অবরুদ্ধ থাকার সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর রাত ৮টায় মহাখালী থেকে কমলাপুর ও বিমানবন্দরের উদ্দেশে দুটি ট্রেন ছেড়ে যেতে দেখা যায়।
Published : 16 Jul 2024, 08:59 PM
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রেললাইন অবরোধ করায় রাজধানীর সঙ্গে সব রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল দুপুরের পর থেকে, এতে দুর্ভোগে পড়েন দূরযাত্রার যাত্রীরা।
মঙ্গলবার ঢাকার বাইরেও গাজীপুর, চট্টগ্রাম, ফেনী, ময়মনসিংহ ও রংপুরে রেলপথ অবরোধ করার খবর এসেছে। এ দিন দুপুরের পর ঢাকা থেকে যেমন কোনো ট্রেন বের হতে পারেনি, তেমনি ঢাকাও প্রবেশ করতে পারেনি।
অবরুদ্ধ থাকার সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর রাত ৮টায় মহাখালী থেকে কমলাপুর ও বিমানবন্দরের উদ্দেশে দুটি ট্রেন ছেড়ে যেতে দেখা যায়।
এর আধা ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ৮টায় মহাখালীর রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান জহিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকা থেকে তিনটি ট্রেন ছেড়ে গেছে, প্রবেশেও করেছে তিনটি।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. আনোয়ার হোসেন, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মাহমুদুল হাসান ও জয়দেবপুর জংশনের মাস্টার মো. হানিফ মিয়া এবং বিভিন্ন স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সঙ্গে কথা হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে মঙ্গলবার তৃতীয় দিনের মত দেশজুড়ে কর্মসূচি পালন করছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামা ছাত্রলীগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মোতায়েন নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে।
মঙ্গলবার বেলা দেড়টায় মহাখালীতে রেললাইন অবরোধ করে কোটাবিরোধীরা। এটি ঢাকার সঙ্গে ট্রেন চলাচলের প্রধান রুট। এ সময় ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী বনলতা এক্সপ্রেস এবং রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেন আটকে পড়ে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত মহাখালী রেলক্রসিং এলাকায় পুলিশের সঙ্গে কোটাবিরোধীদের সংঘর্ষ চলতে দেখা যায়। সেই থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সেখানে ট্রেন আটকে ছিল।
সংশ্লিষ্ট স্টেশন মাস্টাররা বলেছেন, রাত ৮টায় মহাখালী থেকে একটি ট্রেন কমলাপুর, আরেকটি বিমানবন্দর স্টেশনের উদ্দেশে ছেড়ে এসেছে।
মহাখালীতে অবরোধে ট্রেন আটকে পড়া যাত্রীদের অনেককে সেখানে নেমে যেতে দেখা যায়। শিশু, নারী, বয়স্ক যাত্রীদের ট্রেনেই অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
রাজশাহী থেকে সিল্কসিটি এক্সপ্রেসে ঢাকায় আসা আবদুর রহমান নামে এক যাত্রী বিকাল ৪টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কমলাপুর নেমে আমি খিলগাঁওয়ে যাব। আমি একা হলে হেঁটে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু রাস্তায়ও গাড়ি চলছে না। এ অবস্থায় আমার সঙ্গে যারা আছে, তাদের নিয়ে যাওয়া কঠিন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখি কী হয়, না হলে সবাইকে নিয়ে হেঁটেই যেতে হবে।”
শেষ পর্যন্ত আবদুর রহমান কী করেছেন, তা আর জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
ঢাকার কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশনে শতশত যাত্রী ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন। ট্রেন ছাড়া না-ছাড়া নিয়ে তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছিল।
ঢাকার কমলাপুর থেকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে যাবেন রুখসানা সুলতানা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বেলা ২টা ৫০ মিনিটের সিলেটগামী কালনী এক্সপ্রেস ট্রেন ধরার কথা ছিল তার। রাত পৌনে ৭টায়ও স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।
“ট্রেন ধরার জন্য বেলা দেড়টার দিকে এখানে আসি। ট্রেনটি প্ল্যাটফর্মে এসেছে, কিন্তু ছেড়ে যাচ্ছে না। স্টেশন থেকে একবার বলেছিল ৬টার পর ছেড়ে যাবে, কিন্তু এখনও ছাড়ার কোনো লক্ষণ নেই।”
রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত যে তিনটি ট্রেন ছেড়ে গেছে, তার মধ্যে রুখসানার ট্রেনটি আছে কিনা, জানা যায়নি।
কমলাপুরের স্টেশন মাস্টার মো. আনোয়ার হোসেন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ট্রেন লাইন ক্লিয়ার না হওয়ায় ট্রেন ছাড়া যাচ্ছে না। আমাদের এখানে ট্রেনের জন্য অনেক মানুষ অপেক্ষা করছেন। ট্রেন ছাড়া নিয়ে এখনও আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
বিমানবন্দর স্টেশনে ট্রেনের জন্য যাত্রীদের ব্যাপক ভিড়ের তথ্য দিয়ে স্টেশন মাস্টার মাহমুদুল হাসান সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “দুপুরের পর থেকে কোনো ট্রেন আসছে না, যাচ্ছেও না। এখানে শতশত যাত্রী ট্রেনের অপেক্ষায় আছেন। স্টেশনে পা ফেলার জায়গা নেই।”
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ এনে এর প্রতিবাদে গাজীপুরের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ ও মিছিল করেছে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
