আতশবাজি পোড়ানোর কারণে মানুষের সাংস্কৃতিক, শারীরিক ও জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয় ঘটছে, বলছেন গবেষকরা।
Published : 31 Dec 2024, 12:42 AM
প্রতিবছর ইংরেজি নতুন বছর বরণে আগের রাতে যে পটকা ও আতশবাজি ফোটানো হয়, তা ঢাকা শহরের প্রাণিকূলের জন্য ‘বিভীষিকাময়’ মন্তব্য করে প্রাণীপ্রেমীরা প্রশ্ন তুলেছেন, পটকা-ফানুস ছাড়া কি বর্ষবরণ উদযাপন করা যায় না?
পটকা, আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো বরাবরের মত এবারও ‘নিষিদ্ধ’ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। আর জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে সরকারি এসব উদ্যোগ আগের বছরগুলোতে নেওয়া হলেও ফলপ্রসূ হয়নি।
ফানুস ও আতসবাজি থেকে অগ্নি দুর্ঘটনায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, সেই পরিসংখ্যান জানিয়ে গত বছর মানুষকে সচেতনতার বার্তা দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। তারপরও ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার অধিকাংশ এলাকা পটকা-বাজির শব্দে প্রকম্পিত হতে থাকে।
গত বর্ষবরণে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ রাত ১২টা পর্যন্ত টেলিফোনে ৫২৬টি অভিযোগ আসে। শুধু ঢাকা মহানগর এলাকা থেকেই ফোন করেন ১০৭ জন। এর মধ্যে রয়েছে শব্দদূষন বন্ধ ও অগ্নিকাণ্ডের ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধও।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর কবীর বলছেন, “প্রত্যেক বছরই আমরা দেখি, বর্ষবরণ উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হোস্টেল, বনানী-গুলশান-ধানমণ্ডির মত আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার ছাদগুলো পটকা ও আতশবাজির কেন্দ্রে পরিণত হয়। ডিএমপি ও পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিবছর বিধিনিষেধ দিলেও ফল আসছে না।
“মানুষ ও পশুপাখির বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আতশবাজির শব্দ। এমনিতেই দূষণের শহর ঢাকায় পাখির থাকার জায়গা নেই, তাদের সংখ্যা কমছেই। সন্ধ্যার পর এসব পাখি ঘুমিয়ে পড়ে। মধ্যরাতে হঠাৎ বিকট আতশবাজির শব্দে পাখিগুলো জেগে ওঠে, অনেক পাখি মারাও যাচ্ছে বর্ষবরণের বাজির শব্দে।”
আলমগীর কবীর বলেন, “তার ওপর আছে বায়ুদূষণ। এমনিতেই দূষিত বায়ুর তালিকায় শীর্ষে আমাদের শহর ঢাকা। সেখানে প্রচুর পটকা ও বাজির ধোঁয়া বাড়তি মাত্রা যোগ করে।”
দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ঘনবসতির শহর ঢাকায় একটা ফানুস জ্বলন্ত অবস্থায় কোথাও পড়লে আগুন ধরে যাচ্ছে। প্রতি থার্টি ফাস্টে আতঙ্কিত মানুষের শত শত ফোন যাচ্ছে ৯৯৯ এ। তবুও আমাদের হুঁশ হয় না।”
মানুষ, পাখি আর প্রাণিকূলের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে এরকম উদযাপনের
তার ভাষ্য, “এখন প্রশাসনের কঠোর না হয়ে উপায় নেই। কিছু মানুষকে শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি আমরা সচেতনতা তৈরির কাজও করছি।”
বাসায় পাখি ও কবুতর পোষেন আশফাক হোসেন। তিনি বলেন, “প্রতিবছরই প্রচণ্ড শব্দে অনেক পাখি মারা যায়। ছোট ছোট লাভ বার্ড, বাজরিকার সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক করে। আমি চেষ্টা করি খাঁচাগুলো ছাদ থেকে বাসার ভেতরে এনে দরজা-জানালা লাগিয়ে রাখতে।
“গেল বছর থার্টি ফাস্টের পর আমি আমাদের মহল্লার একটা আমগাছের তলে মৃত চড়ুই পাখি পেয়েছি। মনে হয়েছে সেগুলো আগের রাতের শব্দে মারা গেছে। এভাবে পশু-পাখি মেরে বর্ষবরণের দরকারটা কী? পটকা-ফানুস ছাড়া কী বর্ষবরণ হয় না?”
