এমপিওভুক্তির দাবিতে রাজধানীতে শিক্ষা ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা।
Published : 17 Oct 2024, 12:29 AM
দাবি আদায়ের কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাবা যাবেন ঢাকায়, তার সঙ্গে যাওয়ার বায়না ধরে উসমী মণ্ডল প্রীতি। নাছোড় ছয় বছরের কন্যাকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গে করে খুলনা থেকে রাজধানীতে এসেছেন কলেজ শিক্ষক উত্তম কুমার মণ্ডল।
ছোট্ট প্রীতিকে নিয়ে মঙ্গলবার সরাসরি সচিবালয়ের কাছে আব্দুল গনি রোডে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সামনের অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেন তিনি।
সেখানে এমপিওভুক্ত হওয়ার দাবিতে বেসরকারি কলেজ শিক্ষক উত্তমের হাজার দেড়েক সহকর্মী দুই দিন ধরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।
কর্মসূচির প্রথম দিন অবস্থান শেষে সন্ধ্যায় বাড্ডায় এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে ওঠেন। পরদিন সকালে আবার মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন অবস্থান কর্মসূচির স্থানে।
পরপর দুই দিন এ কর্মসূচি পালন করেছেন বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স কোর্স পড়ানো শিক্ষকরা।
ছয় বছরের প্রীতিকে নিয়ে আসার বিষয়ে খুলনার আমাদী কয়রার খান সাহেব কোমর উদ্দিন কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক উত্তম কুমার মণ্ডল বলেন, বাবার সঙ্গে বেশি সখ্যতা মেয়ের। বাবা ঢাকা যাবেন, অবস্থান কর্মসূচি করবে। তাকে কোনোভাবেই রেখে আসা গেল না।
দিনভর বাবার পাশে থেকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে শিশুটিকে। সেখানে হাজার দেড়েক নারী ও পুরুষ শিক্ষকের সঙ্গে প্রীতির মত আরও অনেক শিশুদের দেখা গেল।
বুধবার রাত সাড়ে ১০ টায়ও এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষককে শিক্ষা ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে থাকতে দেখা গেছে। এসময় কাউকে রাস্তায় শুয়ে ও বসে থাকতে দেখা যায়।
তাদের দাবির বিষয়ে নিজের উদাহরণ দিয়ে উত্তম বললেন, নিয়োগ পেয়েছেন ছয় বছর আগে। কিন্তু এমপিওভুক্ত না থাকায় যে বেতন পান তাতে সংসারের ব্যয় সামলাতে গিয়ে ঋণ যেন বেড়েই চলছে।
”আমার যখন নিয়োগ হয়, তখন যে ফর্ম দিয়েছিল, সেই ফর্ম দেখার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিছুদিন পরে জানতে পারি আমি এমপিওভুক্ত নই। আমাকে কোনো বেতনও দেয় না, মাত্র ৫ হাজার টাকা সম্মানী দেয়। এতে সংসারের ঋণ যেন বেড়েই চলছে। সন্তানের জন্যও কিছু করতে পারি নাই এতদিনে। এমপিও ভুক্ত হলে অন্তত আত্মসম্মান নিয়ে অনটন কিছুটা কাটিয়ে বাঁচতে পারব।”
নিয়োগ পাওয়ার দীর্ঘ সময় পরও উত্তমের মত অনেক বেসরকারি কলেজের শিক্ষক এমপিওভুক্ত হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ৩২ বছর পরও এ সুবিধা পাচ্ছেন না।
এমন সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষকের পক্ষে ’শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১’ এ অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে মঙ্গল ও বুধবার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশন।
ফেডারেশনের সভাপতি নেকবর হোসেন বলেন, “আমাদের এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। আমরা দাবি পূরণ না করে যাব না। এত রাতেও পাঁচ শতাধিক শিক্ষক শিক্ষা ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে আছি। দিনের বেলা আমাদের এই কর্মসূচিতে অন্তত হাজারখানেক শিক্ষক ছিলেন।
“শিক্ষকরা বিনা বেতনে কাজ করছে। ৩২ বছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এটা একটা বৈষম্য। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দেশ স্বাধীন করা হয়েছে। তাহলে এখনও বৈষম্য থাকবে কেন? মাসে কেউ সম্মানী পায় দুই হাজার, তিন হাজার বা পাঁচ হাজার। এটা দিয়ে তো নিজের খরচই চলে না। সংসার চালাবে কীভাবে? আমরা শিক্ষক, আমরা সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই।”
তাদের দাবি
>> জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতি বিভাগের অনার্স কোর্সের ৫ জন এবং মাস্টার্স কোর্সের ৭ জন শিক্ষককে প্রচলিত ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১’ এ অর্ন্তভুক্ত করা; এমপিও প্রদান করে যোগ দেওয়ার তারিখ থেকে অভিজ্ঞতা গণনা করতে হবে।
>> সহকারী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিতে হবে (যেমন-বিভাগীয় প্রধান, প্রশিক্ষক, উপাধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ হওয়ার সুযোগ)।
দাবির পক্ষে তাদের যুক্তি
>> আগের সরকার ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১’ এ এসব শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করেনি; ফলে ৩,৫০০ জন শিক্ষক আর্থ-সামাজিকভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
>> একই কলেজে একই নিয়ম ও যোগ্যতায় নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু শিক্ষক এমপিওভুক্ত হবেন আর কিছু শিক্ষক নন-এমপিও, যা মানবতাবিরোধী ও চরম বৈষম্যের।
>> অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষকদের ‘জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালায়’ অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একাধিকবার নির্দেশনা থাকলেও অদৃশ্য কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন তা বাস্তবায়ন করেনি।
>> মাদরাসা কারিকুলামে কামিল শ্রেণি (যা মাস্টার্সের সমমান) এমপিওভুক্ত হলে জেনারেল শিক্ষায় বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সকে এমপিওভুক্ত করা সময়ের দাবি।
>> বর্তমানে মাত্র বার্ষিক ১০৪ কোটি ৯ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেই বর্তমানে ৩,৫০০ জন অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করা সম্ভব।
>> রিট আবেদন করা হলে হাই কোর্ট বিভাগ এমপিওভুক্তির আদেশ দেয়। তবে ফেডারেশনের অভিযোগ, কোনো শুনানির সুযোগ না দিয়ে আপিল বিভাগ ওই রায়কে বাতিল করে দেয়।