সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
Published : 25 Oct 2022, 01:50 AM
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে, দেয়াল ধসে, নৌযান দুর্ঘটনায় কিংবা পানিতে ডুবে দেশের ১৫ জেলায় অন্তত ২৯ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
ভারি বর্ষণ আর স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সঙ্গী করে সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। এর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই ঝড়ো হাওয়া আর ভারী বর্ষণ শুরু হয় উপকূলের জেলাগুলোতে।
সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন উপকূলীয় জেলায় গাছ ভেঙে সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর আসতে থাকে, বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে বহু এলাকা অন্ধকারে ডুবে যায়।
ঝড়ের মধ্যে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে বঙ্গোপসাগরে বালুর ড্রেজার ডুবে আটজন নিখোঁজ হওয়ার পর চার শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সীতাকুণ্ডে জোয়ারের পানিতে ভেসে এসেছে এক শিশুর লাশ, যে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল বলে পুলিশের ধারণা।
ভোলা সদর, দৌলতখান, লালমোহন ও চরফ্যাশনে মারা গেছেন চারজন। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ঝড়ো বাতাসে ঘরের ওপর গাছ পড়ে প্রাণ গেছে এক দম্পতি এবং তাদের চার বছরের শিশুর।
কক্সবাজারের টেকনাফে এক বিদেশি নাগরিক এং শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুজন করে; নড়াইলের লোহাগড়া, বরগুনা সদর, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এবং শরীয়তপুরের জাজিরায় একজন করে মারা গেছেন ঝড়ের মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে।
সিরাজগঞ্জের সদরে যমুনা নদীর একটি খালে নৌকা ডুবে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে।পটুয়াখালীতে ট্রলার ডুবে মারা গেছেন এক শ্রমিক। দেয়াল ধসে ঢাকার হাজারীবাগ ও গাজীপুরের কাপাসিয়ায় দুজনের প্রাণ গেছে।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর–
চট্টগ্রামে ড্রেজার ডুবি, লাশ উদ্ধার
বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে একটি বালুর ড্রেজার বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়ার পর চার শ্রমিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছে আরও চারজন।
মীরসরাইয়ের ইউএনও মিনহাজুর রহমান জানান, রাতে ঝড় শুরু হলে বামনসুন্দর খাল ও বঙ্গোপসাগরের সংযোগ অংশে ‘সৈকত এন্টারপ্রাইজ-২' নামের ড্রেজারটি ডুবে যায়। সে সময় আট শ্রমিক ভেতরে আটকা পড়েন।
ডুবুরিরা মঙ্গলবার রাত সোয়া ৯টার দিকে ড্রেজারের ভেতর থেকে এক শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করেন। বুধবার সকালে মেলে আরও তিনজনের লাশ। বাকি তিনজনের কোনো খোঁজ তখনও মেলেনি। তাদের সবার বাড়ি পটুয়াখালীর জৈনকাঠি এলাকায়।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় থেমে যাওয়ার পর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সাগর উপকূলে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা এক কন্যা শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে; পুলিশের ধারণা, জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল শিশুটি।
মঙ্গলবার সকালে উপজেলার কদমরসুল এলাকার একটি শিপইয়ার্ডে আনুমানিক তিনমাস বয়সী শিশুটির লাশ এসে ঠেকে বলে নৌ পুলিশ জানায়।
নৌ পুলিশের কুমিরা ফাঁড়ির পরিদর্শক বিদ্যুৎ বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে কাসোরা শিপ রিসাইকেলিং ইয়ার্ডে সাগরের জোয়ারে কন্যা শিশুটির লাশটি ভেসে আসে। আমাদের ধারণা, লাশটি ঘূর্ণিঝড়ের সময় নিখোঁজ কোনো শিশুর। জোয়ারের পানিতে ভেসে সেটি উপকূলে চলে এসেছে।”
ভোলায় ৪ মৃত্যু
