তানভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ভালো তো আরও আন্দোলন করুক। এইগুলা সমাধানের কি কেউ আছে? মাঝখানে পড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমরা।”
Published : 16 Jul 2024, 09:10 PM
কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা বিক্ষোভ করায় দিনভর উৎকণ্ঠা আর দুর্ভোগ পোহাতে হল রাজধানীবাসীকে।
মঙ্গলবার এই আন্দোলন-সংঘাতে সবেচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েন রোগী, শিশু ও বৃদ্ধরা।
সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
ঢাকার মিরপুর, উত্তরার আবদুল্লাহপুর, বাড্ডার প্রগতি সরণি, বনানী, রামপুরা, মুগদা, বিরুলিয়া, বিরুলিয়া, ধউর, যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী, দনিয়া এবং মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার অবরোধ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
এসব এলাকার সড়ক অবরোধের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গন্তব্যে পৌঁছাতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে। আবার অনেক জায়গায় তীব্র যানজট তৈরি হয়।
অনেক যাত্রী যানবাহন না পেয়ে হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছেছেন। কেউ আবার রিকশা, অটোরিকশা, রাইড শেয়ারিংয়ের যানবাহনে ভেঙে ভেঙে চলাচল করেছেন। সেক্ষেত্রে সাধারণ দিনের তুলনায় দ্বিগুণ বা তিনগুণ ভাড়াও গুণতে হয়েছে নগরবাসীকে।
রাজধানীর ইসিবি চত্বরে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে রাখায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন গুলশান, বনানী, মহাখালী, বিমানবন্দর, উত্তরা, আবদুল্লাহপুরের যাত্রীরা।
উত্তরার একটি হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর জন্য দেড় বছরের অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে বের হয়েছিলেন তানভীর আহমেদ। কিন্তু সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় সময়মত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি তিনি।
ইসিবি চত্বরে অটোরিকশা থেকে নেমে কিছুদূর হেঁটে গেলেও কোনো যানবাহন না পাওয়ায় স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় বসে পড়েন তিনি।
তানভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ভালো তো আরও আন্দোলন করুক। এইগুলা সমাধানের কি কেউ আছে? মাঝখানে পড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমরা। বাচ্চাটার কত শরীর খারাপ। ডাক্তার দেখানোর টাইম ছিল ৫টা। কিন্তু যেতে পারলাম না। এমন একটা অবস্থায় রাস্তায় বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নাই। আমরা এতটা অসহায় হয়ে পড়ছি।”
বেসরকারি চাকরিজীবী ফারহানা ইসলাম অফিস শেষে বাসায় ফেরার জন্য মিরপুর-১২ নম্বর থেকে বাসে উঠলেও কালশীতে সব যাত্রীর সাথে তাকেও নামিয়ে দেওয়া হয়।
ফারহানা বলেন, “এখানে কোনো বাস নাই। রিকশা, বাইক, সিএনজি আছে। কিন্তু কেউই মহাখালীর দিকে যেতে চাচ্ছে না। কারণ পুরা রাস্তাই বন্ধ। ৪টায় অফিস শেষ হয়েছে। সাড়ে ৫টা বাজে। এখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। জানি না কখন পৌঁছাতে পারব।”
কোটা আন্দোলন উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কয়েকদিন ধরে কোটা আন্দোলনের কারণে অনেক কষ্ট করে অফিসে যাচ্ছি, আবার ফিরছি। কিন্তু প্রচণ্ড ভয় লাগছে, মনে হচ্ছে কখন যেন মারামারির মধ্যে পড়ে যাই।”
মহাখালীর আমতলি মোড় থেকে বাস টার্মিনালমুখী সড়কে বিকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে শিক্ষার্থীদের। পুলিশ বক্সে ও মোটরসাইকেলে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটে। বিক্ষোভ দমাতে পুলিশ টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে।
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন এনজিওকর্মী সৈয়দ রিপন।
তিনি বলেন, “এই এলাকায় এমন পরিস্থিতি আমি জানতাম না। আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে দেখি দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে, পুলিশও রাবার বুলেট ছুড়ছে। আমিও দৌড়ে একটা গলিতে ঢুকেছি। আজকেই প্রথম এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি। খুবই ভয় লাগছিল।”
