টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের একটি সংক্ষিপ্তসার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস হাতে পেয়েছেন।
Published : 31 Jan 2025, 12:52 AM
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে আর্থিক অনিয়মের জন্য আলোচিত ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার সুপারিশ এসেছে বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে।
একটি শক্তিশালী সুবিধাভোগী গোষ্ঠী দশক ধরে ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল করে রেখেছে তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “এই প্রভাব দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া প্রয়োজন।
“কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে একাধিক বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকানা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। রাজনৈতিক কারণে নতুন ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করতে হবে এবং দুর্বলভাবে পরিচালিত ব্যাংকগুলোর জন্য একটি এক্সিট পলিসি প্রণয়ন করা প্রয়োজন।”
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের একটি সংক্ষিপ্তসার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস হাতে পেয়েছেন।
শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করেন বলে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।
পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণের কথা সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটি কৌশলগত কাঠামো উপস্থাপন করে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা অর্জনে সাহায্য করবে।
জনসেবার অদক্ষতা এবং পরিবেশগত উদ্বেগ বিবেচনায় নিয়ে, লক্ষ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যা স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়।
ক্ষমতার পালাবদলের আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে একের পর এক অনিয়ম, জালিয়াতি ও প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে বিদেশে পাচার করার তথ্য তুলে ধরা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।
এসব তথ্য প্রকাশ হতে থাকলে গ্রাহক সেসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এতে কিছু ব্যাংকের হাড্ডিসার খোলস বেরিয়ে আসে।
আওয়ামী লীগ সুবিধা পেয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা শিল্পগোষ্ঠী ও প্রতাপশালী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকের দুদর্শার চিত্র বেরিয়ে আসতে থাকায় ব্যাংক খাত নিয়ে সব শ্রেণি পেশার গ্রাহকের মধ্যে ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক খাত নিয়ে সংশয় তৈরি হয়; সাধারণের মধ্যে ছড়ায় ভীতি।
দেশের অথনীতির হালচাল জানতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার শাসনামলের দুর্নীতি, লুণ্ঠন এবং ভয়ংকর রকমের আর্থিক কারচুপির চিত্র উঠেছে, যেখানে বলা হয়েছে অন্তত ১০টি ব্যাংক দেউলিয়ার হওয়ার পথে রয়েছে।
এছাড়া বিগত সরকারের সময় স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন খাতে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ছিল আলোচিত।
শেখ হাসিনার পতনের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গত ১০ সেপ্টেম্বর এই টাস্কফোর্স গঠন করে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদকে ১২ সদস্যের এই টাস্কফোর্সে সভাপতি করা হয়। সদস্য সচিব হন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ) মো. কাউসার আহাম্মদ।
সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা আখতার মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান, কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের সাবেক গবেষণা বিভাগের প্রধান আবদুর রাজ্জাক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুশফিক মোবারক।
আরও আছেন বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক, এমসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট নাসিম মনজুর, বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হেসেন, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ও বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর।
ন্যায্য, টেকসই ও গতিশীল অর্থনীতির ভিত তৈরিতে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির তিন মাসের মধ্যে প্রাথমিক পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরির কথা ছিল। সেই প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া হল।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদেনে ব্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন খাতে সংস্কারের সুপারিশ এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে- সরকারি হাসপাতাল সংস্কার, গ্রামীণ স্কুল ও ক্লিনিক সংস্কার, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সংস্কার, বুড়িগঙ্গা নদীর পুনরুজ্জীবন, একটি মন্ত্রণালয় সংস্কার।
ঢাকার একটি নির্দিষ্ট সরকারি হাসপাতালকে বেছে নিয়ে ব্যাপক সংস্কার করার সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ উদ্যোগের আওতায় হাসপাতাল পরিচালনার জন্য সাধারণ প্রশাসকদের পরিবর্তে যোগ্য হাসপাতাল প্রশাসক নিয়োগ এবং একটি নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে। একই সঙ্গে রিয়েল-টাইম মনিটরিং ড্যাশবোর্ড চালু করা হবে, যাতে ব্যবহারকারীদের অভিযোগ সংগ্রহ করা যায় এবং যুব ও নাগরিক গোষ্ঠীগুলো অনলাইনে প্রধান কার্যকরী সূচকগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
