কুনিও হোশি হত্যা: ৪ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড বহাল, একজন খালাস

ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক চেজারে তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিনের মাথায় একই কায়দায় রংপুরে এই জাপানি নাগরিককে হত‌্যার ওই ঘটনা সে সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ‌্যমেও আলোড়ন তোলে।

নিজস্ব প্রতিবেদক
Published : 21 Sept 2022, 06:01 AM
Updated : 21 Sept 2022, 06:01 AM

রংপুরে সাত বছর আগে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যার দায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) চার জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে একজনকে খালাস দিয়েছে হাই কোর্ট।

মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের আবেদন (ডেথ রেফারেন্স) এবং আসামিদের আপিল শুনানি শেষে বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ রায় দেয়।

রায়ে জেএমবির রংপুর অঞ্চলের কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুন ওরফে মন্ত্রী (৩৩), ওই জঙ্গি সংগঠনের সদস‌্য লিটন মিয়া ওরফে রফিক (৩২), সাখাওয়াত হোসেন (৩০) এবং পলাতক আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লবের (২৪) মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে  হাই কোর্ট।

জজ আদালতে মৃতুদণ্ড পাওয়া ইছাহাক আলীর (৩৪) আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে এই রায়ে।  

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আহসানউল্লাহ এবং এক পলাতক আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হাফিজুর রহমান খান।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইছাহাক আলী কীভাবে খালাস পেয়েছেন তা শর্ট অর্ডারে উল্লেখ নেই, আমরা সম্পূর্ণ রায় পেয়ে এ বিষয়টি দেখব।”

সম্পূর্ণ রায় পাওয়ার পর ইছাহাক আলীর খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয় ৬৬ বছর বয়সি জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে।

ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক চেজারে তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিনের মাথায় একই কায়দায় রংপুরে এই জাপানি নাগরিককে হত‌্যার ওই ঘটনা সে সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ‌্যমেও আলোড়ন তোলে।

এ মামলার অভিযোগপত্রে আট আসামির নাম থাকলেও তাদের দুজন আগেই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

বিচার শেষে ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রংপুরের বিশেষ জজ নরেশ চন্দ্র সরকার রায় ঘোষণা করেন। তাতে ওই পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

সেই রায়ে বিচারক বলেছিলেন, “দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করাই ছিল বিদেশি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যার উদ্দেশ্য। দেশের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হওয়ায় পাঁচ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য বলে আমি মনে করি।”

এরপর ওই বছরের ৭ মার্চ নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স আসে হাই কোর্টে। পাশাপাশি আসামিদের পক্ষে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। গত ৪ সেপ্টেম্বর এ মামলার শুনানি শুরু করে বৃহস্পতিবার রায় দিল হাই কোর্ট।

রংপুরেই শেষ ঘুম

উত্তর-পূর্ব জাপানের ইওয়াতে জেলার কুনিও হোশি লেখাপড়া শেষে চলে এসেছিলেন তোচিগি শহরে। সেখানেই রংপুর নগরীর মুন্সীপাড়ার জাকারিয়া বালার ভাইয়ের সঙ্গে তার পরিচয়।

এর সূত্র ধরে অকৃতদার কুনিও ২০১১ সালে প্রথম রংপুরে আসেন। পরে ২০১৫ সালের ১ মে রংপুরে এসে জাকারিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করেন। কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে গড়ে তোলেন জাপানি কয়েল ঘাসের খামার।

আলুটারি গ্রামের মানুষ কুনিও হোশিকে নিপাট ভদ্রলোক বলেই জানত। বেশ কিছুদিন থাকায় ভাঙা বাংলায় কথা বলেতেও শিখেছিলেন এই বিদেশি। কারও সাথে দেখা হলে সালাম দিতেন, কেউ সালাম দিলে জবাবও দিতেন।

কুনিও নিহত হওয়ার পর তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের খবর গণমাধ্যমে আসতে শুরু করে। স্থানীয়রা দাবি করেন ইসলাম গ্রহণ করে কুনিও ‘গোলাম মো. কিবরিয়া’ নাম নিয়েছিলেন। বাড়ির পাশের মসজিদে তাকে শুক্রবার জুমার নামাজ এবং মুন্সিপাড়া কবরস্থান মাঠে ঈদের নামাজ পড়তে দেখার কথাও তারা বলেন।

মুন্সিপাড়া কাদেরিয়া জামে মসজিদের ইমাম সিদ্দিক হোসেনের ভাষ‌্য, তার কাছেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ওই জাপানি। স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশ কয়েকজনের সামনেই তা হয়েছিল। স্থানীয়দের কাছে একটি ছবিও পাওয়া যায়, যাতে কুনিওকে মসজিদে টুপি পড়ে আরও অনেকের মাঝে বসে থাকতে দেখা যায়।

মুন্নাফ নামের এক ব‌্যক্তির রিকশায় চড়ে প্রতিদিন সকালে নিজের ঘাষের খামার দেখভাল করতে যেতেন  এই জাপানি।  ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর সেখানে যাওয়ার পথেই তিনি খুন হন।

ওই দিনই কাউনিয়া থানার তৎকালীন ওসি রেজাউল করিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পরপর আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস এর দায় স্বীকার করলেও সরকার তা নাকচ করে।

প্রথম দিকে পুলিশের তদন্ত স্থনীয় এক বিএনপি নেতাকে ঘিরে আবর্তিত হলেও পরে তাতে জঙ্গিদের যোগাযোগ পান তদন্তকারীরা।  

প্রায় নয় মাস তদন্তের পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী রংপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দেন। সেখানে জেএমবির আট জঙ্গিকে আসামি করে প্রাথমিক সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার ছয়জনকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, কুনিও হোশিকে লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলি করেন জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা। মোটর সাইকেলে তারা তিনজন ছিলেন। গুলি করার পর মোটর সাইকেলে করে তারা পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬৬ বছর বয়সী কুনিও।  

তিনি খুন হওয়ার পর জাপান দূতাবাসের কর্মকর্তারা রংপুর ঘুরে গেলেও লাশ হস্তান্তর ও শেষকৃত্যের বিষয়টি ঝুলে থাকে ধর্ম বদলের কারণে। পরে রংপুরের মেয়র শরফউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানেই কুনিও হোশির শেষকৃত্যের ব‌্যবস্থা করতে অনুরোধ করে জাপান কর্তৃপক্ষ।

হত‌্যাকাণ্ডের দশ দিনের মাথায় ব্যাপক গোপনীয়তার মধ্যে ২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর গভীর রাতে মুন্সীপাড়া কবরস্থানে মুসলিম রীতি অনুযায়ী দাফন করা হয় জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে। দাফনের রেজিস্ট্রারে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয় গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া হিসেবে।