নির্মাণ খাতে নিরাপদ পরিবেশ আসবে কবে?

নিরাপত্তা উপকরণ নিয়ে ঠিকাদার ও মালিকরা যেমন উদাসীন, তেমনই শ্রমিকদেরও খামখেয়ালির কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2023, 05:55 PM
Updated : 30 April 2023, 05:55 PM

সিমেন্টের একটা বস্তা পেঁচিয়ে পরেছেন মাথায়, আর মাথার উপর সিমেন্টের বস্তা নিয়ে ছুটছেন কংক্রিট মিক্সার মেশিনের দিকে, বস্তার মুখের সেলাই খুলে সিমেন্ট ঢালছেন মিক্সারের ঘূর্ণায়মান বড় পাত্রে। সিমেন্টের আস্তর পড়ে নাক-মুখ, শরীর এরই মধ্যে সাদা হয়ে গেছে। মধ্য চল্লিশেই প্রায় বুড়িয়ে গেছেন নির্মাণ শ্রমিক আব্দুস সোবহান।

এ নির্মাণ শ্রমিক জানালেন, এরই মধ্যেই তিনি আক্রান্ত হয়েছেন শ্বাসকষ্টে। ওষুধ খেতে হয়, একটানা দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে পারেন না। তার ভাষায় এটা হচ্ছে ‘ক্ষয় রোগ’।

নির্মাণ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মাণ কাজে যুক্ত ব্যক্তিরা অকালেই বুড়িয়ে যান ও কর্মক্ষমতা হারান।

দেশীয় ঠিকাদারদের অধীনে যে কাজগুলো হয়, সেখানে কর্মপরিবেশ বা নিরাপত্তা নিশ্চিতেই কোনো বালাই নেই; যদিও বিদেশি ঠিকাদারদের নির্মাণ ক্ষেত্রগুলোতে এ বিষয়গুলো মানতে দেখা যায়।

কলকারখানার কর্মপরিবেশের মান বজায় রাখতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা কাজ করলেও নির্মাণখাতে তেমন একটা নজর নেই। হতাহত হলে বা আহত হয়ে কর্মহীন হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়াও তাই অনিশ্চিত। 

ঢাকার আগারগাঁওয়ের একটি ভবনে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসাবে কাজ করছেন গাইবান্ধার সবুজ। ২২ বছর বয়সী এ শ্রমিক জানালেন, গেল বছর চারতলা থেকে দোতলার ল্যান্ডিংয়ে পড়ে তার চাচাত ভাইয়ের একটি হাত ভাঙে, কোমরেও আঘাত পোন। প্রায় একবছর কর্মহীন ছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) হিসাবে, ২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১০৩৪ জন শ্রমিক মারা গেছেন। তাদের মধ্যে নির্মাণ শ্রমিক ১১৮ জন।

কেবল সংবাদপত্রে প্রকাশিত দুর্ঘটনার তথ্যগুলো সংরক্ষণ করে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো। শ্রমিকদের অসুস্থতার বিষয়গুলো নিয়ে তেমন আলোচনা নেই বললেই চলে।

শ্যামলীর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট যক্ষা হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আয়েশা আক্তার বলছেন, নির্মাণ উপকরণ যেমন বালুকণা, লোহার গুঁড়া, সিমেন্ট বা সিলিকা জাতীয় বস্তু যখন শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে ফুসফুসের উপর গিয়ে পড়ে, তখন এর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির মতো সমস্যা থেকে শুরু করে হৃদরোগ, মস্তিষ্কের সমস্যাসহ নানা রকম সমস্যায় তারা আক্রান্ত হন।

“নির্মাণ কাজে যুক্ত থাকার সময় যদি তারা যথাযথ নিরাপত্তা উপকরণ অন্ততপক্ষে মাস্ক ব্যবহার করেন, তবুও অনেকটা নিরাপদ থাকা যায়।”