বেলা ৩টার দিকে গাজীপুর শহরের শিমুলতলী রোডে তিতাস গ্যাস অফিসের পাশে ঢাকাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনটি আটকা পড়ে। সন্ধ্যা ৬টায়ও সেটি ঢাকার দিকে ছেড়ে আসেনি।
জয়দেবপুর জংশনের মাস্টার মো. হানিফ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভারত থেকে ঢাকাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস গাজীপুর শহরের অদূরে তিতাস রেল ক্রসিংয়ের পাশে আটকা রয়েছে।
“জানতে পেরেছি ট্রেনটি ৩টা ২৭ মিনিটে কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক স্টেশন অতিক্রম করে। সেখান থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে জয়দেবপুর জাংশন অতিক্রম করতে ১৫ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু সন্ধ্যা ৬টার দিকেও সেই ট্রেন জয়দেবপুর জংশনের অতিক্রম করেনি।”
ট্রেন চলাচল কখন স্বাভাবিক হতে পারে- এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত হোসেনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।
পূর্বাপর
২০১৮ সালের পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। সেই আবেদনের চূড়ান্ত শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাই কোর্ট বেঞ্চ কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল গত ৫ জুন।
সেই রায়ের অপারেটিভ বা বাস্তবায়নের অংশ প্রকাশিত হয় গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়।
তার আগের দিন বুধবার কোটার বিরোধিতায় আন্দোলনের মধ্যে সব পক্ষকে চার সপ্তাহ স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দেয় আপিল বিভাগ।
কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত ওইদিন বলেছে, কোটা নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে আপিল বিভাগ আবার বিষয়টি শুনবে। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ৭ অগাস্ট।
হাই কোর্টের আংশিক প্রকাশিত রায়ে বলা হয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সব কোটা বাতিল করে যে ২০১৮ সালে যে পরিপত্র সরকার জারি করেছিল, তা ‘অবৈধ এবং আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত’।
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য যে কোটা সরকার বাতিল করেছিল, তা পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয় রায়ে। সেই সঙ্গে জেলা কোটা, নারী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা এবং উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও জাতিগোষ্ঠীর জন্যও কোটা বহাল করতে হবে।
এই রায় পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে কোটা পুনর্বহালে আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারকে নির্দেশ দেয় আদালত।
সেই সঙ্গে হাই কোর্ট বলেছে, সরকার যদি ওইসব কোটার শতকরা হার বা অনুপাত বাড়াতে, কমাতে বা পরিবর্তন করতে চায়, এই রায় সেক্ষেত্রে কোনো বাধা হবে না।
পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে কোনো নির্ধারিত কোটা পূরণ না হলে সরকার মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ দিয়ে সেই পদ পূরণ করতে পারবে।
হাই কোর্টের রায়ের পর থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে আন্দোলনে নামেন চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা। প্রথম কয়েক দিন মিছিল, মানববন্ধনের মত কর্মসূচি থাকলেও গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয় তাদের অবরোধ কর্মসূচি, যার নাম তারা দিয়েছে ‘বাংলা ব্লকেড’।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে আন্দোলনকারীরা শুরুতে চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ করলেও এখন তাদের দাবি এক দফায় এসে ঠেকেছে।
তাদের দাবি হল- সব গ্রেডে সব ধরনের ‘অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক’ কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ‘ন্যূনতম পর্যায়ে’ এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংশোধন করতে হবে৷
আন্দোলনের অংশ হিসেবে রোববার গণপদযাত্রা কর্মসূচি পালন ও রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। পরে তারা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন।
ওইদিনই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে।
বক্তব্যের এক পর্যায়ে সরকারপ্রধান বলেন, “কোটা আন্দোলন করার আগে তো তাদের রেজাল্টগুলো দেখা উচিত ছিল যে- কোথায় তারা দাঁড়িয়েছে! দ্বিতীয়টি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরি) পাবে?”
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে ‘মর্মাহত’ হয়ে রোববার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষালয়ে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ দেখান; যেখানে স্লোগান দেওয়া হয়, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছ, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’।
শিক্ষার্থীদের এমন স্লোগান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা মধ্যে সোমবার দফায় দফায় সংঘাত হয়েছে, আহত হয়েছেন প্রায় তিনশ জন। পরদিন মঙ্গলবার সংঘর্ষের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে পাঁচজনের প্রাণহানির খবর মিলেছে।