৮৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজের ‘অনভিজ্ঞতার’ প্রসঙ্গ তুললে ‘দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার সামনে এটা কোনো বিষয় নয়’ বলে মন্তব্য করেন আনোয়ার ইব্রাহিম।
Published : 04 Oct 2024, 09:24 PM
দুর্নীতি দমন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায় বিচার নিশ্চিতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টায় পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
শুক্রবার দুপুরে সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে ঢাকার একটি হোটেলে ইউনূসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন ইব্রাহিম। পরে দুই নেতা যৌথভাবে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন।
দুই নেতার কথায় পারস্পরিক সৌহার্দ্য এবং সহযোগিতার সদিচ্ছার বিষয়টি বার বার ফুটে ওঠে। প্রবীণ রাজনীতিক আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে আলাপচারিতায় ৮৪ বছর বয়সী ইউনূস রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজের ‘অনভিজ্ঞতার’ প্রসঙ্গ তুললে ‘দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার সামনে এটা কোনো বিষয় নয়’ বলে মন্তব্য করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আশিয়ানের চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া। সেজন্য ইউনূস প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে বৈঠকে অভিনন্দন জানান। আশিয়ানের খাতভিত্তিক আলোচনায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব করেন তিনি। ইব্রাহিম প্রতিশ্রুতি দেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি সেই চেষ্টা করবেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় মালয়েশিয়ার সমর্থন পাওয়ার বিষয়টি স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আলোচনায় আমরা দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো আরও প্রাণবন্ত করার বিষয়ে একমত হয়েছি। আমি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘটনাটি বর্ণনা করেছি। এই দ্বিতীয় স্বাধীনতার অন্বেষায় তরুণদের আত্মদানের বিষয়টি স্মরণীয়। তারা বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশের জন্য লড়েছে।
“জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকার কাজে হাত দিয়েছে। ঐতিহাসিক এমন মুহূর্তে ভাতৃপ্রতীম রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার অবিরাম সমর্থনের জন্য আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছি।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সহযোগিতার তিনটি প্রধান ক্ষেত্র নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলাপ করেছি। রাজনীতি, ব্যবসা-বিনিয়োগ, সাংস্কৃতি ও মানবিক সহায়তা। জোর করে বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের নিরাপদে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি আমরা আলোচনা করেছি। আশিয়ানের ফোরামে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি জোরের সঙ্গে তোলার জন্য মালিয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি।
“পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায় এবং পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে নিয়মিত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার গুরুত্ব নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট করার জন্য ট্রেড নেগোশিয়েশন কমিটির বৈঠক শুরুর আশা করছি। কৃষি, জ্বালানি, শিক্ষা, হালাল অর্থনীতি, সেমি কন্ডাক্টর ইন্ড্রাস্ট্রি, কানেক্টিভিটি, ব্লু ইকনোমি, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রতিরক্ষা ও যুব উন্নয়নের বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার নতুন নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলেছি।”
সেবাখাতে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সেবা খাত দুই দেশের জন্য সম্ভাবনাময় একটি খাত। এই খাতে দুই দেশের জন্য লাভজনক বিষয়গুলো নিয়ে আমরা ঘনিষ্টভাবে কাজ করতে পারি। ভবিষ্যতে সহযোগিতার আরও দুটি খাত হতে পারে মোবিলিটি ও ফাইন্যান্সিং।
“দুই দেশের অর্থনীতিতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবদানের স্বীকৃতিতে ২০২২ সালে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিয়ে করা এমওইউর বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বাংলাদশে থেকে পেশাদার ও শ্রমিক নেওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়েও কথা হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে বলেন প্রধান উপদেষ্টা বলেন, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বিনিময়, ফ্যাকাল্টি এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলাপ হয়েছে। গভীর সমুদ্রের মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে মালয়েশিার পোর্ট কেলাংয়ের মধ্যে কৌশলগত কানেক্টিভিটির বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পেয়েছে।
দুই নেতার বৈঠকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়ার চলমান কর্মসূচিগুলো কার্যকর করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়।
‘নতুন’ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে ‘বিপ্লব’ ও ’সংগ্রাম’ শব্দগুলো বাংলায় উচ্চারণ করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। গত ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে আগে ফোন করে সমর্থন জানানোর কথাটিও তিনি বলেন।
জেল জীবনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি পড়ে বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কথা সংবাদ সম্মেলনে বলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। আর অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে চার দশকের পরিচয়ের কথাও তুলে ধরেন।