ঝড়ের মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে ভোলার দৌলতখান, চরফ্যাশন ও সদর উপজেলায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া লালমোহনে জোয়ারের পানিতে ডুবে এক নারীর মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
দৌলতখান উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদুল ইসলাম জানান, ঝড়ের মধ্যে পৌর শহরে একজন নিহত ও তিনজন আহত হন। নিহত নারীর নাম বিবি খাদিজা (৮০) বলে জানা গেছে। তিনি দৌলতখান পৌরসভায় মৃত গোলাম মোস্তফার স্ত্রী।
পরিবারের সদস্যরা জানান, সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘরের ওপর গাছ পড়লে ওই বৃদ্ধা নিচে চাপা পড়েন। আত্মীয়-স্বজনরা উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
চরফ্যাশনের ইউএনও আল নোমান বলেন, সেখানে আলম স্বর্ণকার নামে এক ব্যক্তি ভেঙে পড়া গাছের ডালের সঙ্গে আঘাত পেয়ে নিহত হয়েছেন। তিনি উপজেলার এওয়াজপুর এলাকার বাসিন্দা।
পরিবারের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, তিনজন মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। পথে ঝড়ে একটি গাছের ডাল ভেঙে পড়েছিল। চালক ডালের নিচ দিয়ে গিয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারলেও আলম ডালে আঘাত পান। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এছাড়া ভোলা সদরের ধনিয়া এলাকায় গাছ চাপা পড়ে মফিজল হক নামে ৬২ বছরের এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয় বলে সদরের ইউএনও তৌহিদুর ইসলাম জানিয়েছেন।
এদিকে লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ফাতেমাবাদ গ্রামে জোয়ারের পানিতে ডুবে রাবেয়া বেগম নামে ২৫ বছর বয়সী এক তরুণীর মৃত্যু হয়।
লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আবুল কাশেম জানান, রাত সাড়ে ৩টার দিকে জোয়ারের পানি বেড়ে রাবেয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে। তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে অন্য ঘরে যাওয়ার সময় তিনি পানিতে ডুবে যান।
লালমোহন থানার ওসি মো. মাহবুবুর রহমান জানান, রায়ের লাশ মর্গে পাঠাতে সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়েছে।
কুমিল্লায় তিন মৃত্যু
ঝড়ের মধ্যে রাত ১১টার দিকে নাঙ্গলকোট উপজেলার হেসাখাল ইউনিয়নের হেসাখাল পশ্চিম পাড়ায় গাছ ভেঙে ঘরের উপর পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলেন- হেসাখাল পশ্চিম পাড়া গ্রামের নিজাম উদ্দিন, তার স্ত্রী শারমিন আক্তার সাথী এবং তাদের মেয়ে চার বছরের শিশু নুসরাত আক্তার লিজা।
হেসাখাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ইকবাল বাহার বলেন, “ঝড়ো বাতাসে বড় একটি গাছ উপড়ে তাদের ঘরের ওপর পড়ে। পরে ভেতর থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।”
নাঙ্গলকোট থানার ওসিফারুক হোসেন বলেন, ঘরের ওপর পড়া গাছটি সরানোর চেষ্টা করছেন তারা। ওই তিনজন ছাড়া আরও কেউ চাপা পড়েছে কি-না, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জে মা ও ছেলের মৃত্যু
ঝড়ের সময় সিরাজগঞ্জ সদরে যমুনা নদীর একটি খালে নৌকা ডুবে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের পূর্বমোহন ও শিল্পপার্কের মাঝামাঝি এলাকার খালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বৈঠাচালিত নৌকাটি শিল্পপার্ক থেকে পূর্বমোহনপুরে যাচ্ছিল।
মৃত দুজন হলেন– উপজেলার পূর্বমোহনপুর গ্রামের খোকনের স্ত্রী আয়েশা খাতুন (২৮) এবং তার ছেলে আরাফাত হোসেন (২)।
বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ওসি মোসাদ্দেক হোসেন জানান, ওই নৌকায় চড়ে মোট ছয়জন পূর্বমোহনপুরে তাদের বাড়িতে ফিরছিলেন। মাঝপথে ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে নৌকাটি ডুবে যায়।
“আরাফাত মায়ের কোলে ছিল, সে নদীতে ডুবে মারা যায়। স্থানীয়রা আয়েশা খাতুনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। তবে নৌকায় থাকা অন্যরা সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হনে।”
