“ওই যে হিন্দি ছবিতে দেখায় না, ওইরকম গ্রুপে গ্রুপে মারামারি সর্বক্ষণ। এই পক্ষের কাউকে একা পাইলে ওই পক্ষের লোকেরা সাইজ করে দেয়। এরপরই আবার ওই পক্ষ অস্ত্রশস্ত্র হাতে এই পক্ষকে দৌড়ানি দেয়।”
Published : 10 Sep 2024, 01:47 AM
ঢাকার আগারগাঁওয়ের একটি সেলুনের ‘বিহারী কর্মী’ জসীম থাকেন বিহারী ক্যাম্প নামে পরিচিত মোহাম্মদপুরের জেনিভা ক্যাম্পে। ইদানীং তিনি কাজে আসছেন বিলম্বে।
জসীমের ভাষ্য, “রাতভর এলাকায় মারামারি, গোলাগুলি চলতাছে। ঘুমই নাই। ক্যামনে দিনে জাইগা থাকি, আল্লাহই জানে।”
জেনিভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসার দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব বহুদিনের। তবে দেশের অস্থিরতার সময়- গেল জুলাই থেকে প্রাণক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে সেখানকার দুটি পক্ষ।
রোজই তাদের কেউ না কেউ হামলার শিকার হচ্ছেন। লাঠিসোঁটা হাতে মিছিল, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, মারধর-গোলাগুলি নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেনিভা ক্যাম্পের একেকটা ঘরের আয়তন সব মিলিয়ে ১০০ থেকে ১২০ বর্গফুটের মত বা তার চেয়ে একটু বেশিও আছে কোনোটা। কোনো কোনো ঘরে তিন প্রজন্মের সবাই একসঙ্গে থাকেন। ঘরের খাটে একদল আর খাটের নিচে আরেকদল ঘুমায়। ঘিঞ্জি পরিবেশ, সুপেয় পানি আর শৌচাগারের সংকটও আছে। এর মধ্যেই মাদক কারবারিদের সংঘাত তাদের জীবনকে বিভীষিকাময় করে তুলেছে।
বাসিন্দারা বলছেন, ক্যাম্পে মোটাদাগে মাদক নিয়ন্ত্রণ করে তিনটি পক্ষ, যারা দুই ভাগ হয়ে এই সংঘাতে জড়াচ্ছেন। তাদের মধ্যে এলাকার ভাগাভাগিও আছে। এক পক্ষের লোক আরেক পক্ষের এলাকায় ঢুকলেই হচ্ছে হামলা; এরপর তা গড়াচ্ছে সংঘর্ষে। এমনটা চলছে গত ছয়মাস ধরে।
আর সেই সংঘাত প্রাণক্ষয়ী হয়ে উঠেছে লুট হওয়া অস্ত্রে। গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থানা ও নিরাপত্তা বাহিনীর স্থাপনা থেকে লুটের প্রচুর অস্ত্র জেনিভা ক্যাম্পে ঢুকেছে বলে জানাচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
তাদের একজন বললেন, “এখন মারামারি লাগলেই বড় বড় বন্দুক নিয়া বাইর হয় তারা। এর মধ্যে দুইজন গুলিতে মরছে, কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনো হাসপাতালে।”
স্থানীয়দের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গণভবনের পাশাপাশি মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা লুটের সামনের সারিতে ছিলেন জেনিভা ক্যাম্পের কিছু তরুণ। এই তিন জায়গা থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ তারা লুট করে ক্যাম্পে নিয়ে এসেছেন।
সাম্প্রতিক কয়েকটি সংঘাতে এরকম বড়সড় অস্ত্র হাতে মহড়া দিতে ও গুলি ছুঁড়তে দেখা গেছে সংঘাতে জড়ানো দুই পক্ষকেই।
সবশেষ গেল বুধবার সকালে জেনিভা ক্যাম্পে দুই পক্ষের গোলাগুলির সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ যায় ৩০ বছর বয়সী সাদ্দাম হোসেন সনুর। এর আগে ৬ অগাস্ট শাহেন শাহ নামে আরেকজনও প্রাণ হারান গুলিবিদ্ধ হয়ে। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে বিষয়টি তখন আলোচনায় আসেনি।
দ্বন্দ্ব অর্ধ যুগ ধরে
ক্যাম্প সংলগ্ন এক মোটরসাইকেল মেকানিকের দোকানে বসে কথা হচ্ছিল কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের কথায় উঠে এল সেখানকার মাদক সাম্রাজ্যের ইতিবৃত্ত।
