কোটা সংস্কার ছাড়াও আন্দোলনকারীদের তোলা অন্যান্য দাবির বিষয়ে পাঁচটি পদক্ষেপ নেওয়ার তথ্য দিয়েছেন আনিসুল হক।
Published : 23 Jul 2024, 10:08 PM
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে বন্ধ হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবার কবে প্রাণ ফিরবে, তা নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি বলেছেন, শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হলে যত দ্রুত সম্ভব সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে যাবে।
মঙ্গলবার দুপুরে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার গুলশানে নিজের কার্যালয়ে গণমাধ্যমকে ব্রিফ করেন আইনমন্ত্রী।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা-প্রাণহানি, কারফিউ, সর্বোচ্চ আদালতের রায় প্রতিপালন, কোটা সংস্কারের নতুন প্রজ্ঞাপন জারিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
কোটা সংস্কার ছাড়াও আন্দোলনকারীদের তোলা অন্যান্য দাবির বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ প্রতিপালন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন, আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের আইনি সুরক্ষা দেওয়াসহ সরকারের গৃহীত পাঁচটি পদক্ষেপ সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করেন আইনমন্ত্রী।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতা শুরু হয় গত ১৫ জুলাই। ১৬ জুলাই ছয়জনের প্রাণহানিসহ ১৮ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পাঁচ দিনে আন্দোলনের মধ্যে সংঘর্ষ, গুলি ও সংঘাতে ঢাকাসহ সারা দেশে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণ যায়।
এই আন্দোলনে ১৫ জুলাইয়ের আগেই সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যাক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। তার আগে থেকে চলছিল পেনশন নিয়ে শিক্ষকদের কর্মবিরতি। আর ১৫ জুলাইয়ের পর একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা শুরু হয়। পরে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হওয়ায় ধাপে ধাপে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, “শিক্ষার পরিবেশ যত তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে আনা যায়, আমরা সে বিষয়ে সচেষ্ট। আশা করতে পারেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাবে।”
ছাত্রছাত্রীদের দাবি অনুযায়ী কোটা সংস্কার হয়েছে বলে মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী বলেন, “মূলত এটা ছিল কোটা সংস্কার চেয়ে আন্দোলন। আমরা সেটি সংস্কার করেছি। এখন তাদেরও একটা কর্তব্য আছে, যেটা জনগণ মনে করে তাদের করা উচিত। সেটা হচ্ছে তাদের স্ব স্ব জায়গায় ফিরে গিয়ে পড়াশোনার সুযোগ গ্রহণ করা উচিত।”
আন্দোলনে সহিংসতা ও প্রাণহানির প্রসঙ্গ টেনে আনিসুল হক বলেন, “এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এটা শুধু কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছিল না। জঙ্গিরা- বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রশিবির, ছাত্রদল এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে দেশ নষ্ট করার চেষ্টা করছিল। তারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছিল।”
তবে কোটা সংস্কার ছাড়াও আন্দোলনকারীদের আর যেসব দাবি রয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে পাঁচটি পদক্ষেপের কথা বলেন আনিসুল হক।
* কোটা সংস্কারের যে রায় আপিল বিভাগ দিয়েছে, তা প্রতিপালন করা হয়েছে।
* যে সহিংসতা হয়েছে, তার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এক সদস্যবিশিষ্ট এ বিভাগীয় তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করে দিয়েছে। পরিস্থিতি আরেকটু উন্নতি হলে স্পট ঘুরে দেখবেন তিনি।
* সহিংসতায় আহত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার দেখভাল করবে।
* কোটাবিরোধী সাধারণ আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে তথ্য দিলে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়ে থাকলে সেগুলো দেখবে সরকার।
* শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার পরিবেশ সরকার তৈরি করবে।
২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে সরকারের পরিপত্র মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মামলায় হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে, যা নিয়ে আন্দোলন, সহিংসতা ও অগ্নিসন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সেই রায় বাতিল হয় এবং কোটা সংস্কারের পক্ষে রায় আসে। সে অনুযায়ী নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
ভবিষ্যতে এই প্রজ্ঞাপন পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে কিনা- জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, “আগেই বলেছি, সর্বোচ্চ আদালত অত্যন্ত বিচক্ষণ রায় দিয়েছেন। সুদূরপ্রসারী রায়। কারণ হচ্ছে, সর্বোচ্চ আদালত যদি শেষ করে দিতেন এখানে, তাহলে ভবিষ্যতে প্রেক্ষিত যদি বদলাতে হয়, তখন আবার রিভিউ করতে হবে। সর্বোচ্চ আদালত ফিউচারের কথাই বলেছে। ভবিষ্যতে যদি প্রয়োজন হয়, তখন দেখা যাবে।”
