটি ১১।
সে সময় সারা দেশে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মোট ৮৩টি মামলা হয়, যার মধ্যে অন্তত ৫১টি মামলা হয় ঢাকায়।
আদালতের জিআরও শাখার তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি মামলা হয় পল্টন মডেল থানায়। মামলার সংখ্যা ৩৬টি। মতিঝিল থানায় দায়ের করা হয় ৬টি মামলা।
আদালতে পল্টন ও মতিঝিল থানার প্রসিকিউশন বিভাগের এসআই মো. রুকনুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পল্টন মডেল থানার ৩৬ মামলার মধ্যে ২২টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। ১৪টি মামলা এখনো তদন্তাধীন।
“মতিঝিল থানার ছয়টি মামলার মধ্যে দুটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। দুটি মামলা তদন্তাধীন এবং দুটি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। যে কয়টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন এসেছে, তা আগের সরকারের পতনের পরই এসেছে।”
শাহবাগ ও রমনা মডেল থানার আদালতের প্রসিকিউশন বিভাগের সাব-ইন্সপেক্টর জিন্নাত আলী বলেন, শাহবাগ থানায় চারটি মামলা হয়। চারটিরই তদন্ত চলছে। রমনা মডেল থানার
দুই মামলার মধ্যে একটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে। অপরটি তদন্তাধীন।
এছাড়া যাত্রাবাড়ী থানায় তিনটি মামলা হয়েছিল সে সময়। সেগুলোর তদন্ত এখনো শেষ হয়নি বলে জিআরও শাখার কর্মকর্তকাদের ভাষ্য।
মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “শাপলা চত্বরের ঘটনার মামলাগুলো রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় অর্ধেক মামলায় তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ।
“পরে আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। এখনো কিছু মামলা তদন্তধীন। সেগুলো তদন্ত সাপেক্ষে নিষ্পত্তি করা হবে।”
এসব মামলার অন্যতম আসামি হেফাজতে ইসলামীর যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেসবাহ বলেন, “সেদিন (২০১৩ সালের ৫ মে) ন্যায্য দাবি আদায়ে আলেমরা মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিল। তবে সরকার রাতের আঁধারে নিরীহ-নিরস্ত্র আলেমদের সরিয়ে দিতে নৃশংসপন্থা অবলম্বন করেছিল।
“তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে, গ্রেপ্তার করেছে। সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী যা করেছে, তা কোনোভাবেই সঠিক ছিল না। জুলাই বিপ্লবের পর এসব মামলা শেষ হওয়া উচিত ছিল। এসব মামলা থেকে আলেমদের দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে অন্তবর্তী সরকার– এমনটাই আশা করছি।”
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে।
মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে ‘গণহত্যার’ অভিযোগেও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে বাংলাদেশ পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী ঢাকার হাকিম আদালতে একটি মামলা করেন। আদালত মামলাটি তদন্ত করে মতিঝিল থানা পুলিশকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে।
আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্য মামলাটি করেছে হেফাজতে ইসলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে সেখানে।