“প্রাত্যহিক জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে বেড়াজালগুলো ভাঙছি। ফলে আমার কাছে মনে হয়, একটা লম্বা যুদ্ধ,” বলেন সেউতি সবুর।
Published : 15 Mar 2025, 12:27 PM
মেয়ে বা নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করে অধিকারের সমতা প্রতিষ্ঠা ও তাদের ক্ষমতায়নে পরিবার ও শিক্ষাঙ্গনে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর পাশাপাশি সংস্কৃতির পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়েছেন দুজন বিশেষজ্ঞ।
তারা বলছেন, স্কুল পর্যায়েই মেয়ে শিশুদের অনেকে ঝরে পড়ে। সামাজিকভাবে তাদের শিক্ষার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয় ‘কম’। সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় যান, তারা আবার কর্মজীবন আর সংসার সামলাতে গিয়ে হিমশিম খান। পরিবার আর সামাজিক নানা চাপে শেষ পর্যন্ত কর্মস্থল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ফলে নিজেদের সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে পারছেন না নারীরা। তাদের জন্য শ্রদ্ধার সংস্কৃতি এখনও গড়ে তুলতে না পারাটা বড় সমস্যা।
নারী দিবসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রচারিত এক পডকাস্টে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্তরায় ও করণীয় তুলে ধরে কথা বলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সেউতি সবুর ও জেসিআই বাংলাদেশের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল চেয়ারপারসন সামিহা আক্তার।
নুভিস্তা ফার্মা নিবেদিত ‘অধিকার সমতা ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক পডকাস্টে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা ও বৈষম্য দূরে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করার তাগিদ দেন তারা।
সেউতি সবুর বলেন, “পরিবারের পরে সবচেয়ে বড় ভূমিকা হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি- এ তিন জায়গায় চ্যালেঞ্জগুলোও ভিন্ন। প্রাইমারি স্কুলে দেখা যায় বাচ্চারা সবাই একভাবে ভর্তি হচ্ছে, যখন সেকেন্ডারি লেভেলে যাচ্ছে, তখন একটা বড় অংশ কিন্তু ঝরে পড়ছে। পরিসংখ্যানগতভাবেও এটি প্রমাণিত।
২০ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আসছে আমরা দেখছি যে, যেহেতু কন্যা শিশুরা কম রিসোর্সেস পায়, স্বল্প রিসোর্সের মধ্যে মেয়েরা প্রাণপণে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে সেটাকে কাজে লাগানোর জন্য। কিন্তু দেখা যায় যখন তারা কাজে যাচ্ছে, তখন চাকরির ক্ষেত্রে হয়ত তারা বিয়ের কারণে ‘এন্ড আপ’ করছে না।…আবার চাকরি শুরু করলে তখন সন্তান লালন পালনের (বিয়ের পর) যে সময়টা আসছে, তখন তারা ঝরে পড়ছে।
“ফলে তাদের সম্ভাবনা সামাজিকভাবে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে নিশ্চিত করলেও দেখা যাচ্ছে সামাজিকভাবে এমন কোনো স্পেস তৈরি করতে পারিনি যে তাদের পূর্ণ সম্ভাবনাটা ব্যবহার করতে পারি।”
বিষয়টিতে একমত পোষণ করে সামিহা আক্তার বলেন, “প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারি স্কুলে যখন যায়, তখন ‘হাই ড্রপ অব রেট’ থাকে, এটা প্রায় ৪২%। এটা বড় ‘হাই ড্রপ অব রেট’।
প্রাথমিক পর্যায়ে বিনাবেতনে পড়াশুনার সুযোগেও ঝরে পড়ার পাশাপাশি চাকরি ক্ষেত্রেও নারীদের সুযোগ-সুবিধা না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।
“বাংলাদেশে কিন্তু ‘ওয়ান টু ফাইভ’ ফ্রি। তা সত্ত্বেও যে ‘হাই ড্রপ অব রেটটা’ হচ্ছে, তার কারণ সামাজিক চাপ। আমাদের সমাজে এখনও মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্বটা নেই। এমনকি ‘ফরমাল এডুকেশনটা’ নিশ্চিত করছি, পরবর্তীতে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পর বা বাচ্চা হওয়ার পর অনেকে দেখা যাচ্ছে, কর্মক্ষেত্র থেকে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে।”