মুন্সীগঞ্জে মা ও মেয়ের মৃত্যু
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় ঝড়ের সময় ঘরের ওপর গাছ পড়ে মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন মেয়েটির বাবা।
নিহতরা হলেন- গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী আছমা বেগম (২৮) এবং তাদের চার বছর বয়সী মেয়ে সুরাইয়া বেগম।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াছিন ফেরদৌস জানান, মাঝরাতের দিকে রাজ্জাকের ঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে। তাতে ঘটনাস্থলেই মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়। স্থানীয়রা পরে রাজ্জাককে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।
পেশায় রিকশাচালক রাজ্জাকের (৩৫) কোমর ভেঙে গেছে। তাকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়েছে।
কক্সবাজারে মিয়ানমারের নাগরিক ও শিশুর মৃত্যু
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরে আসা একটি জাহাজে মিয়ানমারের এক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। আর টেকনাফ পৌরসভায় একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক শিশুর লাশ।
টেকনাফ স্থলবন্দরের মহাব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, মৃত শৌমিং (৭১) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আকিয়াব শহরের ঢৌমিং এর ছেলে; তিনি ওই জাহাজের পাচক ছিলেন।
এক সপ্তাহ আগে মিয়ানমার থেকে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজটি টেকনাফ বন্দরে অবস্থান করছিল। সোমবার রাতে শৌমিং রান্নার কাজ শেষে জাহাজে থাকা অন্যদের খাবার তুলে দিচ্ছিলেন। ঝড়ো হওয়ার কবলে পড়ে তিনি ডেক থেকে নিচে পড়ে যান এবং ঘটনাস্থলেই মারা যান।
এদিকে টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়ায় সোমবার বিকালে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পুকুর পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় সোহেনা নামের ৯ বছরের একটি মেয়ে পরে গিয়ে ডুবে যায়। মঙ্গলবার সকালে পুকুরে তার লাশ পাওয়াযায় বলে টেকনাফ পৌরসভার ৯ নাম্বার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নুরুল বশর নওশাদ জানান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২ মৃত্যু
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় ঝড়ের সময় ঘরের উপর গাছ পড়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে; আহত হয়েছেন তার স্ত্রী।
অন্যদিকে নবীনগর উপজেলায় ঝড়ে বিধ্বস্ত সঞ্চালন লাইন ঠিক করতে গিয়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পানিতে পড়ে আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে।
নিহতরা হলেন- কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের ধ্বজনগর গ্রামের মৃত সিরাজ মিয়ার ছেলে জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া (২৬) এবং সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের আলী মিয়ার ছেলে রিপন মিয়া (২৮)।
কসবার ইউএনও মাসুদ উল আলম জানান, সোমবার রাতে ঝড়ের সময় জয়নাল ও তার স্ত্রী ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। এ সময় একটি গাছ ভেঙে ঘরের উপর পড়ে। এতে গাছ চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। তার স্ত্রী নিপা আক্তার আহত হন।
নবীনগরের ইউএনও একরামুল সিদ্দিক জানান, মঙ্গলবার সকালে উপজেলার বিটঘর ইউনিয়নের টিয়ারা গ্রামে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পল্লীবিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন মেরামতের জন্য রিপন খুঁটিতে ওঠেন। এ সময় বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ ভেঙে তিনি পানিতে পড়ে যান। জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গোপালগঞ্জে গাছ চাপায় দুই নারীর মৃত্যু