কোটা নিয়ে কখনও সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না। এটা সরকারের নীতিগত বিষয়। পরিপত্র ও প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমেই বিভিন্ন সরকার কোটা ব্যবস্থা চালু রেখেছে।
আইমন্ত্রী বলেন, “এ প্রজ্ঞাপন অবিলম্বে কার্যকর হবে। পরিষ্কারভাবে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে সব গ্রেডে কার্যকর হবে। সর্বোচ্চ আদালত চারটি ক্যাটাগরি করে দিয়েছে। এর বাইরে সরকার যেতে পারবে না। কারণ, এটা আপিল বিভাগের রায়। এর বাইরে যাওয়ার অভিপ্রায়ও নেই আমাদের।
“কোটার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া নীতিগত বিষয়। আদালত সেই পলিসি ম্যাটারে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। আমাদের যদি মনে হয় যে কোনো সময় এটা পরিবর্তন করা বা বাতিল করে দেওয়া বা এটা আরও একটু কমানোর প্রয়োজন হয়, আমরা করতে পারব।”
তবে এখন কোটা নিয়ে সরকার আর কোনো পরিবর্তন চায় না জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, সর্বোচ্চ আদালত যে রায়টা দিয়েছে, সেটাতে হাত দিলে আইনের শাসনের প্রতি মারাত্মক হস্তক্ষেপ হবে।”
আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে নারীর ক্ষমতায় ও জেন্ডার বৈষম্য কমানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ কম হওয়ায় সরকার ১০ শতাংশ নারী কোটা রেখেছিল। তা বাতিল হওয়ার পর নারীদের চাকরি পাওয়ার হার উদ্বেগজনকভাবে কমে যায়।
কোটা সংস্কারের নতুন প্রজ্ঞাপনে নারী কোটা নেই। বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী বলেন, “নারীরাই এ আন্দোলনের সময় বলেছে, তারা যথেষ্ট ক্ষমতাবান হয়ে গেছে, তাদের কোটার দরকার নেই। আমরা মনে করি, বিশ্বাস করি; আন্দোলনে যে কোটার সংস্কার চাওয়া হয়েছিল, যে বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল বা প্রস্তাব তোলা হয়েছিল, সেটি করা হয়েছে।”
১৬ জুলাই ছয়জন নিয়ে ১৮ থেকে ২১ জুলাই আন্দোলনের মধ্যে দেশে দেড় শতাধিক প্রাণহানির যে খবর রয়েছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, “জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী একটা কথা বলে দিয়েছেন, হতাহতের ব্যাপারে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। আমরা সেই কথায় আছি। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে এবং সেটা বিচার বিভাগীয় তদন্ত। সেটা শেষ না হওয়া পযন্ত আমরা এ ব্যাপারে কথা বলব না।”
আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতা, সংঘাত ও হতাহত ঘিরে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছিল, তার আর অবনতি হবে না বলে আশা প্রকাশ করে সংবাদিকদের উদ্দেশে আইনমন্ত্রী বলেন, “সমস্যার যেহেতু সমাধান করে দিয়েছি, সেহেতু এটুকু বলতে পারি, আমাদের বিশ্বাস নতুন করে কোনো সমস্যা তৈরি হবে না। এ পরিস্থিতির আর অবনতি হবে না। যদি অবনতি ঘটনানোর চেষ্টা কোনো অপশক্তি করে, সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেব আমরা।”
সহিংসতায় হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকার মধ্যে ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে শুরু হয় কারফিউ। মাঠে নামে সেনাবাহিনী। রোববার আদালতের রায় আসার পর থেকে পরিস্থিতি শান্ত হতে থাকে। সোমবার থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সে অর্থে সহিংসতার খবর আসেনি।
এ অবস্থায় কারফিউ কবে নাগাদ প্রত্যাহার হতে পারে, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, “জনজীবনে যখন স্বস্তি আসবে আমরা অবশ্যই কারফিউ প্রত্যাহার করব। জনজীবনে স্বস্তি ফেরা শুরু হয়েছে। এর ফলে প্রথমে দুই ঘণ্টা বিরতি, পরে চার ঘণ্টা বিরতি দেওয়া হয়েছে। জনমনে যতই স্বস্তি ফিরছে, ততই আমরা কারফিউর মেয়াদ কমিয়ে আনছি।
আইনমন্ত্রী চলমান পরিস্থিতি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরের সঙ্গে বৈঠক ও আদালতের রায়ের পর প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে বলেন, “আমরা কথা রেখেছি, প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে।”
মঙ্গলবার জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনে সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত-আধাস্বায়ত্তশাসিত ও স্বশাসিত এবং সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে, কর্মে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের কোটা পদ্ধতি সংশোধনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে নির্ধারণ করে কোটা অনুযায়ী, এখন থেকে সব ধরনের সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পাবেন ৯৩ শতাংশ চাকরিপ্রত্যাশী। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। আর ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্যপদগুলো সাধারণ মেধা তালিকা থেকে পূরণ করা হবে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
কোটা নিয় আগের সব পরিপত্র বা প্রজ্ঞাপন বাতিল করা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, “কোটা বাতিল করা, ২০১৮ সালের পরিপত্রও বাতিল করা হল।”