ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ককে নেতিবাচক হিসাবে বর্ণনা করেছেন ৫৮ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা। চীনের ক্ষেত্রে এই হার ২ শতাংশ।
Published : 11 Mar 2025, 09:10 PM
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রেক্ষাপটে চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব কী, তা উঠে এসেছে এক জরিপে।
মঙ্গলবার প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে চীনের জাতীয় ভাবমূর্তি’ শীর্ষক ওই জরিপে দেখা যায়, ৭৫ শতাংশের বেশি মানুষ বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। আর দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে দেখছেন মাত্র ১১ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ।
জাপানের ক্ষেত্রেও মানুষের ইতিবাচক মনোভাব চীনের কাছাকাছি; প্রায় ৭৫ শতাংশ। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন প্রায় ৫৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ককে নেতিবাচক হিসাবে বর্ণনা করেছেন ৫৮ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা। চীনের ক্ষেত্রে এই হার ২ শতাংশ।
গত অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে সারাদেশের ৫ হাজার ৩৩৫ জনে মানুষের মধ্যে এই জরিপ পরিচালনা করেছে সেন্টার ফর অল্টারনেটিভস।
ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের উপস্থিতিতে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, “প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাংলাদেশের বিকাশমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন, বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রেক্ষাপটে?”
জরিপে ওই প্রশ্নের উত্তরের ক্ষেত্র সাতটি দেশ ও সংস্থাকে আলাদা করে উত্তর দেওয়ার জন্য বিকল্প ছিল- ‘ইতিবাচক’, ‘মিশ্র’, ‘জানি না’ এবং ‘নেতিবাচক’।
চীনের ক্ষেত্রে ৭৫ দশমিক ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা ‘ইতিবাচক’ বলেছেন; যা ভারতের ক্ষেত্রে ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ, জাপানের ক্ষেত্রে ৭৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ৫৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ৫৬ দশমিক ২২ শতাংশ, আসিয়ানের ক্ষেত্রে ৫২ দশমিক ২২ ভাগ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে ৫৮ দশমিক ১৪ শতাংশ।
নেতিবাচক বিকল্পে ভারতের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী উত্তর দিয়েছেন। চীনের ক্ষেত্রে ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, জাপানের ক্ষেত্রে ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ, আসিয়ানের ক্ষেত্রে ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা ‘নেতিবাচক’ বলেছেন।
জরিপে আরেকটি প্রশ্ন ছিল– “চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিকাশমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন, বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রেক্ষাপটে?”
এ প্রশ্নে ৬১ শতাংশ উত্তরদাতা ‘ইতিবাচক’ আর ৪ শতাংশ ‘নেতিবাচক’ বলেছেন। ‘ভালো কিংবা মন্দ কোনটাই নয়’-এমন মত দিয়েছেন ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা। আর ৯ শতাংশ বলেছেন ‘জানি না’।
২০২২ ও ২০২৩ সালের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের শেষে সেন্টার ফর অল্টারনেটিভস ৩২ জেলায় অনলাইন এবং অফলাইনে এই জরিপ পরিচালনা করে।
তিন বছরের জরিপ তুলনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের বিষয়ে মানুষের ইতিবাচক মনোভাব ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীন সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণ নিয়ে কথা বলেছেন ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা। ২০২৩ সালে এই হার ৪৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৪৭ শতাংশ ছিল।
উন্নয়ন সহযোগী বললে কোন দেশের নাম মাথায় আসে– এমন প্রশ্ন ২০২৩ সালের মত এবারও করা হয়েছিল।
এবার চীনের নাম বলেছেন ২৫ শতাংশ উত্তরদাতা। আর ২২ শতাংশ জাপান, ১১ শতাংশ ভারত, ১৫ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র, ১২ শতাংশ রাশিয়া, ৯ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ৬ শতাংশ দক্ষিণ কোরিয়াকে বেছে নিয়েছেন।
২০২৩ সালে ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা চীনের নাম বলেছিল। জাপানের ক্ষেত্রে আগেও ২২ শতাংশ ছিল। ওই বছর ১৮ ভাগ মানুষ ভারত, ১৩ ভাগ যুক্তরাষ্ট্র, ১০ ভাগ রাশিয়া, ৭ ভাগ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ৪ ভাগ দক্ষিণ কোরিয়ার কথা বলেছিল।
অনুষ্ঠানে চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, চীনের ভাবমূর্তি জরিপে কিছু ক্ষেত্রে অপরিবর্তিত অবস্থা এবং কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিস্থিতির কারণে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
“জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ উত্তরদাতা চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে অনুমোদন বা সমর্থন করেছে, যা সম্পর্কে বিষয়ে ঐকমত্যের ব্যাপকতার প্রতিফলন।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশ-চীনের ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের উন্নয়নকে আরও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দারুণ আশাবাদ দেখিয়েছেন উত্তরদাতারা।
“জনগণের সাথে জনগণের আদান-প্রদান এবং সহযোগিতা জোরদার করার জন্য বাংলাদেশি জনগণের মতামত এবং পরামর্শের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া উচিত।”
ইয়াও ওয়েন বলেন, “এটা আমাদের জন্য আনন্দের যে, ৭৫ শতাংশ উত্তরদাতা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য চীনে ব্যক্তিগতভাবে যেতে বা তাদের সন্তানদের পাঠাতে ইচ্ছুক। এই হার ২০২২ সালের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। প্রায় ২৯ শতাংশ বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য চীনে যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন, যা ২০২২ সালের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি।”
বাংলাদেশে আরও বেশি চীনা কোম্পানির বিনিয়োগ নিয়ে আসার চেষ্টা অব্যাহত রাখার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৪টি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে মোট ২৩ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে ইয়াও ওয়েন বলেন, “মিয়ানমারে রাজনৈতিক সংকট মেটানোর লক্ষ্যে অস্ত্রবিরতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। রোহিঙ্গারা যাতে নিজেদের আদি নিবাসে ফিরতে পারেন সেই জন্যই আমাদের এই প্রয়াস।”
অন্যদের মধ্যে ফরেন সার্ভিস একাডেমির সাবেক রেক্টর মাশফী বিনতে শামস, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আমেনা মোহসিন, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক সৈয়দ শাহনেওয়াজ মহসিন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।