তাদের তথ্য অনুযায়ী, বছর কয়েক আগে পুরো ক্যাম্পের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল নাদিম হোসেন ওরফে পাঁচ্চিশ ও ইশতিয়াক নামের দুই যুবকের হাতে। দুজনই মাদক কারবার করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন, পালতেন ব্যক্তিগত বাহিনী।
পাঁচ্চিশ আর ইশতিয়াকের দানের হাতও ছিল বড়, সে কারণে তাদেরকে চিনতেন, জানতেন ক্যাম্পের লোকজন; অনেকে সহানূভূতিও দেখান ওই দুই মাদক কারবারিকে। আর এই কারণেই ক্যাম্পের ভেতরে লুকিয়ে থাকা তাদের জন্য সহজ হত।
নাদিমের নামের সঙ্গে ‘পাঁচ্চিশ’ জড়িয়ে গেল কীভাবে? ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারানো নাদিম অভাব-অনটনের কারণে সেখানকার একটি হোটেলে কাজ নেন। তার দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে এক ভাই ও এক বোন প্রতিবন্ধী।
নাদিম হোটেলে কাজ করে দিনে পেতেন ২৫ টাকা, ওই সময়ই এক পুঁটলি গাঁজা বেচতেন ২৫ টাকায়। বেতন আর গাঁজার দাম একই হওয়ায় নাদিমকে স্থানীয়রা ‘পাঁচ্চিশ’ নামে ডাকতে শুরু করে; একপর্যায়ে নাদিমও নিজেকে ‘পাঁচ্চিশ’ নামেই পরিচয় দিতে থাকেন।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে পূর্বাচলে র্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন পাঁচ্চিশ। এরপর ভারতে পালিয়ে যান ইশতিয়াক। মহামারীর সময় কোভিড আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান বলে ক্যাম্পে জনশ্রুতি আছে।
বাসিন্দারা বলছেন, ইশতিয়াকের মারা যাওয়া, জানাজা ও দাফনের ভিডিও সে সময় ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর থেকেই মূলত ইশতিয়াক আর পাঁচ্চিশের মাদক সাম্রাজ্য দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যা এখন রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের রূপ নিয়েছে।
বর্তমানে এ ক্যাম্পে বছরে একশ কোটি টাকার বেশি মাদকের লেনদেন হয় বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
এই চক্রের সঙ্গে জানাশোনা আছে- এমন এক বয়স্ক গাড়িচালক বললেন, “এই ক্যাম্পে মাদক ব্যবসার ইতিহাস অনেক পুরনো। সত্তর-আশির দশকে এখানে গাঁজা বিক্রি হইতো, পরে আসলো ফেন্সিডিল। আশপাশের স্কুল-কলেজের পোলাপাইন দল বাইন্ধা আসত ‘ডাইল’ খাইতে।
“হেরোইনও বিক্রি হইতো একসময়, এখনো কিছু হয়। তবে গত এক যুগ ধইরা পুরা বাজার ইয়াবার দখলে। পাঁচ্চিশ আর ইশতিয়াক তখনই (২০১৮ সালে) দিনে কয়েক লাখ টাকার মাল বেচত। তাদের কাছ থেকে পাইকারি হিসেবে ইয়াবা কিনতে আসত ঢাকা ও বাইরের বিভিন্ন এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরা। পাশপাশি খুচরা বিক্রির স্পটও ছিল।”
ওই চালকের ভাষ্য, “পাঁচ্চিশ এবং ইশতিয়াকের মাদক সাম্রাজ্য দখল নিতে কয়েকটি গ্রুপ উঠেপড়ে লাগে। যার কারণে গত তিন বছরে ক্যাম্পে কখনো শান্তি ছিল না; যখন তখন হইহল্লা শোনা যায় এবং লাঠি-ধারালো অস্ত্র হাতে ছেলেপেলেরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। এখন এইটা একটা যুদ্ধের ময়দান।
“ওই যে হিন্দি ছবিতে দেখায় না, ওইরকম গ্রুপে গ্রুপে মারামারি সর্বক্ষণ। এই পক্ষের কাউকে একা পাইলে ওই পক্ষের লোকেরা সাইজ করে দেয়। এরপরই আবার ওই পক্ষ অস্ত্রশস্ত্র হাতে এই পক্ষকে দৌড়ানি দেয়। আমরা যে বাচ্চাকাচ্চা নিয়া ক্যামনে থাকি। কখন কারে বিরোধী পক্ষ কইয়া মারে, কার ঘরে হামলা দেয়- কেউ জানে না। সবাই আতঙ্কে আছে।”
রিকশা চালক, স্কুল শিক্ষক- শিকার নয় কে?
গত বুধবার গুলিতে নিহত অটোরিকশা চালক সাদ্দাম হোসেন সনুর বাবা বাবুল মিয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল শনিবার। সনুর চার বছরের ছেলেকে নিয়ে মোহাম্মদপুরে হাঁটছিলেন দাদা বাবুল।
আলাপচারিতায় তিনি বললেন, “আমার ছেলেরে টার্গেট কইরা মারছে। ও মাদকের বিরোধী ছিল।”
সনু রিকশা চালাতেন, মাঝে মাঝে কারচুপি নকশার কাজ করতেন। বুধবারের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাবুল মিয়া বলেন, “ওইদিন সকালে আগে থেকেই মারামারি-গোলাগুলি চলতেছিল। তখন সনু আর শাহ আলম ঘর থিকা বাইর হইছিল, তখন গুলি লাগে। সনু মারা যায়, শাহ আলম হাসপাতালে আছে।”
কারা মারামারি করছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ওই যে জি ব্লকের বুনিয়া সোহেল, রানা, টুনটুন, কালো- এরা সবাই মিলে আরকি। এদের সাথে যারা হেরোইন বেচতে দেবে না- তাদের সাথে মারামারিটা হচ্ছে।
“ওইদিনকা সকালে সে গাড়ি নিয়া বাইর হবে, ওর কিস্তি আছিল, এইজন্য বাইর হইতে হইছে। তখনি ওরা মাইরা দিছে।”
এ ঘটনায় সনুর ভাই রমজান ১০ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত ২৫-৩০ জনকে আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন, যাতে আসামি করা হয়েছে বুনিয়া সোহেল ওরফে ভুঁইয়া সোহেলসহ তার লোকজনকে।
বাকি নয় আসামি হলেন- টুনটুন (সোহেলের ভাই), কলিম জাম্বু, বাবু (সৈয়দপুইরা বাবু), এরফান (কামাল বিরিয়ানির মালিকের ছেলে), আমিন, রানা, নওশাদ, আরিফ ও তার মা সীমা।
এজাহারে বলা হয়, ‘মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলায়’ সনুকে খুন করা হয়েছে। সনুর বুকে ১২টি ও হাতের কনুইতে দুটি গুলি লাগে।
সেদিনের সংঘাতের একটি ভিডিও ক্যাম্পের লোকজনের অনেকের কাছে আছে। সেখানে দেখা যায়, বড় একটি বন্দুক হাতে হাফপ্যান্ট পরা একজন ছুটছেন। এর একটু পরে আবার অন্য পক্ষকে ছোট অস্ত্র থেকে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়।
হাফপ্যান্ট পরা ওই অস্ত্রধারী মামলার আসামি ‘কলিম জাম্বু’ বলে জানাচ্ছেন ক্যাম্পের লোকজন। তাদের ভাষ্য, ওই অস্ত্রটি পুলিশের থেকে লুট করা অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি।
তবে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের দুইজন কর্মকর্তা ওই ভিডিওটি দেখে বলেছেন, ওই ধরনের অস্ত্র পুলিশ ব্যবহার করে না। ওটিকে তারা ‘বাটসহ শটগান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
বুধবার সকাল ৮টার দিকে গুলিতে নিহত হন সনু; সেদিন দিনভর চলে সংঘাত আর গোলাগুলি। তার আগের দিন বেলা সোয়া ১০টার দিকে স্কুল শিক্ষক আজগর সানিকে কুপিয়ে আহত করেন বুনিয়া সোহেল, তেজামুলসহ কয়েকজন। (‘ভীষণ উগ্র’ অর্থে একজনকে তেজামুল নামে ডাকেন বাসিন্দারা, যার অর্থ অ্যাসিড। তেজামুলের আসল নাম জানা সম্ভব হয়নি)
সানি জেনিভা ক্যাম্পের ভেতরে ‘নন লোকাল জুনিয়র হাই স্কুল’ বা এনএলজে স্কুলের গণিতের শিক্ষক।
সানির ভাষ্য, তার ভাতিজা সাকিল প্রতিপক্ষের সদস্য অভিযোগ তুলে তার ওপর হামলা চালানো হয়। এই দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হচ্ছে মাস ছয়েক ধরে। গত ৩ সেপ্টেম্বর সকালে স্কুলের প্রথম শিফট শেষে বাসায় ফেরার পথে তিনি বুনিয়া সোহেলদের খপ্পড়ে পড়েন।
ওই স্কুল শিক্ষক বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে মোট নয়টি সেক্টর। তিনি থাকেন ৫ নম্বর সেক্টরে আর তার স্কুলটি হচ্ছে ৩ নম্বর সেক্টরে। ঘটনার দিন স্কুলের প্রথম শিফট শেষে বাসায় যাচ্ছিলেন নাস্তা করতে। ৭ নম্বর সেক্টরের আল ফালাহ মেডিকেলের সামনে তার পথরোধ করে বুনিয়া সোহেল, তেজামুলসহ কয়েকজন।
সানির ভাষ্য, “ধরেই সোহেল বলতে শুরু করে, ‘এ ওই এলাকার লোক, শাকিলের চাচা- এরে মার’। আমি বলছি যে, ভাই আমি কোন মারামারির মধ্যে নাই, আমি স্কুলে পড়াই। কিন্তু ওরা আমার কোন কথাই শুনলো না। কয়েকজন মিলে লাঠিসোঁটা, চাকু-দা অস্ত্র নিয়া মারা শুরু করলো। আমার কাঁধ, হাত-পায়ে অনেক ডিপ হইয়া কাটছে। হাসপাতালে গেলে সেখানে ২৭টি সেলাই দিছে ডাক্তাররা।”
কাদের মধ্যে মারামারি হচ্ছে, জানতে চাইলে সানি বলেন, “আমাদের ওখানকার কিছু লোকজনের সঙ্গে ৭ নম্বর সেক্টরের বুনিয়া সোহেলদের মারামারি। এটা ছয়মাস ধরে চলছে। বহু লোকজন এভাবে হতাহত হয়েছে।”
তার এলাকার লোকজন কোনো গ্যাংয়ের সদস্য কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে সানি বলেন, “আমি এত বলতে পারব না। তবে আমার ভাতিজা সাকিল র্যাব-পুলিশের সঙ্গে কাম করত।”
কারা আছে দুই পক্ষে
পাঁচ্চিশ ও ইশতিয়াকের অবর্তমানে ক্যাম্পের শতকোটি টাকার মাদক কারবারের দখল নিতে উঠেপড়ে লাগে দুটি পক্ষ। একটি পক্ষের নেতৃত্বে আছেন বুনিয়া সোহেল, আরেকটি পক্ষের নেতা চুয়া সেলিম। বুনিয়া সোহেলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সৈয়দপুইরা (নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে আসা ‘বিহারি’) নামের আরেকটি পক্ষের নেতা বাবু ওরফে সৈয়দপুইরা বাবু।
চুয়া সেলিম বুধবারের সংঘাতে প্রতিপক্ষের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সেদিন চুয়া সেলিমের লোকজন ব্যাপক মাত্রায় হতাহত হয়। গুলিতে নিহত সনুও সেদিন চুয়া সেলিমের পক্ষে ছিলেন বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। তারা এও বলছেন, বুধবারের পর থেকেই ক্যাম্পে বুনিয়া সোহেলের একাধিপত্য চলছে।
গত ছয় মাস ধরে সোহেল ও সেলিমদের সংঘাত রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে পুরো ক্যাম্পের ৫০ হাজার মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। দুই পক্ষের এলাকা ও স্পট ভাগ করা আছে। কেউ ‘লাইন ক্রস’ করে প্রতিপক্ষের এলাকায় গেলেই মারধর, হামলার শিকার হতে পারেন। এরকম ছোটখাট মারামারি প্রায়ই ঘটছে।
ক্যাম্পের বাসিন্দা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বললেন, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও তার ব্যক্তিগত সহকারী বিপ্লবের সঙ্গে সখ্যের সুবাদে মাদক কারবারিদের হয়ে থানা-পুলিশ ‘ম্যানেজ’ করতেন ক্যাম্পের বাসিন্দা মচুয়া সাঈদ, নূর ইসলাম চারকু, ইকবাল, হারুন খানসহ কয়েকজন।
তারা কাউন্সিলর সৈয়দ হাসানুর ইসলাম রাস্ট্রনকেও টাকা দিয়ে ‘হাতে রেখেছিল’। কোন ‘ঘাটে’ কতো টাকা যাবে- তা ওই দুইজন সামলাতেন। ফেইসবুকে ক্যাম্পের বিভিন্ন গ্রুপে নানকের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজেদের তোলা ছবি পোস্ট করতেন তারা।
পুলিশ ক্যাম্প থেকে মাঝে-মধ্যে দুই-একজনকে ধরা হলেও দেনদরবার করে ছাড়িয়ে নিতেন তারাই। পুলিশের কাকে কতো টাকা দিতেন, কর্মকর্তাদের নাম ধরে তারা তা ক্যাম্পে প্রচারও করে বেড়াতেন।
থানার ওসি, ইন্সপেক্টর আর দারোগাদের নাম মুখস্থ এখানকার সবার। এমনকি ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হলে থানার এক পরিদর্শকের ডাকে ক্যাম্প থেকে প্রায় ৮০ জন গিয়েছিলেন আন্দোলন ঠেকানোর লড়াইয়ে। ৪ অগাস্টও ক্যাম্পের লোকজন লাঠিসোঁটা আর বন্দুক হাতে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে লড়েছে।
৬ অগাস্ট মাদক নিয়ে ক্যাম্পে সংঘটিত সংঘাতে নিহত শাহেন শাহর মামা জামিল বলেন, “আমাদের এখানে এমপি ছিল নানক, আর আমাদের কাউন্সিলর রাস্ট্রন- এদের পক্ষের ছেলেরা, আমাদের ক্যাম্পেরও ছেলেরা এইখানে গুলি করছে। তার জন্য আমার ভাগ্নাকে লাগল, আর মারা গেল।”
চুয়া সেলিম পক্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন বলেন, “সেদিন সনুকে পেয়ে তারা (বুনিয়া সোহেলরা) এলোপাতাড়ি গুলি করে ছেলেটাকে মারছে। ওইদিনের সংঘর্ষে চুয়া সেলিম নিজেও গুলি খাইছে। সেলিমসহ শাহ আলম, চোর জানু, শুভ ও পাট্টু এখনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে।”
বুনিয়া সোহেল ও তার লোকজনের বেশিরভাগই থাকেন ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরে, এটা তাদের এলাকা। আল ফালাহ মেডিকেল সংলগ্ন জি ব্লকে বুনিয়া সোহেলের মাদকের স্পট। সৈয়দপুইরা পক্ষের এলাকা হচ্ছে এনএলজে স্কুল রোড, সেখানেই তাদের মাদক বেচাকেনার কেন্দ্র বা স্পট। আর চুয়া সেলিমের এলাকা হচ্ছে এবি ব্লক পাক্কা (পাকা) ক্যাম্প।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য জানতে বুনিয়া সোহেল, সৈয়দপুইরা বাবু ও চুয়া সেলিমের মোবাইলে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি। সোহেলের তিনটি নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। চুয়া সেলিম গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে থাকায় ফোন ব্যবহার করছেন না বলে জানিয়েছেন তার লোকজন।
তারা হাসপাতালের নাম প্রকাশ না করায় সরাসরি যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়নি।
আত্মগোপনে থাকায় জাহাঙ্গীর কবির নানক, সৈয়দ হাসানুর ইসলাম রাস্ট্রন কিংবা ‘থানা-পুলিশ ম্যানেজকারী’ মচুয়া সাঈদদের বক্তব্য জানা যায়নি।
ক্যাম্পের নেতাদেরও দুষছেন স্থানীয়রা
জেনিভা ক্যাম্পের নন লোকাল রিলিফ কমিটির (এনএলআরসি) চেয়ারম্যান এস কে গোলাম জিলানীর পরিবারকেও মাদক কারবার বিস্তারের জন্য দুষছেন স্থানীয়রা। তাদের ভাষ্য, জিলানীর ছেলে এস কে রব্বানীসহ আরও কিছু স্বজন বুনিয়া সোহেলের পক্ষে কাজ করেন।
তবে জিলানী বলছেন, একমাস আগে ক্যাম্পের লোকজনের হামলার শিকার হওয়ার পর থেকে তিনি আর সেখানে যান না। সেখানে কী হচ্ছে, সে বিষয়ে কোন খবরও রাখেন না।
জেনিভা ক্যাম্পে অবস্থানরত আটকে পড়া পাকিস্তানিদের দুটি প্রধান সংগঠনের একটি হচ্ছে এনএলআরসি। জিলানী প্রায় ১৬ বছর ধরে এই সংগঠনের চেয়ারম্যান।
