দ্রুততার সঙ্গে আইন সংশোধন না করে কীভাবে ধর্ষণ বন্ধ করা যায়; দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করা যায় সেদিকে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন একজন।
Published : 21 Mar 2025, 02:14 AM
অল্প কিছুদিনের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্যে চার বছরের মাথায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনের যে অনুমোদন মিলেছে উপদেষ্টা পরিষদে তাতে ‘তাড়াহুড়ো’ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইন সংশোধনের এ সুযোগকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগানোর কথা বলেন তারা। সংশোধিত এ আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কিছু বাধা চিহ্নিত করেছেন তারা।
শিশু ধর্ষণের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে যে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা আইনে যোগ করা হচ্ছে সেটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও কার্যকরভাবে তৈরি করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন একজন।
অপরদিকে নারী নির্যাতনের বিদ্যমান ট্রাইব্যুনাল বিচারক না থাকা, তদন্তে ধীরগতির দিকে মনোযোগ দেওয়ার তাগিদ দিয়ে একজন বলেন, “পুলিশের হিসাবেই হাজার হাজার কেইস পরে আছে…কাজেই সেদিক থেকে ট্রাইব্যুনাল শুধু করলেই হবে না, সেটাকে ফাংশনিং করতে হবে। সেটা হচ্ছে মূল কাজ।”
তার মতে, আইনের সঙ্গে যারা জড়িত আছে তাদের আরও জেন্ডার সংবেদনশীল করা এবং ৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত না হলে সেক্ষেত্রে কী হবে তার একটা স্পষ্ট নির্দেশনা থাকার কথা বলেছেন তিনি।
দ্রুততার সঙ্গে আইন সংশোধন না করে কীভাবে ধর্ষণ বন্ধ করা যায়; দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করা যায় সেদিকে জোর দেওয়ার পরামর্শ এসেছে আরেকজনের কাছ থেকে।
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় নারী ও শিশু নির্যাতনের সংশোধিত আইন অনুমোদন পেয়েছে। এরপর অধ্যাদেশ এটি জারি করলে তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
সংশোধিত আইনে বিয়ের প্রলোভনে তৈরি যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে না; বলাৎকার ধর্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবে; ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে আনার পাশাপাশি শিশু ধর্ষণ ও বলাৎকারের দ্রুত বিচার নিশ্চিতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার ধারা যোগ করা হয়েছে।
অনুমোদন পাওয়া খসড়া অনুযায়ী, প্রেমের সম্পর্ক থাকার সময় বিয়ের প্রতিশ্রুতি বা প্রতারণার মাধ্যমে কারও সঙ্গে যৌনকর্ম করলে তা আর ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে না। এ ধরনের প্রতারণাকে আলাদা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে সাত বছর কারাদণ্ড।
নারী সংস্কার কমিশনের সদস্য কামরুন নাহার মনে করছেন, সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন আইনটি আবারও অনেকগুলো ‘ত্রুটি’ রেখে সংশোধন করা হয়েছে।
ফলে এ সংশোধনীতেও নারী নিপীড়নের ঘটনায় সঠিক ফলাফল পাওয়ার মত কোনো উদ্যোগ তিনি দেখছেন না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কামরুন নাহার বলেন, “ধর্ষণের সংজ্ঞা বিস্তৃত করার দাবি আমাদের অনেকদিন আগে থেকেই ছিল। এবারও ইনক্লুসিভ হয়নি, এটা ইনক্লুসিভ হওয়াটা খুব জরুরি। কিন্তু একটা আইন তো আমরা বারবার সংশোধন করব না। সুযোগ যেহেতু আমরা পেয়েছিলাম, সেটাকে কাজে লাগাতে পারতাম।
“আরেকটু সময় পাওয়া গেলে হয়ত এগুলোকে অ্যাড্রেস করা যেত। এটা সংস্কারের দাবি রাখে।”