বুড়িগঙ্গা নদীর পুনরুজ্জীবন নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গা নদী বিলুপ্তির পথে, যা ঢাকা শহরের জন্য মারাত্মক হুমকি। সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং প্রয়োজনে জরুরি আইন প্রণয়ন করতে হবে।
এ প্রকল্পের নেতৃত্বে একজন বিশেষ মন্ত্রী বা উপদেষ্টার থাকার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীদের সহায়তায় কাজ করবেন। যেহেতু এখানে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর বাধা আসতে পারে, তাই আইনিভাবে সুরক্ষা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়কে পরীক্ষামূলকভাবে বেছে নিয়ে কর্মক্ষমতা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স, যাতে বিভিন্ন প্রকল্প ও কার্যক্রমের অগ্রগতি সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায়। এটি সরকারি কার্যকারিতা বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে টাস্কফোর্স মনে করছে।
নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনের কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি বিশ্বমানের শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ বিমান পুনর্মূল্যায়ন, সামাজিক ও আচরণগত পরিবর্তন যোগাযোগ ও গবেষণা কেন্দ্র, নিয়ন্ত্রক সংস্কার কমিশন গঠন।
বাংলাদেশ বিমান পুনর্মূল্যায়নের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- জাতীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমান উড়োজাহাজ পরিচালনার আধুনিক মানদণ্ড অনুসরণে ব্যর্থ হয়েছে। তাই, বিমানকে কর্মক্ষমতা নির্ভর লক্ষ্যমাত্রায় পরিচালিত করতে হবে। যদি বিমান বারবার ব্যর্থ হয়, তাহলে তার অর্ধেক সম্পদ ব্যবহার করে ‘বাংলাদেশ এয়ারওয়েজ’ নামে আপতত একটি নতুন সংস্থা তৈরি করা যেতে পারে, যা বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা দ্বারা পরিচালিত হবে।
সামাজিক ও আচরণগত পরিবর্তন যোগাযোগ ও গবেষণা কেন্দ্র (সিএসবিসিসিঅ্যান্ডআর) প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে বলা হয়েছে- বর্তমানে বিভিন্ন দপ্তরের বিচ্ছিন্ন প্রচার কার্যক্রমের পরিবর্তে একটি কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠান দরকার, যা গবেষণাভিত্তিক আধুনিক যোগাযোগ কৌশল তৈরি করবে এবং সামাজিক পরিবর্তনে অবদান রাখবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্কার কমিশন (আরআরসি) গঠনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ব্যবসা ও বিনিয়োগে অনাবশ্যক বিধিনিষেধ এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানোর জন্য একটি নিরীক্ষা কমিশন প্রয়োজন, যা নিয়মিতভাবে নীতিমালা পর্যালোচনা করবে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ দেবে।
শহুরে পরিবহন উদ্যোগের বিষয়েও সুপারিশ এসেছে টাস্কফোর্সের কাছ থেকে। এ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে- স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ও একক পরিচালনাধীন বাস পরিষেবা চালু করা।
শিল্প, বিনিয়োগ ও রপ্তানিখাতেও বেশ কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছে টাস্কফোর্স। তার মধ্যে শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারকদের সহযোগিতা, ওয়ান-স্টপ সার্ভিস উন্নয়ন, স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) উৎসাহিত করা, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় বিদেশি বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক কূটনীতি ও শ্রম রপ্তানি উল্লেখযোগ্য।
শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারকদের সহযোগিতায় ‘চেরি-পিকিং উইনার্স’ মডেল ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোম্পানির মধ্যে সম্ভাবনাময় রপ্তানিকারকদের চিহ্নিত করে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা দরকার, যাতে তৈরি পোশাকের বাইরেও নতুন শিল্প গড়ে ওঠে।
স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় চিকিৎসার বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবার জরুরি প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কার্যকরভাবে এ প্রয়োজনীয়তা মেটাতে টারসিয়ারি বা তৃতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্য খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করা দরকার।
অর্থনৈতিক কূটনীতি ও শ্রম রপ্তানির বিষয়ক সুপারিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য নতুন বাজার খুঁজতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, কৌশলগত প্রচারাভিযান ও সাংস্কৃতিক রপ্তানি বাড়ানো প্রয়োজন।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগের মধ্যে ডিজিটাল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, পরিকল্পনা প্রক্রিয়ার সংস্কার, প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, নেতৃত্বের পেশাদারীকরণ, প্রতিদিনের চাঁদাবাজি প্রতিরোধ, সরকারের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, জাতীয় পরিচয়পত্রভিত্তিক উন্মুক্তে ডেট প্ল্যাটফর্ম, জরুরি মজুদ ব্যবস্থা গঠন, ব্যাংক খাত থেকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অপসারণ উল্লেখযোগ্য।
