২০১৫ সালে এই ধারণা নিয়ে আসে দুই সিটি করপোরেশন। সাড়া না পেয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি বাদ দেয় ২০২১ সালে। এবার কেবল মিরপুরে একটি ওয়ার্ডে এই ব্যবস্থা করেছে ঢাকা উত্তর।
Published : 17 Jun 2024, 12:24 AM
বর্ষায় পশু কোরবানির বিপত্তি কী হতে পারে, তা দেখা গেছে ২০১৬ সালে। সে বছর ঈদের দিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরেছিল, জলমগ্ন হয়ে যায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। এর মধ্যেই কোরবানির পর রক্তে ভেসে যায় চার পাশ।
কেবল রক্ত নয়, যেখানে সেখানে কোরবানির কারণে বর্জ্য অপসারণও কঠিন হয়ে যায়। আবার পশুর বর্জ্য পরিষ্কারে পানি ঢালার পর তা চাপ ফেলে নগরীর নিষ্কাষণ ব্যবস্থায়, এটি পরে বিপত্তির আরেক কারণ হয়।
এই সমস্যা থেকে উত্তরণে নগরবাসীকে প্রায় এক দশক ধরে নির্ধারিত স্থানে কোরবানি দিতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল নগর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মানুষ রাজি নয়, তাই ক্ষ্যান্ত দিয়েছে তারা।
২০১৫ সালে নির্দিষ্ট স্থানে পশু কোরবানির ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। শুরুতে নগরবাসীর খুব একটা সাড়া না পেলেও প্রত্যাশা ছিল বছর গড়ালে বাড়বে আগ্রহ। কিন্তু তা আর হয়নি।
২০২১ সালে নির্ধারিত স্থানে পশু জবাইয়ের ধারণা থেকে সরে আসে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এ বছর উত্তর সিটি করপোরেশনও নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাইয়ের উদ্যোগ থেকে বেরিয়ে এসেছে।
তবে এবার সীমিত পরিসরে দুয়েকটি মহল্লায় রাখা হয়েছে এই ব্যবস্থা। সেখানে মহল্লাবাসীর সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করে তাদের পশু কোরবানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্ধারিত স্থানে পশু জবাইয়ের জন্য এ বছর ডিএনসিসি কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এর মূল কারণ, মানুষের অনাগ্রহ।
“মানুষ আসলে নিজের বাসাবাড়ির সামনে, গ্যারেজে বা সুবিধাজনক জায়গায় কোরবানি দিতে চায়। এর আগে সিটি করপোরেশন জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সেখানে প্যান্ডেল টানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। পরে দেখা গেল, সিটি করপোরেশনের এই ব্যয় কাজে আসছে না। তাই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে।”
তবে ৩ নম্বর ওয়ার্ড মিরপুরে উদ্ধার হওয়া প্যারিস রোড সংলগ্ন খেলার মাঠে ওই এলাকার প্রায় ৫০০ গরু জবাই করার পরিকল্পনা করেছে উত্তর সিটি। এই কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন মেয়র আতিকুল ইসলাম।
কেন নির্ধারিত জায়গায় পশু কোরবানি বাদ দেওয়া হল? এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “আসলে নিয়ম ভাঙতে ভাঙতে আমরা অভ্যস্ত। আমাকে বদলাতে হলে সময় লাগবে। তবে আগের থেকে আমার এলাকার এখন অন্তত ৭০ ভাগ বেশি পরিচ্ছন্ন থাকে। বাকি ৩০ ভাগও এক সময় হয়ে যাবে সহযোগিতা পেলে।"
প্যারিস রোডের খেলার মাঠে জবাইয়ের ব্যবস্থা এ জন্যই করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখানে ফ্যানের ব্যবস্থা করেছি; প্যান্ডেল টানানো হবে; পানি থেকে শুরু করে সব ব্যবস্থা থাকবে। গরু প্রতি এক হাজার টাকা করে আমরা দেব।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১২ নম্বর ওয়ার্ডের (মালিবাগ, বকশীবাগ, গুলবাগ এলাকা) কাউন্সিলর খ ম মামুন রশিদ শুভ্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এর আগে জায়গা নির্ধারণ করে, প্যান্ডেল টানিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এসব জায়গায় মানুষ আসে না। হাতে গোনা দুই চারটা গরু জবাই হইছে।
“এটা আসলে একটা সামাজিকতার অংশ হয়ে গেছে। মানুষ বাসা বাড়ির সামনে কোরবানি দেয়। তাছাড়া এসব স্থান থেকে মাংস কেটে নিয়ে যাওয়াও অসুবিধা মনে করে। এ জন্যই আসলে আমরা এ উদ্যোগ থেকে সরে এসেছি।”
সিটি করপোরেশন কিন্তু কিছু কিছু ওয়ার্ডে জবাইয়ের পর নিজ খরচে মাংস পাঠিয়ে দিত বাসায়, যেটি এবার মিরপুরে করা হচ্ছে।
আপত্তি কোথায়
রাজধানীর মহাখালী দক্ষিণপাড়া এলাকার বাসিন্দা শিহাবুল ইসলাম। নিজের বাসার সামনেই এবার কোরবানি দেবেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ বছর তো আর জায়গা নির্ধারণ করা নাই। এর আগের বার যখন নির্ধারিত ছিল, তখন ওই জায়গায় গিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা লাগছে, জায়গাটা ছোটো। তাই ওই চিন্তা বাদ।”