ইউনূস সরকার পরিচালনায় নিজেকে ‘অনভিজ্ঞ’ বলায় ইব্রাহিম তাকে বলেন, “আপনার সক্ষমতা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আপনার দীর্ঘ প্রচেষ্টার কাছে এই অনভিজ্ঞতা কোনো ব্যাপার না।
“আমি মনে করি, আজকের পৃথিবীতে এটারই অভাব সর্বত্র। আজকে ফিলিস্তিনের গাজা ও লেবাননের দিকে তাকালে কী দেখা যায়? মানবতা ও ন্যায়বিচারের অভাব।”
ব্যবসা ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, “এখানে মালয়েশিয়ার কোম্পানি আছে, সেখানেও বাংলাদেশিদের বিভিন্ন কোম্পানি রয়েছে। এখানে আরও কার্যকর অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব প্রয়োজন।
“কোম্পানিগুলোর দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত যেন সমাধান হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। অর্থনীতির মূল বিষয়গুলো এবং দুর্নীতির ক্ষেত্রে দুই দেশের সরকারের বিশেষ গুরুত্বের বিষয়টি কোম্পানিগুলো দেখছে। দুর্নীতির বিষয়ে আমরা কোনো ছাড় দেব না।
“শিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়টিও আমরা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে পারি। এবিষয়ে আরও আলোচনা হতে পারে।”
আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসাবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার।
ইউনূসের সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য আপনার প্রচেষ্টার বিষয়ে আমার আস্থা আছে। নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার বিষয়ে আপনার প্রচেষ্টাও আমি বিশ্বাস করি।”
বিদেশি গণমাধ্যমে ‘অতিরঞ্জন’ দেখছেন ইব্রাহিম
বাংলাদেশের বিষয়ে বিদেশি মিডিয়ায় ‘অতিরঞ্জন’ দেখার কথা তুলে ধরে ‘মানবিক মর্যাদা ও সহানুভূতির’ নীতি দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস সেগুলো উৎরাতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “আমরা বুঝতে পারি, সফল হওয়ার জন্য আপনাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের গুরুত্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। পাশাপাশি সংখ্যালঘু বা দরিদ্র বা প্রান্তিক মানুষের অধিকারকেও সম্মান জানাতে হবে। সেই নিশ্চয়তার জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।”
আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, “আমার জানা মতে, কিছু বিদেশি গণমাধ্যমে অতিরঞ্জন ও কাদা ছোড়াছুড়ি রয়েছে। তবে পুরুষ-নারীর অধিকার, মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা ও সহানুভূতির বিষয়ে আপনার আন্তরিকতার কথা আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি।
“এবং এখন আপনি সেই নীতিগুলো নিয়ে সরকারে আছেন। আমার আস্থা আছে, অতীতে আমরা যেভাবে (এসব ক্ষেত্রে) চেষ্টা চালিয়েছি, আপনি তার প্রতি সম্মান জানাবেন।”
কখনও কখনও পরিস্থিতির কারণে ‘বাড়াবাড়ি বা ‘অনিশ্চিয়তা’ তৈরি হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি আপনার অবস্থানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাই এবং আমি বিশ্বাস করি, আপনার নেতৃত্বে নতুন এই বাংলাদেশ, প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের বাংলাদেশ প্রত্যেক নাগরিকের অধিকারকে শ্রদ্ধা জানাবে।”
ঢাকায় ৫ ঘণ্টার ব্যস্ত সময়
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অধ্যাপক ইউনূস যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে শপথ নেন, তাকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রথম ফোনটি এসেছিল প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছ থেকে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রায় দুই মাসের মাথায় বিদেশি কোনো সরকারপ্রধানের প্রথম সফরে তিনিই ঢাকায় এলেন। পাকিস্তানে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষ করে পাঁচ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় আসেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘পুরনো বন্ধুকে’ স্বাগত জানান প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
বিমানবন্দরে গার্ড অব অনারের আনুষ্ঠানিকতা সারার পর কিছু সময়ের জন্য একান্ত আলাপে বসেন দুই সরকারপ্রধান। এরপর একই গাড়িতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের স্থান হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পথ ধরেন।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আসেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস ও প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। চা চক্রের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বঙ্গভবনে যান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গভবনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে দেশের পথ ধরেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। ‘পুরনো বন্ধুকে’ বিদায় জানাতে এ সময়ও বিমানবন্দরে ছিলেন অধ্যাপক ইউনূস।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এই সফর যে অল্প সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছিল, তা তুলে ধরে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, বড় পরিসরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় দ্রুততার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সফরটি আয়োজন করা হয়।
“উনি (আনোয়ার ইব্রাহিম) বললেন যে, ‘না, আমি এখনই আসব, এসে উনার সাথে দেখা করে যাব’। তারা বলেছে, ‘অফিসিয়াল ভিজিট হিসাবে নিতে চাই’।”
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৫৮ সদস্যের প্রতিনিধিদলে সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ মন্ত্রী, পরিবহন উপমন্ত্রী, ধর্ম বিষয়ক উপমন্ত্রী, দুইজন সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ আরও কিছু প্রতিনিধি ছিলেন এই সফরে।