জুলাই বিপ্লবে আহতদের তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে।
Published : 27 Feb 2025, 09:23 PM
চব্বিশের জুলাই-অগাস্টের গণআন্দোলনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারকে এককালীন ৩০ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
পাশাপাশি নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে আগামী মার্চ মাস থেকে মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা ও পরিবারের সক্ষম সদস্যদের সরকারি বা আধা সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আহতদেরও তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে এককালীন অর্থ সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব বলেন, নিহতের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে দেওয়ার বিষয়টি আগেই জানানো হয়েছিল। সে হিসেবে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে (চলতি বছরের জুলাইতে) আরও ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পাবেন প্রত্যেকের পরিবার।
তিনি বলেন, “জুলাই ও অগাস্টে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে। তাতে অনেক মানুষ, অনেক ইয়াং স্টুডেন্ট শহীদ হয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন এবং অনেক আহতের এমনই অবস্থা যে তারা সত্যিকার অর্থে আবার কর্মক্ষম হয়ে ফিরে আসার অবস্থাটা এখন নাই।
“সেই বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকার শহীদ ও আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। সেটা করার জন্য ছয়টা মাস অক্লান্ত পরিশ্রমে এ ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট, প্রত্যেকে যারা আহত ও শহীদ হয়েছেন, তাদের সবার ডকুমেন্টেশন করেছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।…আমাদের লক্ষ্যটা ছিল যে, যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন, তাদের সব কিছু ডকুমেন্টেশন করা।”
সেই পরিপ্রেক্ষিতে হতাহতদের সহায়তার বিষয়টি সোমবারের সভায় গৃহীত হয়েছে বলে জানান শফিকুল আলম।
মাসিক সহায়তার বিষয়ে ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, “এ বিষয় দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়) জানিয়েছেন, তারা চেষ্টা করবেন মার্চ মাস থেকেই দেওয়া শুরু করতে। এটা নিয়ে অধিদপ্তর কাজ করছে।”
আহতদের ৩ ক্যাটাগরিতে সহায়তা
জুলাই বিপ্লবে আহতদের তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো ক্যাটাগরি এ, বি ও সি।
ক্যাটাগরি এ (অতি-গুরুতর আহত): সরকারের যাচাই-বাছাই অনুযায়ী তাদের এই ক্যাটাগরিতে পড়েছেন ৪৯৩ জন। চিকিৎসার পরও তারা অন্যের সহায়তা ছাড়া জীবন যাপনে অক্ষম। এই ক্যাটাগরির ব্যক্তিরা এককালীন ৫ লাখ টাকা পাবেন।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে নগদ (ব্যাংক চেকের মাধ্যমে) ২ লাখ টাকা ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে নগদ (ব্যাংক চেকের মাধ্যমে) ৩ লাখ টাকা পাবেন। পাশাপাশি মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হবে। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আজীবন চিকিৎসা সুবিধাও পাবেন। উপযুক্ত মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশে দেশি-বিদেশি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পাবেন। কর্মসহায়ক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন সুবিধা পাবেন। তারা পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। সেটি দেখিয়ে সরকারি বিভিন্ন সুবিধা পাবেন।
ক্যাটাগরি বি (গুরুতর আহত): এই ক্যাটাগরিতে পড়েছেন ৯০৮ জন। পর্যাপ্ত চিকিৎসার পরও শারীরিক অসামর্থ্যতার কারণে অন্যের আংশিক সহায়তায় জীবন যাপনে সক্ষম তারা।
এই ক্যাটাগরির ব্যক্তিরা পাবেন এককালীন ৩ লাখ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে নগদ (ব্যাংক চেকের মাধ্যমে) ১ লাখ টাকা ও ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে নগদ (ব্যাংক চেকের মাধ্যমে) ২ লাখ টাকা দেওয়া হবে। পাশাপাশি মাসিক ১৫ হাজার টাকা ভাতা এবং কর্মসহায়ক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি/আধাসরকারি কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। তারাও পরিচয়পত্র পাবেন এবং সেটি দেখিয়ে সরকারের বিভিন্ন সুবিধাদি পাবেন।