সামিহা আক্তার বলেন, “অনেকের ইচ্ছেটা আছে হয়ত। সামাজিক চাপের জন্য নয়, কিন্তু সুযোগের অভাবে…। কর্মজীবী মায়েদের জন্য ‘ডে কেয়ার’ এর প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের দেশে এ ধরনের সুবিধাগুলো সবগুলো অর্গানাইজেশনের সঙ্গে পর্যাপ্তভাবে গড়ে উঠেনি। ওই অবকাঠামো যদি আমরা প্রস্তুত দিতে পারি, তাহলে অনেক মেয়েদের জন্য আরও সহজ, সুবিধাজনক হবে।”
‘ভাবনা ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন দরকার’
শিক্ষা ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে বা নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যের কথা তুলে ধরে সিউতি সবুর বলেন, “আমার কাছে মনে হয়, পুরুষতান্ত্রিক পরিবারেও যেমন ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশু আলাদা করছে, শিক্ষাঙ্গনেও আমরা দেখছি যারা পাঠদান করছে শিক্ষকদেরও এ ধরনের মনমানসিকতা রয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, আমরা বলছি শিক্ষার পরিবেশ ‘ইনক্লুসিভ’ না। এতে কন্যা শিশু পরিবার থেকে প্রথম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, শিক্ষাঙ্গণে গিয়ে দ্বিতীয়বার বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।”
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সঙ্গে ৩০ বছর ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা, বৈষম্য দূরে কাজ করছি আমরা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের প্রাপ্তি যেমন আছে, অপ্রাপ্তির বড় জায়গাটা হচ্ছে সমাজের যে আমূল বদল, মানসিকতার যে পরিবর্তন, নারী বা শিশুকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করার যে সংস্কৃতি তা গড়ে তুলতে পারিনি। আমার মনে হয় সেটা একটা বড় সমস্যা।”
তিনি বলেন, “স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যখন একটা শ্রদ্ধার সংস্কৃতি তৈরি করতে পারবেন না, তখন ইনক্লুসিভ লিডারশিপের জায়গাটা অটোমেটিক সংকুচিত হতে থাকে। সেক্ষেত্রে বড় একটা সমস্যা হচ্ছে, মেয়েদের হীনম্মন্যতা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করছি আমরা।”
ফলে পারিবারিক সংস্কৃতি ও শিক্ষাঙ্গনের সংস্কৃতি আমূল পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “পিতৃতান্ত্রিকতার বাইরে গিয়ে ছেলে-মেয়ে সবাইকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নারী-পুরুষকে শিক্ষা দিচ্ছি না, সমাজে তারা সমাজে একসাথে কাজ করবে এবং দুজনকে সমানভাবে যোগ্য হতে হবে। লিডারশিপ তো সেখানে। আমি নারী-পুরুষ যদি যোগ্য না হই, তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবে না। ইন্সটিটিউশনালি সেটা যেরকম পরিবর্তন করতে হবে, আমাদের ভাবনায়-সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন করতে হবে।”
‘পরিবার ও কমিউনিটি নিয়ে কাজ করতে হবে’
সামিহা আক্তার বলছেন, “সরকার ও অর্গানাইজেশনগুলো থেকেও পরিবারদের সঙ্গে কাজ করার প্রচুর জায়গা আছে। প্রাথমিকভাবে মানুষের একটা ‘মাইন্ডসেট’ থাকে শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও সুযোগ দেওয়া নিয়ে। এখানে এ পরিবারগুলোর সঙ্গে কাজ করা ও তাদের যুক্ত করা, আত্মবিশ্বাসের উন্নয়ন করার বড় প্রয়োজন রয়েছে। শুধু একা মেয়েদের নিয়ে কাজ করলে হবে না। পরিবার ও কমিউনিটি নিয়ে কাজ করতে হবে।”
নারীদের বিকাশের ক্ষেত্রে নানা সামাজিক বাধা দূর করাও অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন সহযোগী অধ্যাপক সেউতি সবুর।
তিনি বলেন, “ছোট ছোট জিনিসগুলো প্রাত্যহিক জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে বেড়াজালগুলো ভাঙছি। ফলে আমার কাছে মনে হয়, একটা লম্বা যুদ্ধ। কারণ সমতার যুদ্ধ সবচেয়ে আদিতম যুদ্ধের একটা। সে যুদ্ধটা শুধু নারী পুরুষের সমতা নয়, সমস্ত ক্ষেত্রে যদি তাদের ইচ্ছাগুলো না প্রকাশ করতে পারি। কারণ একেক জায়গার চ্যালেঞ্জ একেক রকম। ফলে একটা গড় চ্যালেঞ্জ বলা যাবে না।
“ইনক্লুসিভ লিডারশিপের সবচেয়ে বড় জায়গা হচ্ছে ইক্যুয়াল এক্সেস। এডুকেশন, ইকোনোমি আর তার সঙ্গে সঙ্গে লিডারশিপ তৈরি হবে, যখন আমার পলিটিক্যাল রিপ্রেজেন্টেশনটা থাকবে। ফলে রাষ্ট্র হিসেবে, অর্গানাইজেশন হিসেবে যদি এ জিনিসগুলা প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তখন বাধাগুলো দূর করা সহজ হয়ে যাবে।”