আলোচনা সভার উপস্থাপনায় বলা হয়, প্রান্তিক এই শিশুরা গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে না, ফলে বাড়ছে ঝরে পড়ার সংখ্যা।
Published : 05 Mar 2024, 08:45 PM
ভাষাগত সীমাবদ্ধতা ও শিক্ষক সংকটে প্রান্তিক নৃগোষ্ঠী ও চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কীভাবে প্রাথমিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে, সেই চিত্র উঠে এসেছে এক মতবিনিময় সভায়।
মঙ্গলবার ঢাকার কারওয়ান বাজারে ‘প্রান্তিক শিশুদের জন্য সমতাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত’ শীর্ষক এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে জাপানভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘শাপলা নীড়’। সহযোগিতায় ছিল গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র ও পাপড়ি।
প্রান্তিক নৃগোষ্ঠী ও চরাঞ্চলের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা, বিশেষ করে এই শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিকার বাস্তবায়িত না হওয়া, নিজস্ব কমিউনিটির শিক্ষক না থাকা, মহামারীর সময়ে শিশুশ্রম বেড়ে যাওয়া এবং শিক্ষার হার ও মান বাড়াতে অধিকার প্রকল্পের বিভিন্ন উদ্যোগ বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও তথ্যভিত্তিক উপস্থাপনার মাধ্যমে তুলে ধরা হয় অনুষ্ঠানে।
উপস্থাপনায় দেখানো হয়, দিনাজপুর সদর উপজেলার ১৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাঁওতাল, তুরি ও মুশোহরসহ বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রায় ৪০০ শিশুর জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ নেই। কেবল ওঁরাও শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় বইয়ের ব্যবস্থা থাকলেও নিজস্ব কমিউনিটির কোনো শিক্ষক নেই।
মহামারীর সময়ে ১৮ জন শিশু বিদ্যালয় ছেড়ে শিশু শ্রমে ঢুকে যায়। এই সমস্যা সমাধানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের পড়াশুনা করানো ও শিক্ষক বাংলা ভাষায় যে শিক্ষা দিচ্ছে তা শিশুর মাতৃভাষায় অনুবাদ করে দেওয়া শুরু করা হয়।
অপরদিকে, নরসিংদীর প্রান্তিক চরাঞ্চলে নয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৪০ শতাংশ শিক্ষক রয়েছেন এবং কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়েই প্রধান শিক্ষক নেই। তাই নিয়মিত ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ২৫৯৩ জন শিশু।
উপস্থাপনায় বলা হয়, প্রান্তিক এই শিশুরা গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে না, ফলে বাড়ছে ঝরে পড়ার সংখ্যা।
তবে প্রকল্পের অধীনে ১১টি লার্নিং স্পটে ১১ জন এডুকেশন ফেসিলেটেটর রয়েছেন। বাড়ি ভিত্তিক লার্নিং স্পটে তুলনামূলক বেশি দুর্বল ৩৩০ জন শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে এবং মোট শিক্ষার্থী ৫১৪৮ জন। গত ৯ মাসে এই বিদ্যালয়গুলোতে ৩০৩৭৫টি ক্লাস হওয়ার কথা থাকলেও ক্লাস হয়েছে ২৪৮৬২টি।
শাপলা নীড় বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর তোমোকো উচিয়ামা তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, “সামাজিক ও ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে বাংলাদেশের সমতলের প্রান্তিক জাতিসত্তার এবং দুর্গম চর এলাকার শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে ঝরে পড়তে বাধ্য হয়। করোনা পরবর্তী সময়ে এ চিত্র আরো ভয়াবহ হয়েছে। বেড়েছে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ।
“তাই দিনাজপুর ও নরসিংদী জেলার দুটি এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শাপলা নীড় গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র ও পাপড়ির সহায়তায় অধিকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ৪ বছরের এই প্রকল্প শেষে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনাও সম্ভব হয়েছে।”
গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “অধিকার প্রকল্পটি দিনাজপুরের আটটি ইউনিয়নের ১৯টি প্রান্তিক নৃগোষ্ঠী ও ১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যার মেয়াদ এ মাসেই শেষ হতে যাচ্ছে। প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের চেষ্টা করা হলেও ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষায় এ সব শিশুরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে।”
পাপড়ির (পভার্টি এলিভেশন থ্রো পার্টিসিপেটরি রুরাল ইনিশিয়েটিভস) নির্বাহী আবু বাছেদ বলেন, নরসিংদী জেলার রায়াপুরা উপজেলার মেঘনা নদীতে ঘেরা চাঁনপুর ইউনিয়নের নয়টি সরকারি বিদ্যালয়ে ঝরে পড়া, অনিয়মিত বা ঝরে পরার ঝুঁকিতে থাকা প্রান্তিক শিশুদের জন্য অধিকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
“মহামারীর সময় যখন বিদ্যালয় বন্ধ হয়, তখন সোশাল মোবিলাইজার, প্যারা টিচারের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হয়েছিল। আর লার্নিং স্পটের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের পড়ানোয় অনেক শিক্ষার্থী নিয়মিত হয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক রাশেদা রওনক খান বলেন, পাহাড়ের নৃগোষ্ঠীদের নিয়ে কিছুটা আলোচনা হলেও সমতলের নৃগোষ্ঠী ও চরাঞ্চলের মানুষ অনেকটাই বঞ্চিত।
“বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই জনগোষ্ঠী থেকে খুব কম শিক্ষার্থীদেরই আমরা পাই। তাই এ ধরনের প্রকল্প শেষ হয়ে গেলেও কীভাবে এর কার্যক্রম টেকসই করা যায় তা নিয়ে বাস্তবভিত্তিক কাজ করতে হবে।”
অন্যদের মধ্যে আইআইডি এর সিইও সাঈদ আহমেদ, নারায়ণগঞ্জের সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সোহাগ হোসেন, নরসিংদীর চাঁনপুর এলাকার চেয়ারম্যান মোমেন সরকার, দিনাজপুরের শংকরপুর এলাকার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আলোচনায় অংশ নেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন শাপলা নীড় বাংলাদেশের কোর্ডিনেটর আনিসুজ্জামান।