বদলির পর নতুন কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া, বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা না করার কারণে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।
Published : 07 Jul 2024, 11:01 PM
ছাগলকাণ্ডে আলোচিত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে কোরবানির ঈদের ছুটির পর থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি ছুটি নেননি, বদলির পর নতুন দপ্তরেও যোগ দেননি বলে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
গেল কোরবানির ঈদের সময় অভূতপূর্ব এক ছাগল বিতর্কে নাম জড়ানের পর এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরানো হয় মতিউরকে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের সদস্য পদও হানান তিনি। গত ২৩ জুন তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।
সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাশের ভবনটি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের কার্যালয়। তবে নতুন দপ্তরে সংযুক্তির পর মতিউর সেখানে সশরীরে হাজির হননি বলে ওই দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এই সময়ের মধ্যে ‘মতিউর মাথা ন্যাড়া করে’ বিদেশ পালিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। আবার ‘তিনি দেশেই আছেন’ বলেও প্রতিবেদন ছেপেছে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম।
তবে অর্থমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এসব খবরের সত্যাসত্য নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি।
মতিউরের চাকরি কীভাবে চলছে তা জানতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেছেন, মতিউরকে তারা কেউ দপ্তরে দেখননি। তিনি কোথায় আছেন সে বিষয়ে তাদের ধারণাও নেই।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের কাস্টমস শাখার দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সচিব মো. আব্দুল গফুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মতিউরকে এনবিআর থেকে বদলি করা হলেও তার যোগদানের বিষয়ে কোনো তথ্য তিনি পাননি। তিনি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম এর দপ্তরে যুক্ত হয়েছেন কিনা, সেই তথ্যও তার কাছে আসেনি।
এ বিষয়ে কথা বলতে এনবিআর চেয়ারম্যানকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। মতিউরের তথ্য জানতে ভয়েস মেইল পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এনবিআর চেয়ারম্যান সপ্তাহের অধিকাংশ সময় আগারগাঁওয়ে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে থাকেন। সেখানেও মতিউরকে দেখা যায়নি বলে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
মতিউরের মোবাইল নম্বরটি বরাবরের মতোই বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এতোদিন সক্রিয় থাকা তার গ্রামীণফোনের নম্বরে কল করলে বলা হচ্ছে, ওই ফোন আর ‘ব্যবহৃত হচ্ছে না’।
জ্যেষ্ঠ সচিবের একান্তি সচিব মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বদলির পর বাহক মারফত মতিউর রহমান যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেটা বিধিসম্মত নয় বিধায় গ্রহণযোগ্য হয়নি। ওই ঘটনার পর থেকে তাকে আর দপ্তরে দেখা যায়নি।”
এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মতিউরের এই লাপাত্তা হয়ে যাওয়া ‘একেবারেই বিধি বহির্ভূত’। একটি ‘নির্দিষ্ট সময়’ অপেক্ষা করার পর তার বিরুদ্ধে চকরিবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে নিয়ম কী জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বদলির পর নতুন কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া, বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা না করার কারণে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কতদিন সময় দেওয়া হবে সেই প্রশ্ন নেই। যেহেতু তিনি সময় আবেদন করছেন না, তাই যেকোনো মুহূর্তে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
মতিউর যেভাবে বিপাকে
কোরবানির জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ১৫ লাখ টাকা দামে ছাগল কেনার খবর ফেইসবুক ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার বলি হন মতিউর।
একজন রাজস্ব কর্মকর্তার ছেলে ১৫ লাখ টাকা খরচ করে কীভাবে ছাগল কিনতে পারেন সেই প্রশ্ন উঠে। মতিউর প্রথমে ইফাতকে নিজের ছেলে হিসাবে অস্বীকারও করেন।
একটি টেলিভিশনের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে কাউকে তিনি চেনেন না। তার একটিই ছেলে, তার নাম তৌফিকুর রহমান।
এক পর্যায়ে সামনে আসেন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দাবি করেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা।
এ সংসদ সদস্য বলেন, ইফাত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের (স্ত্রীর) ছেলে। মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি ছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি নাম লেখান রাজনীতিতে। তিনি এখন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
মতিউর এনবিআর থেকে বদলি এবং সোনালী ব্যাংকের পদ খোয়ানোর পর ‘দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের’ অভিযোগ তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন।
কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে আদালত তার স্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছে। মতিউর এবং তার প্রথম স্ত্রী বিদেশ যাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
১৯৯৪ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া এ কর্মকর্তা পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, সেসব দুদক তদন্তও করেছে।
মতিউর সরকারি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসায় জড়িয়েছেন; বিনিয়োগ করেছেন পুঁজিবাজারেও।
বিপুল আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মতিউর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “একটা গ্রুপ অব কোম্পানির ৩০০ একরের জমিতে আমার একটা অংশ আছে। কোনো কারখানায় আমার বিনিয়োগ আছে। কিন্তু ৩০০ একর জমি বা কারখানার পুরোটা আমার না। আমাদের পরিবারের বিনিয়োগ আছে মাত্র।”