কুনিও হোশি হত্যায় ৫ জঙ্গির ফাঁসির রায়

জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যার দায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) পাঁচ জঙ্গির ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত।

রংপুর প্রতিনিধিশাহজাদা মিয়া আজাদ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2017, 05:21 AM
Updated : 7 March 2017, 04:47 PM

রংপুরের বিশেষ জজ নরেশচন্দ্র সরকার মঙ্গলবার জনাকীর্ণ আদালতে দুই বছর আগের চাঞ্চল‌্যকর এ হত‌্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার এক আসামিকে খালাস দিয়েছেন তিনি।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয় ৬৬ বছর বয়সি জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে।

ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক চেজারে তাভেল্লা হতাকাণ্ডের পাঁচ দিনের মাথায় একই কায়দায় রংপুরে জাপানি নাগরিক হত‌্যার ওই ঘটনা সে সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ‌্যমেও আলোড়ন তোলে।

মামলার অভিযোগপত্রে আট আসামির নাম থাকলেও তাদের দুজন আগেই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। বাকি ছয় আসামির মধ‌্যে পাঁচজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

রায়ে জেএমবির রংপুর অঞ্চলের কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুন ওরফে মন্ত্রী (৩৩), ওই জঙ্গি সংগঠনের সদস‌্য ইছাহাক আলী (৩৪), লিটন মিয়া ওরফে রফিক (৩২), সাখাওয়াত হোসেন (৩০) এবং পলাতক আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লবের (২৪) ফাঁসির আদেশ দেন বিচারক।

পাশাপাশি ওই পাঁচজনের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন তিনি।

বিচারক তার ৬২ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, “দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করাই ছিল বিদেশি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যার উদ্দেশ্য। দেশের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হওয়ায় পাঁচ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য বলে আমি মনে করি।”

রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় কারাগারে আটক জেএমবি সদস্য আবু সাঈদকে (২৮) বেকসুর খালাস দেন বিচারক।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন রথীশচন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনা। অন‌্যদিকে আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবুল হোসেন।

এই রায় ঘিরে সোমবার রাত থেকেই রংপুর জজ আদালত এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব‌্যবস্থা করা হয়। মঙ্গলবার সকাল থেকে আদালতের সবগুলো ফটকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকতে দেখা যায়। আইনজীবী ও সংবাদকর্মী ছাড়া অন‌্য কাউকে রায়ের আগে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

সকাল সোয়া ৯টায় কারাগারে থাকা পাঁচ আসামিকে আদালতে নিয়ে আসার পর সাড়ে ৯টার দিকে রায় পড়া শুরু করেন বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার। বেলা সোয়া ১১টায় দিকে আসামিদের সাজার ঘোষণা আসে।

কুনিও হোশি

প্রতিক্রিয়া

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক বলেন, “আমরা প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি। এ রায়ের মাধ্যমে অপর জঙ্গিরা ধর্মের নামে মানুষ হত্যার মত অপরাধ থেকে বিরত থাকবেন।”

এক আসামির সাজা না হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “আদালত বলেছে, তথ‌্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সাঈদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এ কারণে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আমরা নথিপত্র পর্যালোচনা করে পরে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।”

অন‌্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আবুল হোসেন বলেন, “ন্যায্য বিচার পাইনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।”

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মাসুদ রানার স্ত্রী আলেমা বেগমও রায়ের সময় উপস্থিত ছিলেন আদালতে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “অন্যায়ভাবে আমার স্বামীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তিনি এ ঘটনার সঙ্গে কোনোদিন জড়িত ছিলেন না। আমরা আপিল করব।”

একই কথা বলেন মাসুদ রানার বড় বোন হনুফা খাতুন। তবে অন্য আসামিদের পরিবারের কেউ কথা বলতে চাননি।

