তহবিলে কাটছাঁট হলে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর সেবা দেওয়ার সক্ষমতা ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা কমবে এবং অত্যাবশ্যক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে, বলছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউএনএফপিএ
Published : 08 Apr 2025, 08:32 PM
আড়াই দশকে বাংলাদেশের মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কমে আসলেও এখন উন্নয়ন অংশীদাররা পর্যাপ্ত তহবিলের যোগান না দিলে মাতৃস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ও ইউএনএফপিএ।
বাংলাদেশে ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মাতৃমৃত্যু বছরে গড়ে ৭ শতাংশ করে কমার তথ্য দিয়ে সংস্থা দুটি এক বিজ্ঞপ্তিতে বলছে, “এই অগ্রগতি অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টার প্রমাণ তুলে ধরে। অবশ্য জাতিসংঘের প্রতিবেদনে যে বৈশ্বিক উদ্বেগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের এই সব অর্জন এখন হুমকির মুখে।
“প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী নজিরবিহীনভাবে সহায়তা কমানোর কারণে বিভিন্ন দেশ এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ মাতৃ, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবাসমূহ প্রদানের ক্ষেত্রে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। মাতৃমৃত্যুর মূল কারণ প্রসূতি রক্তপাত, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, অনিরাপদ গর্ভপাত ও অন্যান্য পরোক্ষ জটিলতা। এসব মোকাবিলায় উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, দক্ষ স্বাস্থ্য সেবাকর্মী এবং প্রয়োজনের সময় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর প্রয়োজন।”
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তহবিলে কাটছাঁট হলে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর সেবা দেওয়ার সক্ষমতা ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা কমবে এবং অত্যাবশ্যক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ ও মানের ওপরে।
“নিজ খরচে চিকিৎসা চালানো অসহায় ও ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোর জন্য বিশাল এক বাড়তি বোঝা, যা তাদের আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে নিজ পকেট থেকে ব্যয় উদ্বেগজনক হারে বেশি। এই বাড়তি বোঝা প্রতি বছর ৫০ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয় এবং মাতৃত্বকালীন চাহিদা মেটাতে সম্পদহীন মায়েদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়।”
চলতি বছর ক্ষমতায় বসেই বিদেশে প্রায় সব রকমের সহায়তা সাময়িকভাবে স্থগিতের ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তাতে বিভিন্ন বৈশ্বিক কর্মসূচির কোটি কোটি ডলারের তহবিল পড়েছে হুমকির মুখে।
এসব অর্থ ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টসহ (ইউএসএআইডি) বিভিন্ন বৈশ্বিক কর্মসূচি থেকে দিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে ট্রাম্পের ঘোষণার পর সেসব প্রকল্পের কাজ থমকে গেছে। অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে প্রকল্পগুলো ভবিষ্যতে চালিয়ে নেওয়া হবে কিনা।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের ওআইসি প্রতিনিধি স্ট্যানলি গোয়াভুয়া বলেন, “সহায়তা কমানো হলে মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নের ধারা ধরে রাখার এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অভীষ্টসমূহ অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। অগ্রগতির এই অর্জন ধরে রাখতে স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি বাজেট বরাদ্দ অব্যাহত রাখা প্রয়োজন, পাশাপাশি প্রয়োজন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও সবার জন্য সহজগম্য করা, যাতে নিজ পকেট থেকে চিকিৎসার খরচ বহন করতে অপারগ মায়েরা জরুরি স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না থাকে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি আহমেদ জামশিদ মোহামেদ বলেন, “২০০০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যু ৪০ শতাংশ কমেছে। তবে বিশ্বব্যাপী তহবিল হ্রাস ও ক্রমবর্ধমান সংখ্যক দেশে মানবিক সংকটের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অগ্রগতির যে উদ্বেগজনক ধীরগতি, সেটা আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়।”
বাংলাদেশে ইউএনএফপিএ এর প্রতিনিধি আই ই মাসাকি ওয়াতাবে বলেন, “বাংলাদেশ ২০০০ সাল থেকে মাতৃমৃত্যু হার ৭৯ শতাংশ কমানোর অসামান্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমরা গর্বিত যে এই অর্জন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে, চলতি সপ্তাহে কমিশন অন পপুলেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিডি৫৮) ৫৮তম অধিবেশনে শুরু হওয়া ‘মিডওয়াইফারি অ্যাকসেলেরেটর’ শীর্ষক নতুন উদ্যোগে সন্তানসম্ভবা মায়েদের সেবায় মিডওয়াইফারি মডেল বাস্তবায়নে ছয় চ্যাম্পিয়ন দেশের একটি হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এই অর্জন স্পষ্টত ধাত্রী মায়েদের সেবা জোরদারে বিনিয়োগের সুফল তুলে ধরেছে। তারা দেশজুড়ে মাতৃস্বাস্থ্য সেবাসহ সমন্বিত যৌন ও প্রজনন সেবা দিয়ে থাকেন। সরকারের নেতৃত্বে ও উন্নয়ন অংশীজনদের সহায়তায় বাংলাদেশ হাজার হাজার পেশাজীবী ধাত্রীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়োজিত করেছে। তারা দেশজুড়ে বিশেষত গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকার কমিউনিটির পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর মত মানবিক সহায়তা প্রয়োজন এমন জায়গাগুলোতেও জীবন-রক্ষাকারী মাতৃস্বাস্থ্য সেবা দিয়ে আসছেন। ধাত্রী মায়েদের সেবার মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ মাতৃ ও নবজাতকের মৃত্যু এবং মৃত সন্তান জন্মের ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
“বর্তমানে তহবিলের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী যে চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, তা এই অগ্রগতি অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। প্রতিটি নারী যেন মানসম্মত ধাত্রী সেবা পান, যেটা কিনা তার প্রয়োজন ও প্রাপ্য, সেটা নিশ্চিতে ধাত্রী সেবা এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা, বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।”