রাতে ঝড়ের মধ্যে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাঁচ কাহনীয়া ও বাঁশবাড়িয়া গ্রামে গাছ চাপা পড়ে দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে।
তারা হলেন–পাঁচ কাহনীয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী শারমিন বেগম (২৫) এবং বাঁশবাড়িয়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রুমিছা বেগম (৬৫)।
টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি আবুল মনসুর বলেন, ঝড়ের সময় শারমিন বেগম ঘরের বারান্দায় বসে কাজ করছিলেন। হঠাৎ একটি গাছ ভেঙে ঘরের বারান্দায় পড়ে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
আর রুমিছা বেগমের বাড়িতে যখন গাছ ভেঙে ঘরে পড়ে, তিনি তখন ঘরে শুয়ে ছিলেন। তিনিও ঘটনাস্থলে মারা যান বলে জানান ওসি।
পটুয়াখালীতে ট্রলার ডুবে শ্রমিকের মৃত্যু
পটুয়াখালীতে ঝড়ের মধ্যে নোঙ্গর করা ইটভর্তি একটি ট্রলার ডুবে নিখোঁজ এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।
নিহত নূর ইসলাম (৪০) সদর উপজেলার লোহালিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরপুর গ্রামের রশিদ মোল্লার ছেলে।
সোমবার রাত ৮টার দিকে প্রতাপপুর লঞ্চঘাটে নোঙ্গর করা অবস্থায় ঢেউয়ের তোড়ে ট্রলারটি লোহালিয়া নদীতে ডুবে যায়। ট্রলারের মালিক জলিল মোল্লা সাঁতরে তীরে ফিরতে সক্ষম হলেও নূর ইসলাম ডুবে যান।
ঝড় কেটে যাওয়ার পর মঙ্গলবার সকাল থেকে তিন ঘণ্টা তল্লাশি চালিয়ে ডুবুরিরা ডুবে যাওয়া ওই ট্রলার থেকে নূরের লাশ উদ্ধার করে বলে জানান পটুয়াখালী নদী ফায়ার স্টেশনের টিম লিডার মো. মজিবর রহমান।
পটুয়াখালীর একটি ইট ভাটা থেকে ২৫ হাজার ইট নিয়ে মুরাদিয়া যাচ্ছিলেন ট্রালার মালিক জলিল মোল্লা। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে তিনি লঞ্চঘাটে ট্রলার নোঙ্গর করেছিলেন।
নড়াইলে নারীর মৃত্যু
ঘূর্ণিঝড় উপকূলে পৌঁছানোর আগেই দুপুরে ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ডাল ভেঙে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ চত্বরে এ ঘটনা ঘটে বলে লোহাগড়া থানার ওসি মো. নাসির উদ্দীন জানান।
নিহত মর্জিনা বেগম (৪০) বাগেরহাট সদর উপজেলার অর্জনবাহার গ্রামের বাসিন্দা। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ১১ বছরের ছেলেকে নিয়ে তিনি লোহাগড়া পৌর এলাকার রাজপুর গ্রামের আবদুল গফ্ফারের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন বিভিন্ন বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন তিনি।
দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা পরিষদ চত্বর দিয়ে যাওয়ার সময় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সামনে পৌঁছালে একটি মেহগনি গাছের ডাল ভেঙে তার মাথায় পড়ে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। লোকজন তাকে লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নাদিরা ভূঁইয়া বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। তার মাথায় আঘাত ছিল।
লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজগর আলী বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে। নিহতের পরিবারকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
বরগুনায় শতবর্ষী বৃদ্ধার মৃত্যু
বরগুনা সদর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে গাছের নিচে চাপা পড়ে শতবর্ষী এক বৃদ্ধার প্রাণ গেছে।
সোমবার রাত সাড় ৮টার দিকে উপজেলার ৬ নম্বর বুড়িরচর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সোনাখালী বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাওসার হোসেন জানান।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মাইন উদ্দীন ময়না জানান, ওই নারীর নাম আমেনা খাতুন। সন্ধ্যার আগেই তার পরিবারের সদস্যদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তারা রাজি হননি। এমনকি আমেনা খাতুন তার স্বজনদের ঘরেও যাননি।