এই স্থানে হামলার শিকার হন কুনিও হোশি

বিচারের ১৭ মাস

আলুটারি গ্রামে দুই একর জমি ইজারা নিয়ে কুনিও যে ঘাসের আবাদ করেছিলেন, মুন্নাফ নামের এক ব‌্যক্তির রিকশায় চড়ে প্রতিদিন সকালে সেই খামার দেখভাল করতে যেতেন তিনি। ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর সেখানে যাওয়ার পথেই তিনি খুন হন।

ওই দিনই কাউনিয়া থানার তৎকালীন ওসি রেজাউল করিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পরপর আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস এর দায় স্বীকার করলেও সরকার তা নাকচ করে।

প্রথম দিকে পুলিশের তদন্ত স্থনীয় এক বিএনপি নেতাকে ঘিরে আবর্তিত হলেও পরে তাতে জঙ্গিদের যোগাযোগ পান তদন্তকারীরা।  

প্রায় নয় মাস তদন্তের পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী গতবছর ৩ জুলাই রংপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দেন। সেখানে জেএমবির আট জঙ্গিকে আসামি করে প্রাথমিক সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার ছয়জনকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, কুনিও হোশিকে লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলি করেন জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা। মোটর সাইকেলে তারা তিনজন ছিলেন। গুলি করার পর মোটর সাইকেলে করে তারা পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬৬ বছর বয়সী কুনিও।  

অভিযোগপত্রে নাম না আসায় কুনিওর ব্যবসায়িক সহযোগী হুমায়ুন কবির হীরা, রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী খান বিপ্লব, রংপুর মহানগর যুবদলের সদস্য রাজীব হাসান সুমন ওরফে মেরিল সুমন, নওশাদ হোসেন রুবেল ওরফে ব্ল্যাক রুবেল, বিজয় দাশ এবং রংপুর নগরীর শালবন মিস্ত্রিপাড়ার কাজল চন্দ্র বর্মণ ওরফে ভরসা কাজল অভিযোগ থেকে অব‌্যাহতি পান।

হাকিম আদালত থেকে মামলাটি বিশেষ জজ আদালতে স্থানান্তরের পর ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর বিচারক অভিযোগ গঠনের মধ‌্য দিয়ে আসামিদের বিচার শুরু করেন বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার। 

চলতি বছর ৪ জানুয়ারি সাক্ষ‌্যগ্রহণ শুরুর পর ৬০ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে ৫৫ জনের সাক্ষ্য শোনে আদালত। আসামি মাসুদ রানা ও সাদ্দাম হোসেনের গুলিতে কুনিও মারা যান বলে তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানর ওসি আব্দুল কাদের জিলানী তার সাক্ষ্যে বলেন।

অন‌্যদিকে আসামি সাখাওয়াত হোসেন ওরফে রাহুলের পক্ষে তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়াবাড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল মজিদ মণ্ডল সাফাই সাক্ষ্য দেন।

রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ১৯ ফেব্রুয়ারি বিচারক রায়ের জন‌্য দিন ঠিক করে দেন।  

উপরে ঘড়ির কাঁটার দিকে মাসুদ রানা, ইসাহাক আলী, সাখাওয়াত হোসেন ওরফে রাহুল ও লিটন মিয়া

আসামি বৃত্তান্ত

কুনিও হোশি হত‌্যা মামলায় ফাঁসির রায় পাওয়া পলাতক বিপ্লবের বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার মকর রাজমাল্লী এলাকায়।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বিপ্লব গত বছরের জানুয়ারি থেকে অনুপস্থিত বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইব্রাহীম কবীর জানিয়েছেন।

দণ্ডাদেশ পাওয়া মাসুদ রানা, ইছাহাক আলী ও লিটন মিয়ার বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পশুয়া টাঙ্গাইলপাড়া এলাকায়। আর সাখাওয়াত হোসেন রাহুলের বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়ার চর এলাকায়।

তারা রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা এবং রংপুরে বাহাই নেতা রুহুল আমীন হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। এর মধ‌্যে বাহাই নেতা হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রে বিপ্লবের নামও রয়েছে।

আবু সাঈদ

অপর আসামি আবু সাঈদ এ মামলায় খালাস পেলেও ওই দুই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হওয়ায় আপাতত মুক্তি পাচ্ছেন না বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশচন্দ্র জানান।

