Published : 18 Aug 2024, 11:34 PM
ঢাকার আদালতের এজলাস কক্ষের লোহার খাঁচায় আসামিদের রাখা নিয়ে সমালোচনার মধ্যে সেই খাঁচা সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গত শুক্রবার ২৭ ও ২৮ নম্বর মহানগর হাকিমের এজলাস থেকে লোহার খাঁচা সরানো হয়। সেখানে এখন ছোট লোহার কাঠগড়া বসানো হয়েছে। ধীরে ধরে সবগুলো লোহার খাঁচাই সরানো হবে বলে জানিয়েছেন আদালতের কর্মীরা।
গ্রেপ্তারের পর কাউকে আদালতে তোলা হলে এজলাস কক্ষের এক পাশে থাকা এই লোহার খাঁচায় রাখা হচ্ছিল। আবার কোনো মামলার আসামি হয়ে কেউ হাজিরা দিতে গেলে তাকেও খাঁচার মধ্যে ঢুকতে হয়।
আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছর পনের আগে এক রায়ের পর ক্ষুব্ধ হয়ে বেশ কয়েকজন দণ্ডিত ব্যক্তি বিচারককে স্যান্ডল ছুঁড়ে দিয়েছিল। এরপর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ, জেলা ও দায়রা জজ, মুখ্য মহানগর হাকিম, মুখ্য বিচারিক হাকিমসহ অধস্তন আদালতের সব এজলাসে লোহার খাঁচা বসানো হয়েছিল।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের নাজির রেজোয়ান খন্দকার রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গণপূর্ত বিভাগের সংশ্লিষ্ট লোকজন বলেছে, ধীরে ধীরে সব এজলাস থেকেই খাঁচা সারানো হবে।”
বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রেজোয়ান বলেন, “যেহেতু ২৭ ও ২৮ নম্বর মহানগর হাকিম বেশিরভাগ রাজনৈতিক মামলা পরিচালনার ও শুনানি গ্রহণ করার দায়িত্ব পেতেন, সে কারণে প্রথমেই ওই দুই এজলাস থেকে আসামিদের রাখার কাঠগড়া থেকে খাঁচা সরানো হয়।”
ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির খাদেমুল ইসলাম রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ আদালতের এজলাসসহ প্রত্যেক এজলাস থেকে লোহার খাঁচা সরানো হবে।”
গণপূর্তের প্রকৌশলী মাসুদুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রধান বিচারপতির আদেশে লোহার খাঁচা সরাচ্ছি আমরা।”
গত ১২ জুন এক মামলায় অভিযোগ গঠনের পর আদালত থেকে বেরিয়ে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, “শুনানি চলাকালে একজন নিরপরাধ নাগরিককে একটা লোহার খাঁচার ভেতরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টি অত্যন্ত অপমানজনক। অনেক হয়রানির মধ্যে আছি। সেটারই অংশ, এটা চলতে থাকবে।
“আজকে সারাক্ষণ খাঁচার মধ্যে ছিলাম আমরা সবাই মিলে। যদিও আমাকে বলা হয়েছিল যে, আপনি থাকেন। আমি বললাম, সবাই যাচ্ছে, আমিও সঙ্গে থাকি। সারাক্ষণই খাঁচার ভেতরে ছিলাম।”
তিনি এও বলেছিলেন, “যারা আইনজ্ঞ আছেন, বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত আছেন, তারা পর্যালোচনা করে দেখুন, এটা (খাঁচা) রাখার দরকার আছে? নাকি সারা দুনিয়ায় সভ্য দেশে যেভাবে হয়, আমরাও সভ্য দেশের তালিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারি?”
গত বুধবার সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের লোহার খাঁচায় রাখা হয়।
অবশ্য বৃহস্পতিবার সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু; সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক এবং ছাত্রলীগ নেতা তানভীর হাসান সৈকতকে লোহার খাঁচায় রাখা হয়নি। গত শুক্রবার ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকেও আদালতের লোহার খাঁচায় রাখতে দেখা যায়নি।
এজলাস কক্ষে আসামিকে লোহার খাঁচায় ঢোকানো অমানবিক ও সংবিধান পরিপন্থি বলে সমালোচনা করে আসছেন আইনজ্ঞরা।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটি সভ্য রাষ্ট্রের আদালতে লোহার খাঁচা থাকতে পারে না। আগে কখনো লোহার খাঁচা ছিল না। কয়েক বছর ধরে লোহার খাঁচা বসানো হয়েছে। অবিলম্বে সব আদালত থেকে লোহার খাঁচা তুলে নিতে হবে।”
তিনি বলেন, “বিচারের মুখোমুখি কোনো আসামির সঙ্গে সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদের চেতনার পরিপন্থি কোনো আচরণ সমর্থনযোগ্য নয়। একজন আসামিকে লোহার খাঁচায় ঢোকানো কিংবা ঢুকতে বাধ্য করা অমানবিক। এটি সংবিধানের চেতনার পরিপন্থি।”
সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।”
তাছাড়া নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদের (আইসিসিপিআর) ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কাউকে নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি দেওয়া যাবে না।
আইসিসিপিআরের অনুচ্ছেদ ১৪(২) অনুযায়ী, ফৌজদারি অপরাধের জন্য অভিযুক্ত প্রত্যেকের আইন অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্দোষ বলে গণ্য হওয়ার অধিকার থাকবে।
আদালতের এজলাস কক্ষ থেকে লোহার খাঁচা অপসারণের নির্দেশনা চেয়ে গত ২৩ জানুয়ারি হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন।