২০২১ সালে বাংলাদেশিদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ছিল ৭২ দশমিক ৩ বছর। তার আগের বছর গড় আয়ু ছিল ৭২ দশমিক ৮ বছর।
Published : 17 Apr 2023, 09:18 PM
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ২০২১ সালে দেশে জন্মহার কমার পাশাপাশি মৃত্যুর হার ছিল আগের বছরের চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস অব বাংলাদেশ’ জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে প্রতি হাজার জনসংখ্যায় স্থূল জন্মহার ছিল ১৮.৮, যা ২০২০ সালে ছিল ১৮.১। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জন্মহার হাজারে কমেছে ০ দশমিক ৭ জন।
অন্যদিকে প্রতি হাজার জনসংখ্যায় ওই বছর স্থূল মৃত্যুহার পাওয়া যায় ৫.৭, যা ২০২০ সালে ছিল ৫.১ জন।
সোমবার রাজধানীর আগারগাওয়ের বিবিএস সম্মেলন কক্ষে এই প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান এবং প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৩০১ জন, যা ২০২০ সালে তা ছিল ১ দশমিক ৩০৩ জন।
তবে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীপ্রতি সন্তানের সংখ্যা আগের বছরের মতোই পাওয়া গেছে। ২০২১ সালে তা ছিল প্রতি হাজার ২.০৫, যা আগের বছর ছিল ২.০৪। গত চার বছর ধরেই এ হার মোটামুটি এক জায়গায় স্থির আছে।
তবে সাধারণ প্রজনন হার ২০২০ সালে প্রতি হাজারে ১.০১ থেকে কমে পরের বছর হয়েছে ০.৯৯ জন।
পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের এ প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন জানান, ২০২১ সালের ১ জুলাই সারা দেশে একযোগে এ জরিপ চালানো হয়। এক হাজার ২০০ নমুনা এলাকার ৩ লাখ ৩ হাজার ২৫০টি খানা থেকে গণনাকারীরা তথ্য সংগ্রহ করেন।
জন্মহার কমার পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির চিত্র পাওয়া গেছে জরিপে। দেখা গেছে, ২০২০ সালে দম্পতিদের ৬৩ দশমিক ৯ শতাংশ জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতেন, পরের বছর তা বেড়ে হয়েছে ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
শহরের তুলনায় গ্রামে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের অনুপাত বেশি। গ্রামে এটি পাওয়া গেছে ৬৫.৭ শতাংশ, যা শহরে ৬৫ শতাংশ।
কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার ছিল প্রতি হাজারে ২৮, যা আগের দুই বছরের সমান। এক বছরের নিচে এই হার ২০২১ সালে পাওয়া গেছে ২২, যা আগের বছর ছিল ২১।
প্রতি লাখ শিশুর জন্মের বিপরীতে মাতৃ মৃত্যুর অনুপাত পাওয়া গেছে ১৬৮ জন, যা ২০২০ এ ছিল ১৬৩ জন।
জনসংখ্যার সিংহভাগ কর্মক্ষম
আলমগীর জানান, ২০২১ সালে দেশে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৭ কোটি । এর মধ্যে ৮ কোটি ৫৯ লাখ নারী এবং ৮ কোটি ৪৩ লাখ পুরুষ।
এই জনসংখ্যার ২৭ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছর। ৫০ থেকে ৫৯ বছর বয়সী মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৮ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের বেশি।
যদি ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী জনসংখ্যাকে কর্মক্ষম ধরা হয়, তাহলে তা মোট জনসংখ্যার ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ ওই শ্রেণিতে পড়ে।
২০২১ সালে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব পাওয়া যায় ১ হাজার ১৫৩ জন।
এই প্রতিবেদনে জনসংখ্যার বিষয়ে যে তথ্য এসেছে, তা ২০২১ সালে করা জনশুমারি প্রতিবেদনের প্রায় সমান।
সেই জনগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেশে জনসংখ্যা দেখানো হয় ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার। পরে তা আরও প্রায় অর্ধকোটি বাড়িয়ে দেখানো হয় ১৬ কোটি ৯৮ লাখের কিছু বেশি।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে জনসংখ্যার ঘনত্ব দেখানো হয় ১ হাজার ১১৯ জন। পরে তা কিছুটা বাড়ে।
মানুষের স্থানান্তর কমেছে
এই জরিপে ২০২১ সাল মানুষের স্থানান্তর হার কমার তথ্য মিলেছে। আবার শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার হার প্রায় দ্বিগুণ হতে দেখা গেছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর বছরে প্রতি হাজারে ৮ জন শহর থেকে গ্রামে ফিরে গেছেন, যা আগের বছর ছিল ৪.৭ জন।
একই সময়ে গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর কমেছে। ২০২০ সালে প্রতি হাজারে যা ছিল ৩১.৩ জন, পরের বছর তা হয় ৩০.৮ জন।
গ্রাম থেকে গ্রামে স্থানান্তর হয়েছে প্রতি হাজারে ৩১.৯ জন, যা আগের বছর ছিল ৩২.৭ জন।
ওই বছরে প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ৬০.২ জন দেশের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় স্থানান্তর হয়েছেন, যা আগের বছর ছিল ৭১ জন।
তবে এক শহর থেকে আরেক শহরে বা শহরের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় স্থানান্তর বেড়েছে। ২০২১ সালে প্রতি হাজার ১২৫.৯ জন মানুষ শহর থেকে শহরে স্থানান্তর হয়েছেন, যা আগের বছর ছিল ১০৯.১ জন।
গড় আয়ু কমেছে
টানা এক যুগ গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার পর ওই বছর তা আগের বছরের তুলনায় ছয় মাস কমেছে বলে এই জরিপে উঠে আসে।
২০২১ সালে বাংলাদেশিদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ছিল ৭২ দশমিক ৩ বছর। তার আগের বছর গড় আয়ু ছিল ৭২ দশমিক ৮ বছর। কমেছে শূন্য দশমিক ৫ বছর বা ছয় মাস।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী গতবারের মত এবারও পুরুষের তুলনায় নারীর গড় আয়ু বেশি। আর গড় আয়ু বেশি কমেছে পুরুষদের।
২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশের পুরুষ বাঁচে গড়ে ৭০ দশমিক ৬ বছর, নারীর গড় আয়ু ৭৪ দশমিক ১ বছর।
আগের বছর পুরুষের গড় আয়ু পাওয়া যায় ৭১ দশমিক ২ বছর। আর নারীর ছিল ৭৪ দশমিক ৫ বছর।
অর্থাৎ পুরুষের গড় আয়ু কমেছে ০ দশমিক ৬ বছর, নারীর কমেছে ০ দশমিক ৪ বছর।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার বছরে দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৭ দশমিক ২ বছর।
বিপুল সংখ্যক নারী বিধবা
পুরুষের তুলনায় নারীর প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেশি হওয়ার কারণে দেশে বিপুল সংখ্যক নারী স্বামীহারা হয়েছেন।
এ জরিপ অনুযায়ী দেশের নারীদের শতকরা ৮ দশমিক ৭৭ জনই তাদের জীবনসঙ্গীকে হারিয়েছেন। পুরুষদের ০. ৯৭ শতাংশ স্ত্রীকে হারিয়েছেন।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর ১ দশমিক ০৬ শতাংশ নারী ছিলেন তালাকপ্রাপ্ত। অন্যদিকে পুরুষদের ০.৪০ শতাংশ তালাকপ্রাপ্ত।
শতকরা হিসেবে তালাকের হার শহরের তুলনায় গ্রামে প্রায় দ্বিগুণ। শহরে প্রতি হাজারে ০.৪৫ টি তালাক হয়, গ্রামে এই হার ০.৮১টি।
জরিপ অনুযায়ী দেশের ৪৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ পুরুষ অবিবাহিত। অন্যদিকে ৩৭ দশমিক ১৪ শতাংশ নারী অবিবাহিত।
মেয়েদের ২৫ শতাংশই বাল্যবিয়ের শিকার
এ জরিপে ২০২১ সালে পুরুষদের বিয়ের গড় বয়স পাওয়া গেছে ২৪ দশমিক ৩ বছর। নারীদের ক্ষেত্রে এটা আরেকটু কম; ১৯ দশমিক ১ বছর।
তবে মেয়েদের প্রতি চারজনের একজনের বিয়ে হয়েছে বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন বয়স ১৮ এর আগে।
নারী প্রধান পরিবার বেড়েছে
২০২২ সালের খানা জরিপ অনুযায়ী দেশে নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা কমেছে। তবে তার আগের বছর এটি বেড়েছিল বলে বিবিএসএরই করা জরিপ ‘মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস অব বাংলাদেশ’ এ উঠে এসেছে।
এই জরিপ অনুযায়ী নারীপ্রধান খানার সংখ্যা ২০২০ সালে ১৫ থেকে পরের বছর হয় ১৬ শতাংশ। পুরুষ খানা প্রধান কমে ২০২০ সালে ৮৫ থেকে কমে পরের বছর হয়েছে ৮৪।
খানার আকার ২০২০ এবং ২০২১ সালে অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতি খানার বিপরীতে মানুষের সংখ্যা ৪ দশমিক ৩ জন।
সাক্ষরতা হারে উত্থান পতন
সাত বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী জনসংখ্যার স্বাক্ষরতার হার ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে ৭৬.৪ শতাংশ। ২০২০ সালে তা ছিল ৭৫.২ শতাংশ।
এ ক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে এগিয়ে পুরুষরা। নারীদের মধ্যে ৭৪.২ শতাংশের সাক্ষরজ্ঞান আছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৭৮.৬ শতাংশ।
শহরের মানুষদের ৮৩.৭ জনেরই সাক্ষরজ্ঞান আছে, যা গ্রামে ৭৪.১ জন।
তবে ১৫ বছর তদূর্ধ্ব মানুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার কমে গেছে। ২০২১ সালে তা পাওয়া গেছে ৭৪.১ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৭৫.৬ শতাংশ।
মোবাইল ও ইন্টারনেটের ব্যবহার
২০২১ সালে দেশে ৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী পাওয়া গেছে ৫৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এরমধ্যে পূরুষ ৬৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং ৪৭ দশমিক ১০ শতাংশ নারী।
এর মধ্যে শহর এলাকায় ৬৬ দশমমিক ১৪ শতাংশ এবং গ্রাম এলাকায় ৫৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ মানুষ মোবাইল ব্যবহার করে।
১৫ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার ৭১ দশমিক ৩৪ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এর মধ্যে শহরে ৮০ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং গ্রাম এলাকায় ৬৮ দশমিক ৩১ শতাংশ।
৫ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৩৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর ১৫ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে মোট ৪৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এর মধ্যে ৫১ দশমিক ১০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৫১ শতাংশ নারী।
অন্যান্য তথ্য
দেশে বিদ্যুতের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯. ৪৪ শতাংশ। রান্নায় পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে ২৯ শতাংশ। এর আগে এটা ছিল ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
দেশের মোট ৯৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ মানুষের নিজস্ব বাসগৃহ আছে।
দেশের মোট ৩৯ দশমিক ১৬ শতাংশ মানুষ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আওতায় রয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ দশমিক ১০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ নারী।
স্বাস্থ্যকর টয়লেট ব্যবহারের প্রবণতাও বেড়েছে। ২০২১ সালে তা পাওয়া যায় ৮৫.৮ শতাংশ, ২০২০ সালে যা ছিল ৮১.৫ শতাংশ।
এছাড়া নিরাপদ পানি অভিগম্যতা রয়েছে ৭৩ শতাংশ মানুষের।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান অনুষ্ঠানে বলেন, “এই জরিপ যেহেতু প্রতিবছরই করা হয় সুতরাং প্রতিবছর আলাদা করে এই প্রকল্প গ্রহণ করার কোনো প্রয়োজন নাই। এটা বিবিএস এর রুটিন কাজ হিসেবে চালিয়ে নেওয়া ভালো।”
২০২২ সালের প্রতিবেদন আগামী জুন মাসে দেওয়ার কথা জানিয়ে মন্ত্রী আগামী বছর থেকে নতুন বছরের প্রথম প্রান্তিকেই আগের বছরের জরিপের ফল প্রকাশের নির্দেশ দেন।