ঢাকার জেলা প্রশাসক দুই বছরের জন্য এই কমিটির অনুমোদন দিয়ে থাকেন। তবে ১৬ বছর ধরে সেটা হচ্ছে না। দীর্ঘ সময় পদ আঁকড়ে থাকার কারণে ক্যাম্পে জিলানী চেয়ারম্যান হিসেবেই বেশি পরিচিত।
জিলানীর ছেলে রব্বানীসহ অন্য স্বজনেরা বুনিয়া সোহেলের গ্রুপে ভিড়েছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে জিলানী বলেন, “এসব মিথ্যা কথা। লোকে কতো কিছু যে বলে! সব হিংসা বুঝছেন।”
আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সবচেয়ে বড় সংগঠন হচ্ছে স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিহ্যাবিলিটেশন কমিটি বা এসপিজিআরসি।
এ সংগঠনের সভাপতি এম শওকাত আলী বলছেন, “মাদকের স্পট নিয়ে এ ঝগড়াগুলো হচ্ছে। লোক মরতেছে। মাদকের তিনটা গ্রুপ আছে, তাদের মধ্যেই আছে এসব হইতে আছে। জনগণ সব জানে, কিন্তু তারা জিম্মি হয়ে আছে। তারা ঝগড়া করতেছে- আর জনগণের ঘর, বাড়ি, দোকানপাট সব ভাঙচুর করতেছে।
“আমরা থানায়, র্যাবে, আর্মিতে- সব জায়গায় খবর দিছি। কিন্তু দেশের এই পরিস্থিতিতে কেউ আসতেছে না। এখান থেকে আমাদের উদ্ধার হওয়া উচিৎ। আমরা আশা করতেছি দুই-একদিনের মধ্যে আর্মি আইসা এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের উদ্ধার করবে।”
এখন পুরো ক্যাম্প কি মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণে? উত্তরে শওকাত বলছেন, “পুরো ক্যাম্প তাদের দখলে না, কিন্তু তাদের সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। এরা ছোট ছোট বাচ্চা, বেকার যুবকদের দুই-তিনশ টাকা দিয়ে মাদক বেচতে লাগায় দেয়।”
ক্যাম্পের তিন মাদক গ্রুপে কারা, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “ক্যাম্পের শিক্ষিত লোকজন এসব কাজে জড়াতে চায় না, তাদের বিষয়ে কেউ কথাও বলে না। সবারই তো ভয় আছে।”
বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, সৈয়দপুইরা বাবু বলে তিনটি মাদক গ্রুপের নাম যে ক্যাম্পে সবার মুখে মুখে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শওকাত বলেন, “হ্যাঁ, ওরাই।”
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর লুটের অস্ত্র ক্যাম্পে ঢুকেছে বলে বাসিন্দারা বলছেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসপিজিআরসি সভাপতি বলেন, “আমিও এরকম শুনেছি।”
এসব বিষয় নিয়ে মোহাম্মদপুর থানার ওসি ইফতেখার হাসান বলছেন, ক্যাম্পে কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে ঝামেলা চলছে। তাদের সংঘাতেই অটোরিকশা চালক সনু নিহত হয়। সনু হত্যা মামলার আসামিদের ধরার চেষ্টা করছে পুলিশ।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার মোহাম্মদ রুহুল কবীর খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জেনিভা ক্যাম্প এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিযাগ। সম্প্রতি খুনের ঘটনাও ঘটেছে।
জেনিভা ক্যাম্প নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এসব ব্যাপারে আমরা খুবই সচেতন। মাদক নির্মূল করতে এবং অপরাধীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের পাশপাশি অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।”