চারুকলার বকুলতলা, পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ্ পার্ক স্মৃতিস্তম্ভ মঞ্চ এবং উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের উন্মুক্ত মঞ্চে হবে এবারের বসন্ত উৎসব।
Published : 14 Feb 2025, 12:03 AM
কদিন আগেও যে গাছের নিচে গেলে পাওয়া যেত পাতার ঝরার মর্মর শব্দ, সেই নেড়া গাছগুলো সেজেছে নবপল্লবে। প্রকৃতি গাইছে ফাগুন হাওয়ায় কচি পাতার গান।
আমের মুকল আর নানা ফুলের সমারোহে কেউ কেউ গুনগুনিয়ে গাইছেন রবি ঠাকুরের সুরে- ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। কেউবা গলা ছেড়ে গাইছেন অনুপম রায়ের ‘বসন্ত এসে গেছে’ গানটি।
দুদিন আগে থেকেই একুশে বইমেলা, টিএসসিসহ নগরীর বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়- বাসন্তী সাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা।
একুশে বইমেলায় কানে ফুল গুঁজে হলুদ শাড়িতে বুধবার এসেছিলেন তিন বান্ধবী। তাদের একজন সুমাইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তিন বান্ধবী বসন্ত উদযাপন করতেই একই রঙের শাড়িতে সেজেছি।”
ফাগুনের প্রথম দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও। ফলে এদিনটায় বসন্ত উৎসব এসে মিশে যায় ভালোবাসার রঙে। প্রেমিকযুগলকে হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় মাতাল প্রেমে।
নৃত্যে, বাদ্যে, ছন্দে-গীতে বসন্তকে বরণ করে নিতে অনুষ্ঠান আয়োজনও করে কেউ কেউ। প্রতি বছরের মতোই এবারও ঢাকার তিন জায়গায় বসন্ত উৎসব উদযাপন করতে যাচ্ছে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ।
এছাড়া রাজপুত্রের সঙ্গে বাদীর প্রেমের কাহিনি নিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সাধনা’ মঞ্চে নিয়ে আসছে নৃত্যনাট্য ‘দিলনাওয়াজ’। শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৫টায় ঢাকার জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হবে এ নৃত্যনাট্য।
একুশে বইমেলা এদিন জনসমুদ্র হবে বলে মনে করছেন বইমেলা সংশ্লিষ্টরা। প্রকাশকরাও নতুন বইয়ের পসরা নিয়ে অপেক্ষায় থাকবে বইপ্রেমীদের।
জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলা, পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ্ পার্ক স্মৃতিস্তম্ভ মঞ্চ এবং উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের উন্মুক্ত মঞ্চে হবে এবারের বসন্ত উৎসব।
“শুক্রবার সকাল সোয়া ৭টায় চারুকলার বকুলতলায় আয়োজনের সূচনা হবে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের ধ্রুপদী সংগীতের সুরে। পরে তিনটি মঞ্চে একযোগে চলবে বসন্ত উৎসব।”
প্রকৃতির আপন নিয়মেই হেমন্তের পর আসে বসন্ত। গাছে গাছে নতুন ফুল, পাতার সমারোহ দেখা যায় এ সময়। কোথাওবা প্রকৃতির ভিন্ন খেয়ালও চোখে পড়ে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন- ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত’।
এবার বাংলাদেশে বসন্ত উৎসব হচ্ছে ভিন্ন বাস্তবতায়। গত বছরের ৫ অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাউলদের উপর হামলা, মাজার ভাঙা, মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।
অন্যদিকে একুশে বইমেলা, কনসার্টসহ কিছু সাংস্কৃতিক আয়োজনে হাজারো মানুষের সমাগমও দেখা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম চঞ্চল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেকোনো বাস্তবতায় তারুণ্যে উচ্ছ্বাস তো থেমে থাকে না। চারুকলা প্রাঙ্গণে যে বসন্ত উৎসবটি হয়, এটি চারুকলা অনুষদের আয়োজন নয়।
“তবে আমাদের ছেলেমেয়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বসন্ত উৎসবে অংশ নেয়। এবারও আশা করি, ক্যাম্পাসে বসন্ত উদযাপন ভালোমতোই হবে। ফুল ফুটুকু না ফুটুক, বসন্ত তো বসন্তের নিয়মেই আসবে।”
কয়েক বছর আগেও পহেলা ফাল্গুন ও ভ্যালেন্টাইন ডে পরপর দুটি দিনে উদযাপন হতে, তবে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের কারণে ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে একই দিনে উদযাপিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত ঐতিহাসিক দিবসগুলোকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য বাংলা বর্ষপঞ্জি পরিবর্তন করা হয়েছিল খ্রিস্টীয় ২০১৯ সাল বা ১৪২৬ বঙ্গাব্দ থেকে। তাতে ১৯৫২ সালের মতো ২১ ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুনই কিংবা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পয়লা পৌষেই সমন্বয় করা গেলেও পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস হয়ে যায় একদিনে।
এবারও বসন্ত-ভালোবাসা মিলে উৎসবের আমেজ ছড়াবে বলেই ধারণা করছেন অনেকে। আবার লালন উৎসব বন্ধ করে দেওয়া, মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করার ঘটনায় কিছুটা শঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, “আমরা তো রাজধানীতে বসন্ত উৎসব আয়োজনটি করতে পারছি। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় লালন উৎসবসহ নানা আয়োজন বন্ধ হওয়ার খবর পাচ্ছি। বাউলদের ওপর হামলা হচ্ছে। এসব ঘটনা আমাদের চিন্তিত করে, শঙ্কিত করে।”
শত ফুল ফুটতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সুইট বলেন, “বাগানে তো শুধু একরকম ফুল থাকে না। শত ফুলই বাগানকে সমৃদ্ধ করে। প্রকৃতির এই শিক্ষা যেন আমাদের প্রেরণা হয়।
“শত ফুল ফুটতে দিতে হবে। তবেই আমরা এক সম্প্রীতির বাংলাদেশ পাব।”
১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে আকবরি সন বা ফসলি সনের প্রবর্তন করেন। তিনি প্রতি বছর ১৪টি উৎসব পালনের রীতিও প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে অন্যতম বসন্ত উৎসব।
১৯০৭ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে শান্তিনিকেতনে যাত্রা শুরু করে বসন্ত উৎসব, যা ‘ঋতুরঙ্গ উৎসব’ নামেই পরিচিত।
স্বাধীন বাংলাদেশে এর গোড়াপত্তন গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় ছোট্ট পরিসরে শুরু হয় বসন্ত উৎসব।
এ আন্দোলনের বিজয় উদযাপনের জন্য রঙিন কাগজের ফুল, প্রজাপতি আর পাখির অবয়ব নিয়ে চারুকলা অনুষদের ৮৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নব্বইয়ের শুরুতে বর্ণিল শোভাযাত্রা বের করেন।
পরে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সালে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের আয়োজনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় শুরু হয় বসন্ত উৎসব।