ক্যাটাগরি সি: এই ক্যাটাগরিতে পড়েছেন ১০ হাজার ৬৪৮ জন, যারা চিকিৎসার পর বর্তমানে সুস্থ। তাদের এককালীন ১ লাখ দেওয়া হবে। মাসে ১০ হাজার টাকা ভাতা ও পুনর্বাসনের সুবিধা পাবেন। এছাড়া তারাও পরিচয়পত্র পাবেন এবং সেটি দেখিয়ে সরকার বিভিন্ন সুবিধা পাবেন।
‘জুলাই শহীদ’, ‘জুলাই যোদ্ধা’
২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে ৩৬ দিনের আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও ব্যাপক প্রাণহানির মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের বেশি সময়ের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালানোর দায়িত্ব নিয়ে আন্দোলনে হতাহতদের চিকিৎসা ও অর্থ সহায়তার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়।
যদিও সরকার গঠনের পর থেকেই আন্দোলনে আহত ও নিহতদের স্বজনরা বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় চিকিৎসা ও সহায়তার দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। সবশেষ নিজেদের দাবি দাওয়া নিয়ে দুদিন ধরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ফটকে বসেছেন আহতদের একাংশ। তাদের অভিযোগ, তাদের দিকে সরকারের ‘নজর নেই’।
তাদের দাবিদাওয়ার মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গত ৯ ও ২৪ ফেব্রুয়ারির সভায় সহায়তা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সভায় জুলাই আন্দোলনে প্রাণ হারানোদের ‘জুলাই শহীদ’ আর আহতদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে অভিহিত করার সিদ্ধান্ত হয়।
বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে সহায়তার বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আহতরা আন্দোলন করছেন, এমন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শফিকুল আলম বলেন, “উনাদের কথায় সম্মান দিয়েই বলি, মেডিকেলেই তো আমরা দেখছি কারা এখনও সক্ষম আছেন। কেউ কেউ আছেন দুই চোখই হারিয়েছেন। তার পাশে তো আমাদের সবারই দাঁড়ানো উচিত। এ বিষয়টা তো মানবিক বিষয়। সেটা তো আমাদের দেখতে হবে।
“অনেকে দুই চোখ হারিয়েছেন, অনেকের পা কেটে ফেলতে হয়েছে, অনেকের হাত কেটে ফেলতে হয়েছে, এই মানবিক বিষয়টাকে সামনে রেখেই এই ক্যাটাগরি করা হয়েছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, “কোনো কোটার সিস্টেমে আমরা যাচ্ছি না, এটা কোটার বিষয় না। আমাদের কথা যারা শহীদ হয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন…এমন আছে যে দুই চোখে পাঁচ-ছয়টা করে ছড়ড়া গুলি করা হয়েছে, অমানবিক। এখনও অনেকেই আছেন যারা সিএমএইচে আছেন, চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আমাদের কথা হচ্ছে যারা শহীদ হয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, তাদের পাশে এই অন্তর্বর্তী সরকার দাঁড়িয়েছে।
নতুন সরকার গঠন হলে আর্থিক সহায়তা চলমান থাকবে কিনা, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থান জাতির একটি মহৎ আন্দোলন। এটা সবাই ধারণ করেন। বাংলাদেশের সমস্ত পার্টির কাছেই এরা জুলাই যোদ্ধা জুলাই বীর। জুলাইয়ের শহীদ। আমরা মনে করি, যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, জুলাই যোদ্ধাদের কেউ ভুলবে না, জুলাই শহীদদের কেউ ভুলবে না।”
সহায়তার ব্যাপারে আইন তৈরির পরিকল্পনা আছে কিনা, এ প্রশ্নে প্রেস সচিব বলেন, “এরই মধ্যে আমরা একটি অধিদপ্তর করেছি। অধিদপ্তরের আওতায় খুবই নিয়মতান্ত্রিকভাবে সবকিছু করা হচ্ছে। আপনারা দেখছেন আমরা কতটা...৫৩ বছরেও ফ্রিডম ফাইটারের লিস্ট নিয়ে এখনও অনেক ধরনের বিতর্ক আছে। এইখানে আমরা প্রত্যেকটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে, ‘ডাবল-ত্রিপল’ চারবার করে চেক করা হয়েছে, সেই অনুযায়ী আমরা ক্যাটাগরি করেছি। সবার পাশেই এই সরকার দাঁড়িয়েছে।”
আন্দোলনে প্রাণহানির সংখ্যা নিয়ে তিনি বলেন, “শহীদের সংখ্যা হল ৮৩৪ জন। এটা হল গেজেটেড। কিন্তু আপনার মনে রাখতে হবে যে আমরা এখনও…আমাদের ইনভেস্টিগেশন চলছে, সার্চিং করছি। কেন না ইউএন এর হিসাবে এটা ১৪০০ এর মত। আমরাও জানি অনেক জায়গায় কিছু কিছু কবরস্থানে, জুলাই শহীদদের আনমার্ক কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি এদের নামগুলো কীভাবে বের করা যায়, কীভাবে তাদের আইডেন্টিফাই করা যায়। এটার জন্য একটি প্রক্রিয়া চলছে। এদের সংখ্যা বাড়বে। আপাতত গেজেটেড হচ্ছে ৮৩৪ জন।”