বিপর্যয় ঘটছে ‘তিন ধরনের’
নববর্ষে আতশবাজি পোড়ানোর প্রভাববিষয়ক গবেষণার ফল তুলে ধরতে এবং আতশবাজি ও ফানুসমুক্ত নববর্ষ উদযাপনের দাবিতে গত ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।
সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম বলেন, “আতশবাজি পোড়ানোর কারণে মানুষের সাংস্কৃতিক বিপর্যয়, শারীরিক বিপর্যয় এবং জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয় ঘটছে।”
গবেষণা প্রতিবেদনে ক্যাপস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, “বিগত সাত বছরে নববর্ষ উদযাপনের সময় গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে ২০২৩ সালের নববর্ষে রাত ১১ থেকে ১২টার তুলনায় পরবর্তী এক ঘণ্টায় বায়ু দূষণের পরিমাণ প্রায় ৩৬ শতাংশ ও শব্দদূষণ ১০২ শতাংশ বেড়েছিল।
“অপরদিকে ২০২৪ সালের নববর্ষের রাত ১১ থেকে ১২টার তুলনায় পরবর্তী এক ঘণ্টায় বায়ু দূষণের পরিমাণ প্রায় ৩৫ শতাংশ ও শব্দদূষণ ৪২ শতাংশ বেড়েছিল।”
তিনি বলেন, “মাত্রাতিরিক্ত শব্দ ও বায়ুদূষণ মানুষ, পশু-পাখি, উদ্ভিদসহ সার্বিক প্রাণ-প্রকৃতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।”
ডিএমপির নিষেধাজ্ঞা
থার্টি ফাস্টের আগেই পটকা, আতশবাজি, ফানুস না ওড়াতে অনুরোধ-নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। কিন্তু নতুন বছরের প্রথম প্রহরে ঢাকার আকাশ ছেঁয়ে যায় ফানুস আর আতশবাজিতে। মুহূর্মুহূ পটকার বিকট শব্দে গত বছর একটি অসুস্থ শিশুর মৃত্যুর খবরও সংবাদমাধ্যমে আসে।
এবারও ডিএমপি পটকা, আতশবাজি ও ফানুস নিষিদ্ধ করেছে। গত ২৬ ডিসেম্বর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশ বলেছে, নতুন বছর বরণ উপলক্ষে সব ধরনের আতশবাজি ও পটকা ফুটানো, ফানুস উড়ানো এবং যেকোনো ধরনের বিস্ফোরকের ব্যবহার বরাবরের মত নিষিদ্ধ থাকবে।
প্রতিরোধমূলক নানা কার্যক্রমও শুরু করেছে পুলিশ। এর অংশ হিসেবে রাজধানীর উত্তরা থেকে বিপুল আতশবাজি, পটকা ও বিস্ফোরকসহ দুইজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়েছে ডিএমপি।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধ
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থার্টি ফার্স্ট নাইটে জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর আতশবাজি ও পটকা ফোটানো থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করেছে।
একই সঙ্গে আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার কথা বলেছে মন্ত্রণালয়।
সোমবার মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আতশবাজি ও পটকা ফোটানোর কারণে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ হয়। অতিরিক্ত শব্দদূষণে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও মানসিক চাপের ঝুঁকি বাড়ে।
“এছাড়া ফানুস ওড়ানোর ফলে অগ্নিকাণ্ড ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অনুযায়ী এসব কার্যক্রম দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রথমবার আইন লঙ্ঘনে এক মাসের জেল বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। পুনরায় অপরাধ করলে ৬ মাসের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।”