কুনিও হত‌্যা মামলার অভিযোগপত্রে নাম থাকা পলাতক সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেরোরিজম পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

আর নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক নজরুল ওরফে হাসান গত বছরের ২ অগাস্ট ভোরে রাজশাহীতে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।

তদন্ত কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক জানান, রংপুর নগরীর নূরপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে আসামিরা দুই মাস ধরে কুনিও হোশিকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পাশাপাশি একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কেনে তারা, যেটি ব‌্যবহার করে কুনিওর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হত।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, কুনিওকে প্রথম গুলি করেন মাসুদ রানা। সেটি কুনিওর গলায় লাগে। তার সঙ্গী রাহুল এরপর গুলি করলে তা কুনিওর বুক ও হাতে লাগে। এতে ঘটনাস্থলেই ওই জাপানির মৃত‌্যু হয়।

টুপি পরা কুনিও হোশির ছবিটি স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া

রংপুরেই শেষ ঘুম

উত্তর-পূর্ব জাপানের ইওয়াতে জেলার কুনিও হোশি লেখাপড়া শেষে চলে এসেছিলেন তোচিগি শহরে। সেখানেই রংপুর নগরীর মুন্সীপাড়ার জাকারিয়া বালার ভাইয়ের সঙ্গে তার পরিচয়।

এর সূত্র ধরে অকৃতদার কুনিও ২০১১ সালে প্রথম রংপুরে আসেন। পরে ২০১৫ সালের ১ মে রংপুরে এসে জাকারিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করেন। কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে গড়ে তোলেন জাপানি কয়েল ঘাসের খামার।

আলুটারি গ্রামের মানুষ কুনিও হোশিকে নিপাট ভদ্রলোক বলেই জানত। বেশ কিছুদিন থাকায় ভাঙা বাংলায় কথা বলেতেও শিখেছিলেন এই বিদেশি। কারও সাথে দেখা হলে সালাম দিতেন, কেউ সালাম দিলে জবাবও দিতেন।

কুনিও নিহত হওয়ার পর তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের খবর গণমাধ্যমে আসতে শুরু করে। স্থানীয়রা দাবি করেন ইসলাম গ্রহণ করে কুনিও ‘গোলাম মো. কিবরিয়া’ নাম নিয়েছিলেন। বাড়ির পাশের মসজিদে তাকে শুক্রবার জুমার নামাজ এবং মুন্সিপাড়া কবরস্থান মাঠে ঈদের নামাজ পড়তে দেখার কথাও তারা বলেন।

মুন্সীপাড়া কবরস্থানে কুনিও হোশির কবর।

মুন্সিপাড়া কাদেরিয়া জামে মসজিদের ইমাম সিদ্দিক হোসেনের ভাষ‌্য, তার কাছেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ওই জাপানি। স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশ কয়েকজনের সামনেই তা হয়েছিল। স্থানীয়দের কাছে 
পাওয়া যায়, যাতে কুনিওকে মসজিদে টুপি পড়ে আরও অনেকের মাঝে বসে থাকতে দেখা যায়।

কুনিও খুন হওয়ার পর জাপান দূতাবাসের কর্মকর্তারা রংপুর ঘুরে গেলেও লাশ হস্তান্তর ও শেষকৃত্যের বিষয়টি ঝুলে থাকে ধর্ম বদলের কারণে। পরে রংপুরের মেয়র শরফউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানেই কুনিও হোশির শেষকৃত্যের ব‌্যবস্থা করতে অনুরোধ করে জাপান কর্তৃপক্ষ।

হত‌্যাকাণ্ডের দশ দিনের মাথায় ব্যাপক গোপনীয়তার মধ্যে ২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর গভীর রাতে মুন্সীপাড়া কবরস্থানে মুসলিম রীতি অনুযায়ী দাফন করা হয় জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে। দাফনের রেজিস্ট্রারে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয় গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া হিসেবে।