নির্মাণ শ্রমিক সবুজ জানালেন, তিনি আগে বছিলায় কাজ করতেন। প্রচণ্ড মশা সেখানে, এরমধ্যেই তাদের বহুদিন রাস্তার পাশে টিনের অস্থায়ী ঘরের মেঝেতে থাকতে হয়েছে। শীতকালে হু হু করে ঠাণ্ডা ঢোকে। বর্ষায় ঢোকে বৃষ্টির পানি। ভবনের একটা ছাদ হওয়ার পর তারা সেই টিনের ঘর সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। তবুও থাকার পরিবেশ খুবই খারাপ। পুরো শুকনো মৌসুম তিনি কেশেছেন, ওষুধ খেয়েও কাশি যায় না।

ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের (ইনসাব) সবুজবাগ থানার সাধারণ সম্পাদক গিয়াসউদ্দীন বলছেন, “নাকে-মুখে গামছা বা মাস্ক পরা, হেলমেট-বেল্ট পরতে আমরা বলি, কিন্তু বেশিরভাগ শ্রমিকই ব্যবহার করে না। ঠিকাদার ও মালিকপক্ষ দেয় না। শ্রমিকদেরও খামখেয়ালি আছে।

“শ্বাসের সঙ্গে সিমেন্ট-বালু ঢুকছে। দিন শেষে দেখা যায়- তাদেরই শ্বাসকষ্টে ভুগতে হচ্ছে, খালি হাতে সারাদিন সিমেন্ট-বালু নাড়াচাড়া করায় অনেকর হাতে দীর্ঘমেয়াদি ‘ঘা’ হয়ে যাচ্ছে। এগুলোর পুরোটাই খামখেয়ালি। হাত-পা কেটে যাওয়ার ঘটনা ঘটে অহরহই।”

রাজধানীর বছিলা এলাকায় নির্মাণকাজের ‘সাইট ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী মুজাহিদুল ইসলাম। তার ভাষ্য, শ্রমিকদের বলার পরও তারা শোনেন না। বিশেষ করে উঁচু নির্মাণক্ষেত্রগুলোতে তারা শ্রমিকদের বেল্ট পরতে বলেন। কিন্তু তারা গা লাগায় না।

কম মজুরি, ঝুঁকি অনেক

ঢাকার বছিলা ও কেরাণীগঞ্জ এলাকায় দ্রুত বাড়ছে নগর। তৈরি হচ্ছে প্রচুর বহুতল আবাসিক ভবন। একটি ভবন তৈরিতে কমপক্ষে ১০ ধরনের কারিগর ও শ্রমিক কাজ করেন।

তাদের মধ্যে রয়েছেন পাইলিং শ্রমিক, রড মিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, টাইলস মিস্ত্রি, গ্রিল মিস্ত্রি, পানির লাইনের মিস্ত্রি (প্লাম্বার), কাঠ মিস্ত্রি, থাই গ্লাস মিস্ত্রি ও রং মিস্ত্রি। কম বেশি সবাইকেই নানা ধরনের ঝুঁকি আর দূষণের মধ্যে কাজ করতে হয়। এদের দৈনিক মজুরি কাজ ভেদে সাড়ে চারশ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত।

ডিপ্লোমা প্রকৌশলী মুজাহিদুল বলছিলেন, ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের সময়ে একজন ঠিকাদার শ্রমিক সরবরাহ করেন। এসব শ্রমিকদের মধ্যে যারা ‘জোগালি দেন’, তাদের মজুরি সাত থেকে আট’ টাকার মধ্যে। ছাদের ওপর যারা ‘মসলা টানেন’, তাদের মজুরি একটু বেশি।

আর যারা বেলচা দিয়ে ইট-খোয়া-কংক্রিট শ্রমিকদের কড়াইয়ে তুলে দেন অর্থাৎ ‘বেলচা মারেন’, তাদের মজুরি ৯০০ টাকার মতো। এর বাইরেও শ্রমিকদের সর্দার রয়েছেন, রয়েছেন ঠিকাদারের ফোরম্যান। তাদের মজুরি একটু বেশি। যারা ভবনের রড প্রস্তুতের কাজ করেন বা রড মিস্ত্রি, তাদের মজুরি সাত থেকে সাড়ে সাতশ টাকা। তাদের সহযোগী বা জোগালিরা পান পাঁচশ থেকে সাড়ে পাঁচশ টাকা। কিন্তু মাসের ৩০দিনই তারা কাজ করতে পারেন না।