সম্প্রতি দেশে বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তবে মাগুরায় ৮ বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেলে, বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। দেশজুড়ে আন্দোলন-বিক্ষোভ শুরু হয়।
এরপর সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, প্রস্তাবিত আইনে ধর্ষণ মামলার তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন আর বিচারের সময় ১৮০ দিন থেকে কমিয়ে ৯০ দিন নির্ধারণ করা হচ্ছে। এরমধ্যে বিচার নিশ্চিত না হলে অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া যাবে না।
এর আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়ানো হয় বছর চারেক আগে। মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর অধ্যাদেশ জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী তার আগে বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।
নতুন সংশোধনের বিষয়ে কামরুন নাহার বলেন, “তাড়াহুড়ো কখনো ভাল ফল তো দেয় না। ভুলও হতে পারে, কারণ এখানে মৃত্যুদণ্ড আছে। কাউকে যদি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেওয়া হয় সেটা তো শুধরানো যাবে না। এই সময়ের জন্য আদালত কতটা প্রস্তুত? বিচারালয় আছে কি না? বাস্তবায়নের জন্য অনেকগুলো কাজ কিন্তু রয়ে গেল।
“যত দ্রুততার সাথে আইনটি সংশোধন করা হল তত দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োগগত ত্রুটিগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে আশা করি।”
প্রস্তাবিত আইনে যে বিশেষ শিশু ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে বলা হচ্ছে তা কীভাবে তৈরি করা হবে সেটি স্পষ্ট হয়নি বলে মনে করছেন তিনি।
“শিশুদের বিরুদ্ধে যে অপরাধ হয় সেটার জন্য শিশু ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে আছে। সেটার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখা হবে না কি রাখা হবে না- একটা দিক নির্দেশনা থাকতে পারত আইনে। ট্রাইব্যুনালটা কি আগেরটাই থাকবে না কি নতুন হবে, অথবা কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে অমনি সেখানে শিশু ট্রাইব্যুনাল তৈরি হয়ে যাবে- সেগুলো স্পষ্ট করা দরকার।
“পরিসংখ্যান বলে বৈবাহিক ধর্ষণ অনেক হয়, এটাকে আইন কাভার করতে পারত না? অনেকগুলো প্রশ্ন কিন্তু এখনও রয়ে গেছে।”
প্রস্তাবিত আইনের খসড়া অনুযায়ী, প্রেমের সম্পর্ক থাকার সময় বিয়ের প্রতিশ্রুতি বা প্রতারণার মাধ্যমে কারও সঙ্গে যৌনকর্ম করলে তা আর ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে না। এ ধরনের প্রতারণাকে আলাদা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে সাত বছর কারাদণ্ড।
তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে অভিযুক্তের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ।
বিয়ের প্রলোভনে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারীকেও ধর্ষক হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করছেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে অধ্যাপক কামাল বলেন, “একটা প্রলোভন তো তার মাথার ভেতরে থাকে আরেকজনকে প্রভাবিত করার। যাকে প্রভাবিত করছে সে প্রলোভন দেখে ধরে নেয়, তাকে বিয়েই করবে। এভাবে সে যখন আক্রান্ত হচ্ছে, তখন ওই লোকটাকে সাত বছরের সুযোগ দেওয়া উচিত না।
“তাকে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করে ধর্ষকের শাস্তির জন্য যে বিধান বা সাজা রয়েছে তার তাই হওয়া উচিত। সাত বছর থেকে দুয়েক বছর বাড়ানো হবে, এমন না। প্রলোভন দেখিয়ে পরে বিয়ে করল না, তাহলে প্রলোভন দেখালো কেন? প্রলোভন যেহেতু দেখিয়েছে সুতরাং সে অপরাধী।”
অপরদিকে ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য যে সময় কমিয়ে আনার এ বিষয়ে তিনি বলেন, “এর মধ্যেও বিচার নাও হতে পারে; না হলে কী হবে? এগুলো কতগুলো বিষয় আছে।”