মগবাজার এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন। কোরবানির ঈদ ঢাকাতেই কাটান। তিনি বললেন, “আমার ফ্যামিলিতে আমি ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক কেউ নেই। এখন নির্ধারিত জায়গায় যদি কোরবানি দিই, সে জায়গা থেকে মাংসটা ক্যারি করে আনতে অনেক কষ্ট। তাই বাসার পাশেই দিই। তবে আমরা জায়গাটা ভালোভাবে পরিষ্কার করে দিই।”
ওয়ারী এলাকার বাসিন্দা আবু জাফর আহমেদ বলেন, “কোরবানির সময় বাড়ির বাচ্চাকাচ্চা আছে, ওরা জবাই বা মাংস কাটা দেখতে চায়। আনন্দ পায়। ফ্যামিলির লোকজনও চায় যে বাসার সামনে হলে, একটু দেখল, বা এটা-ওটা করতে হাত লাগাল।
“কোরবানি তো আসলে একটা উৎসব, আনন্দের উপলক্ষ। নির্ধারিত কোনো স্থানে দিলে সেই আনন্দ বা পারিবারিক আবহটা থাকে না। সারা বছর তো আর কোরবানি দিই না।”
নগর পরিকল্পনাবিদ কী বলছেন
সক্ষমতা কম থাকায় নির্ধারিত স্থানে পশু জবাইয়ের বিষয়টি উঠে গেছে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান। সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে বর্জ্য জমানোর তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আদিল বলেন, “ঢাকায় যে হারে পশু কোরবানি হয় সে অনুযায়ী ক্যাপাসিটি কম। ফলে ওই উদ্যোগ টেকেনি। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনও মানুষকে বাধ্য করতে পারেনি।
“আরেকটি বিষয় হল, কোরবানির সঙ্গে আমাদের রীতির একটা ব্যাপার আছে। এর অংশ হিসেবে নিজের ছেলেপুলে বা পরিবার পরিজনের সামনে কোরবানি দিতেই মানুষ পছন্দ করে। এখানে আসলে বাধ্য করেও কতখানি কাজ হবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।”
এলাকাভিত্তিক পর্যাপ্ত আধুনিক পশু জবাইখানা তৈরি করতে পারলে মানুষকে সেখানে পশু নিয়ে যেতে উৎসাহী করা যাবে বলে মনে করছেন তিনি। সেই সঙ্গে নালা বা যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেললে জরিমানার ব্যবস্থা করার তাগিদ দিয়েছেন। বলেছেন, এসব সমন্বয় করতে পারলে তবেই সুফল মিলবে।
আধুনিক জবাইখানা আর কবে
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন মিলে পশু জবাইখানা রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে তিনটিই বন্ধ। যে দুটি চালু রয়েছে সেগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। ফলে আধুনিক জবাইখানা এখনো কেবল ঘোষণা হয়েই আছে।
মোহাম্মদপুর এলাকায় কৃষি মার্কেটের পাশে ডিএনসিসির পশু জবাইখানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে স্যাঁতসেঁতে মেঝে, এক পাশে পানির চৌবাচ্চা। অন্য পাশে জমাট রক্ত আর আবর্জনায় ভরা ড্রেন। জবাই করা গরু-ছাগলের চামড়াও পড়ে থাকতে দেখা গেল। দুর্গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার দশা।
মিরপুর-১১ এর নিউ মার্কেট সোসাইটি মার্কেটে ডিএনসিসির জবাইখানার অবস্থাও একই রকম।
মহাখালীতে আরেকটি জবাইখানা থাকলেও সেটি অচল।
দক্ষিণ সিটির আওতাধীন হাজারীবাগের গজমহল ও কাপ্তানবাজারে দুটি জবাইখানা নির্মাণ করলেও সেগুলো এখনও চালু হয়নি।
কবে চালু হবে- এই প্রশ্নে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ইজারা আহ্বান করেছি। ইজারাদার পেলে সেগুলো চালু হবে।”
দক্ষিণের জবাইখানাগুলোর উদাহরণ টেনে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আধুনিক জবাইখানা নির্মাণের চেয়েও এটাকে মানুষের মধ্যে পপুলার করাটা বেশি জরুরি। আমাদের যেগুলো এখন আছে, সেখানে আমাদের ভেটেরিয়ান যায় প্রতি মাসে একবার। আমরাও তদারকি করি।
“আর আমরা দেশের বড়ো একটা মাংস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ঘুরে এসেছি, যাদের আধুনিক জবাইখানা আছে। আমরা একটা আধুনিক জবাইখানা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রাথমিকভাবে।”
নোংরা পরিবেশে পশু জবাই করলে যে মারাত্মক স্বাস্থঝুঁকি থাকে, সে কথা তুলে ধরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নোংরা পরিবেশে পশু জবাই করলে তার থেকে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ হতে পারে। এর বাইরে ডায়রিয়া, জন্ডিস হতে পারে। নোংরা পরিবেশ থেকে যক্ষ্মার জীবাণুও মাংসে লেগে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে৷”
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (এলডিডিপি) প্রধান কারিগরি সমন্বয়ক গোলাম রব্বানী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকার বাইরে খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ১৩টি আধুনিক পশু জবাইখানা নির্মাণের কাজ চলছে। আরও পাঁচটি নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।”