মুজাহিদুলের দৃষ্টিতে নির্মাণক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনাগুলো ঘটে বাইরের দেয়াল প্লাস্টার করার সময়। বাইরে মাঁচা বেঁধে তার উপর দাঁড়িয়ে মিস্ত্রিরা প্লাস্টার করেন। অনেক সময় মাচা ভেঙে বা অসাবধানবশত পড়ে গিয়ে তারা হতাহত হন।

“তবে অনেক বলা-কওয়ার পরেও তাদের বেল্ট পরানো যায় না। বেল্ট পরলে তারা সহজে নড়াচড়া করতে পারেন না-এই যুক্তিতে তারা বেল্ট পরেন না। যারা বাইরের দেয়ালে রশি ধরে ঝুলে ঝুলে রংয়ের কাজ করেন, তারাও বেল্ট পরতে চান না। ছাদের নীচের অংশ প্লাস্টারের আগে ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে খোদাই (চিপিং) করতে হয়।”

এই চিপিং করার সময় কংক্রিটের কণা, ধুলা সরাসরি চোখে-মুখে পড়ে। তবুও শ্রমিকদের অনেকে চশমা পরতে চান না। কোমরে বাঁধা গামছাটা নাকে বাঁধতে বললেও অনেকে কথা শোনেন না বলে অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন তিনি।

রং মিস্ত্রী রুবেল এখন ভবনে রংয়ের ঠিকাদারিও নেন। তার ভাষ্য, তারা সাধারণ দড়িতে বাঁধা বাঁশের উপর ঝুলে আরেকটা দড়ি ধরে থাকেন। রঙের কৌটাটা আরেকটা দড়িতে বাঁধা থাকে। মূলত কাজটা করতে হয় এক হাতে। এক হাতে বুরুশ ধরে রঙের কৌটায় চুবিয়ে দেওয়ালে আস্তর মারাতে হয়।

আবার বাইরের দেওয়াল ঘষার সময়ও একইভাবে একহাতে দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে আরেক হাতে সিরিষ কাগজ নিয়ে দেওয়াল ঘষতে থাকেন তারা।

সেইফটি বেল্ট পরলে কাজে সমস্যা হয় দাবি করে রুবেল বললেন, “আমাদের অনেক নড়াচড়া করতে হয়। এক বাঁশ থেকে আরেক বাঁশে ঝুলে ঝুলে উঠতে বা নামতে হয়। সেইফটি বেল্ট থাকলে একবার বেল্ট রশি থেকে ছোটাওরে, আবার আরেক রশিতে গিয়ে আটকাওরে।

“এই হ্যাপার কারণে শ্রমিকরা বেল্ট বাঁধতে চান না। আমি ১০ তলা ভবন পর্যন্ত বেল্ট বাঁধার চিন্তাই করি না।”

তবে বিদেশিরা তত্ত্বাবধান করেন- এমন নির্মাণক্ষেত্রেগুলোতে বেল্ট আর হেলমেট ছাড়া ভেতরেই ঢুকতেই দেওয়া হয় না বলে জানালেন রুবেল।

রংমিস্ত্রি যারা ভেতরে কাজ করেন তাদের মজুরি ৬শ থেকে ৭শ টাকা। আর যারা বাইরে ঝুলে কাজ করেন, তাদের মজুরি ২০০ টাকা বেশি।

কেবল পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিই নয়, রং মিস্ত্রিরা যখন দেয়াল ঘষেন তখন প্রচুর ধুলা হয়। এ সময়ও অনেকে মুখে গামছা বাঁধতে চান না বলে রুবেলের ভাষ্য।