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলছেন, দ্রুত আইন সংশোধন না করে কীভাবে ধর্ষণ বন্ধ করা যায়; দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করা যায় এবং ধর্ষণটা যে ফৌজদারি অপরাধ সে বিষয়গুলো নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলে এরকম সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রচারণা দরকার। শুধু আইন দিয়ে ধর্ষণ কমানো যাবে না। সকল প্রেক্ষাপটকে কাভার করতে পারে এমন আইন থাকা দরকার।”
বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করাকে ধর্ষণ হিসেবে বিবেচনা না করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হওয়ার কথা বলছেন ফওজিয়া মোসলেমও।
তিনি বলেন, “ধর্ষণ ধর্ষণই। বিবাহিত নারী সেও যদি শারীরিক সংযোগের অনুমতি না দেয় সেটাকেও ধর্ষণ বলা হচ্ছে। সেখানে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণ করল, সেটাকে ধর্ষণ বলব না, এটাতে আমরা একমত হতে পারলাম না।”
ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়ার সময় কমিয়ে আনার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, অল্প সময়ে বিচার শেষ করার বাস্তবতা বাংলাদেশে আছে কি না।
“না কি এগুলো এখন সকলের দৃষ্টি এদিকে আছে বলে একটা আইওয়াশ দেওয়া হল আমরা ঠিক জানি না। সেটা ভবিষ্যতে বুঝতে পারব,সেটা কী হল।
শিশু ধর্ষণের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে যে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হচ্ছে সেটাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও কার্যকরভাবে তৈরি করতে বলছেন তিনি।
“নারী নির্যাতনের ট্রাইব্যুনাল তো অলরেডি আছে, পোস্টিং থাকে না, পুলিশের হিসাবেই হাজার হাজার কেইস পরে আছে… কাজেই সেদিক থেকে ট্রাইব্যুনাল শুধু করলেই হবে না, সেটাকে ফাংশনিং করতে হবে। সেটা হচ্ছে মূল কাজ।
“আইনের সঙ্গে যারা জড়িত আছে তাদের আরও জেন্ডার সংবেদনশীল কীভাবে করা যায় সে ব্যাপারেও উদ্যোগ নিতে হবে।”
৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত না হলে সেক্ষেত্রে কী হবে তার একটা স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা দরকার বলে মনে করছেন ফওজিয়া মোসলেম।
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, দপ্তর, বিচারক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, মানবাধিকার সংস্থা, আইন বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনের মতামত পর্যালোচনা করে আইন ও বিচার বিভাগ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া তৈরি করেছে।
তবে সেখানে মহিলা পরিষদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
আইন সংশোধনে নারী সংস্কার কমিশনেরও কোনো মতামত চাওয়া হয়নি বলে তুলে ধরেন নারী সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এত গুরুত্বপূর্ণ আইনটা সময় নিয়ে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংশোধন করা হলে ভালো হত। তাড়াহুড়ো করে আইন সংশোধনের পক্ষে আমরা না।
“আগের আইনের সমস্যাটা কী, ওই আইনে ঘাটতিটা তা কী চিহ্নিত করা হয়েছে? শুধু শাস্তি বাড়ানো হলেই অপরাধ দমন হবে তা আমি বিশ্বাস করি না।”
তবে বিয়ের প্রলোভনে যৌন সম্পর্ক তৈরিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করলেও সেটাকে ধর্ষণ হিসেবে মানছেন না শিরীন পারভিন।
“প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যদি কোন নারী যৌন সম্মতি দিয়ে থাকে তাহলে সেটা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না।”
আরও পড়ুন:
অধ্যাদেশে রাষ্ট্রপতির সই, ধর্ষণের শাস্তি এখন মৃত্যুদণ্ড
মাগুরায় শিশু ধর্ষণের বিচার শুরু ৭ দিনের মধ্যে: আইন উপদেষ্টা