প্রতিদিনের চাঁদাবাজি প্রতিরোধ বিষয়ে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ট্রেনের টিকিট কেনা বা পাসপোর্ট সংগ্রহের মত সাধারণ নাগরিক সেবাগুলো পেতে জনগণকে নিয়মিত চাঁদাবাজির সম্মুখীন হতে হয়। এই সমস্যা কেবল সরকারি সেবাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাজার, পরিবহন ও নির্মাণ খাতেও এটি গভীরভাবে প্রোথিত। চাঁদাবাজি দমনের জন্য একটি স্বাধীন ‘অ্যান্টি-গুণ্ডা স্কোয়াড’ গঠন করা যেতে পারে, যা হয় সরকারি পর্যায়ে পরিচালিত হবে বা কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে। এই স্কোয়াডের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে নাগরিক ও যুব সমাজের নজরদারির ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
সরকারের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির অংশে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকাণ্ডে ব্যাপক অদক্ষতা ও অপচয়ের অভিযোগ রয়েছে। কর্মদক্ষতা বাড়াতে কাগজবিহীন অফিস ব্যবস্থা চালু করা, আনুষ্ঠানিকতা ও প্রটোকল সংক্রান্ত অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো, অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ এড়ানো এবং অতি-প্রশাসনিক সভার সংখ্যা হ্রাস করা যেতে পারে। এসব ক্ষুদ্র পরিবর্তন একত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছে টাস্কফোর্স।
জরুরি মজুদ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্যশস্যের মজুদ রাখে। এই উদ্যোগ সম্প্রসারিত করে ডিজেল, সার ও ভোজ্যতেলের মত জরুরি পণ্যও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যেগুলোর দাম ও সরবরাহ বৈশ্বিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। দীর্ঘমেয়াদে সৌর ও বায়ু শক্তির মত বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হলেও, দেশীয় মজুদ ব্যবস্থা স্বল্পমেয়াদে স্থিতিশীলতা আনতে পারে।
এছাড়া আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে পরিত্যক্ত ভূমি সৌরবিদ্যুতের জন্য ব্যবহার, বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার, বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ, সরকারি সেবার কল সেন্টার একীভূতকরণ, ‘ঢাকা হাট’ প্রতিষ্ঠা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প পুনঃশ্রেণীবিন্যাস উল্লেখযোগ্য।
বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান গ্যাস সংকট মোকাবিলার সহজতম উপায় হল বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রের পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান ও উত্তোলন। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) স্বল্প ব্যয়ে এই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে, যা আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেবে এবং জ্বালানি স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্মাণ খাতে বালুর চাহিদা ব্যাপক হলেও এর অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনের ফলে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ২০১০ সালের ‘বালুমহাল আইন’ থাকা সত্ত্বেও নদী, আবাসিক এলাকা ও চা বাগানে অবৈধ বালু উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে।
সরকারকে অবশ্যই বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারিত বালু উত্তোলন ক্ষেত্র চিহ্নিত করে কঠোর নিয়মনীতি বাস্তবায়ন করতে হবে বলে টাস্ক ফোর্স বলেছে।
সরকারি সেবার কল সেন্টার একীভূতকরণ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে সরকারি সেবার জন্য বিভিন্ন কল সেন্টার নম্বর থাকায় নাগরিকদের বিভ্রান্তি ও সময় অপচয় হয়। এটি দূর করতে একটি সাধারণ কল সেন্টার নম্বর (সাধারণ সেবা) এবং একটি জরুরি নম্বর চালু করা যেতে পারে। এছাড়া, এআই প্রযুক্তি সংযুক্ত করলে সেবার গতি ও কার্যকারিতা আরও বাড়বে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব কর্মপরিকল্পনা ও সুপারিশগুলো অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য একটি প্রাথমিক রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে, যা জনগণের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল একটি রূপান্তরিত বাংলাদেশের স্বপ্নকে প্রতিফলিত করে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুশাসনের মত গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে কার্যকর প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবে এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় গতি সঞ্চার করতে সক্ষম হবে।
টাস্কফোর্স বলেছে, এই সুপারিশগুলো সরকারের নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে যৌথ দায়িত্ববোধের আহ্বান জানায়, যাতে একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যায়। দক্ষ নেতৃত্ব ও সুপরিকল্পিত কৌশলের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার চ্যালেঞ্জগুলোকে সুযোগে পরিণত করতে পারবে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ, ন্যায়সঙ্গত ও স্থিতিশীল জাতি গঠনে সফল হবে বলে প্রতিবেদনে আশাবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যহীন উন্নয়নের ভিত তৈরিতে টাস্কফোর্স গঠন
ব্যাংক খাতে ‘ব্ল্যাকহোল’, ১০ ব্যাংক ‘ভেতরে ভেতরে দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে’: শ্বেতপত্র