“উনি ছোট্ট একটি ঘরে একা থাকতেন। ঘরের পাশে থাকা চাম্বল গাছ উপড়ে পড়লে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পরে স্বজনরা গাছ সরিয়ে তার মরদেহ উদ্ধার করে।”
ইউএনও কাওসার হোসেন বলেন, “আমরা আমেনা খাতুনের বাড়ি গিয়ে বিস্তারিত জেনেছি। তার দাফনসহ সার্বিক সহযোগিতা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হবে।”
শরীয়তপুরে গৃহবধূর মৃত্যু
ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের মধ্যে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলায় গাছ চাপা পড়ে এক গৃহবধূর প্রাণ গেছে।
মঙ্গলবার সকালে উপজেলার কুণ্ডেরচর ইউনিয়ন পরিষদের সিদারচর এলাকা থেকে পুলিশ সাফিয়া বেগম নামের ৫৫ বছর বয়সী ওই নারীর লাশ উদ্ধার করে।
জাজিরা থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, রাতে ঝড়ের সময় সাফিয়া তার ঘরের ভেতরেই ছিলেন। প্রবল বাতাসে গাছ ভেঙে তার ঘরের উপর পড়লে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তর জন্য জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায় পুলিশ।
নোয়াখালীতে শিশুর মৃত্যু
ঝড়ে ঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এক বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
সানজিদ আফ্রিদি নামের শিশুটি পূর্ব চরবাটা গ্রামের মো. আবদুল্লাহর ছেলে। তার মা সানজিদা খানমও গুরুতর আহত হয়েছেন।
চরজব্বর থানার ওসি দেবপ্রিয় দাশ জানান, রাতে বসতঘরের ওপরে গাছ পড়লে ঘটনাস্থলেই শিশুটির মৃত্যু হয়। তার মাকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করেন স্থানীয়রা।
গাজীপুরে মাটির ঘরের দেয়াল ধসে শিশুর মৃত্যু
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রবল বর্ষণে মাটির দেয়াল ধসে পড়ে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে; আহত হয়েছেন আরও পাঁচ জন।
উপজেলার কড়িহাতা এলাকায় সোমবার মধ্যরাতে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে কাপাসিয়া থানার ওসি এএফএম নাসিম জানান।
মৃত আনিসুর রহমান (৯) স্থানীয় ইকুরিয়া গ্রামের দিনমজুর বেলায়েত মোল্লার ছেলে। তারা একটি টিনের ঘরে থাকে। তাদের ঘরের পাশে চাচাতো ভাই মো. মনসুরের মাটির ঘর ছিল।
ওসি বলেন, মধ্যরাতে ভারি বৃষ্টি হলে মনসুরের মাটির ঘরের দেয়াল ধসে বেলায়েতের টিনের ঘরের উপর পড়ে। তাতে আনিসুর ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বেলায়েতের স্ত্রী, আরেক ছেলে ও দুই মেয়ে আহত হয়। পরে প্রতিবেশীরা তাদের উদ্ধার করে কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়।
কাপাসিয়ার ইউএনও একেএম গোলাম মোর্শেদ বলেন, বসত ঘর মেরামত ও চিকিৎসার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
ঢাকায় রিকশাচালকের মৃত্যু
সিত্রাংয়ের প্রভাবে বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে ঢাকার হাজারীবাগে দেয়াল ধসে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার সন্ধ্যায় জিগাতলার মনেশ্বর রোডে এ ঘটনায় আহত হয়েছেন এক মোটর সাইকেল চালক।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, স্থানীয় লোকজন দুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে এলে রিকশাচালককে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ওই ব্যক্তির নাম পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
আহত মোটর সাইকেল চালককে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
হাজারীবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এনামুল হক খন্দকার বলেন, “ঘটনার সময় বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। নিহত ব্যক্তি রিকশা নিয়ে যাচ্ছিলেন। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন বাইক আরোহী। তখন চারতলা একটি ভবনের ছাদের রেলিং ধসে পড়ে।”