গুলশান থেকে কালশী মোড়ে যেতে ৪০০ টাকা গুণতে হয়েছে বেসরকারি চাকরিজীবী তাসফিয়া বিনতে রায়হানকে।
“প্রতিদিন ২৫০ থেকে খুব বেশি হলে ৩০০ টাকায় কালশী যাই। আজকে ৪০০ টাকা নিল। সুযোগ পেলেই অসাধু ড্রাইভাররা টাকা বাড়িয়ে নেয়। আমাদেরও তো কিছু করার নাই। আমরা ওদের হাতে জিম্মি।”
সকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন বজলুর রহমান ও তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নাহার।
ডাক্তার দেখিয়ে দুপুরের পর কমলাপুর যাওয়ার জন্য অটোরিকশা খুঁজতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন তারা। আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে একটি অটোরিকশা পেলেও দ্বিগুণ ভাড়া দাবি করেন চালক।
নিরূপায় হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে তারা ৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে কমলাপুর যান।
বিকাল ৫টার দিকে সেগুনবাগিচা থেকে মহাখালীর ওয়ারলেসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা মোটর বাইকচালক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “অন্যান্য দিন এই পথ আসতে সর্বোচ্চ আধাঘণ্টা লাগে, আজ লেগেছে দুই ঘন্টা।
“সেগুনবাগিচা থেকে মহাখালী এক্সপ্রেসওয়ের ঢাল পর্যন্ত সহজেই পৌঁছাই কিন্তু এর পরের রাস্তা বন্ধ থাকায় আর সামনে এগোনো যাচ্ছিল না। কিছু সময় অপেক্ষা করে পরে বাইক ঘুরিয়ে উল্টো পথে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন রাস্তা পার হয়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো ভবনের পাশের রাস্তা দিয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকার ভেতর দিয়ে অনেক পথ ঘুরে ওয়্যারলেস আসি। রাস্তায় বাস বা অন্য যানবাহন কম থাকলেও রাস্তা বন্ধ থাকার জন্য সবাইকে ভোগান্তিতে পরতে হয়েছে।”
এই পরিস্থিতি বুধবারও থাকলে অফিস যেতে দুর্ভোগের আশঙ্কা করছেন ঢাকার কল্যাণপুরের বাসিন্দা নুশরাত জাহান।
বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নুশরাত বলেন, “আজ অফিসে যেতে অনেক ঝামেলা হয়েছে। ফেরার সময় কিছু পথ হেঁটে রিকশায় এসেছি। কালও এ অবস্থা চলতে থাকলে কীভাবে যাব, বুঝতে পারছি না।”
বিকালে আগারগাঁও মোড়ে দেখা যায়, আন্দোলনকারীরা রাস্তা বন্ধ করে স্লোগান দিচ্ছেন। এতে বিপাকে পড়েন সাধারণ মানুষ। দুই পাশের গাড়ি বন্ধ থাকায় অনেককে দেখা যায় হেঁটে যাচ্ছেন। নারী, শিশুকেও দেখা যায় হাঁটতে।
রাইসুল তমাল নামের একজনকে দেখা যায় বিজয় সরণিতে, তার দুই হাতেই ভারি ব্যাগ, কাঁধেও ব্যাগ।
তমাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি যাব মালিবাগে। কিন্তু কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। তিনটা ব্যাগ নিয়ে খুব কষ্ট করে হেঁটে যাচ্ছি। আগারগাঁও থেকে একজন সাংবাদিক আমাকে বিজয় সরণি পর্যন্ত তার বাইকে করে নামিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাকি রাস্তাটা যেতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না।”
এদিকে মিরপুর রোডে ঢাকা কলেজের সামনে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে দুই জনের মৃত্যুর পর ওই এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ধানমন্ডি-৪ এর বাসিন্দা জেসমিন পারভীন জানান, তারা ভয়ে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না।
“বাসার জন্য কিছু জিনিস আনা দরকার। গাউসিয়ায় টেইলরের কাছেও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভয়ে বের হইনি। বলা যায় না কখন কী ঘটে যায়। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেছে। সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। আজকে সারাদিনে কত মানুষ মারা গেল। কিন্তু কেন? ছাত্ররা আন্দোলন করছে। সরকারের উচিত এটার সমাধান করে দেওয়া।”
গত দুই সপ্তাহ ধরে চলা কোটাবিরোধী আন্দোলন এখন সহিংস রূপ পেয়েছে। ঢাকা, রংপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা রঘটেছে।
এসব সংঘর্ষের মধ্যে চট্টগ্রামে তিনজন, ঢাকায় দুইজন ও রংপুরে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, গাজীপুরে নেমেছেন বিজিবি সদস্যরা।