“আমাদের প্রত্যাশা ছিল আমরা বিচার বিভাগ কিছুটা হলেও স্বাধীন দেখতে পাব। সে আশা পূরণ হয়নি,” ব্লাস্টের পরিচালক বরকত আলী।
Published : 20 Mar 2025, 04:14 PM
দেশের মানবাধিকার কর্মী, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ‘উদ্বেগ এবং দাবি’ বিবেচনায় নিলে জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন দেওয়ার দরকার হত না বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনা প্রতিরোধে ‘আন্তর্জাতিক’ দলিল হিসেবে জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সরকারের কাছে একটা সুনির্দিষ্ট ‘সময়বদ্ধ রোডম্যাপ’ চেয়েছেন তিনি।
একইসঙ্গে র্যাবের পাশপাশি মানুষের ‘মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত’ হওয়ার নজরদারিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার-এনটিএমসিও বিলুপ্ত করার বিষয়ে জোর দেন এইচআরএফবি এর এ সদস্য।
বৃহস্পতিবার ঢাকার ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে রোডম্যাপ প্রণয়ণের দাবিতে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের অনুসন্ধানী দল।
১২ ফেব্রুয়ারি জেনিভায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্ক ও অন্যরা।
সে প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বাহিনী, বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সুশাসনের ক্ষেত্রে একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়– ওএইচসিএইচআর।
প্রতিবেদনে এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বিলুপ্তির সুপারিশের পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) কেবল সীমান্তরক্ষা এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরকে কেবল সামরিক গোয়েন্দা তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সুপারিশ রয়েছে।
এইচআরএফবি সদস্য ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রতিবেদনে পাঁচটি বিভাগে ৪৩টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ আছে। আমরা বাংলাদেশে মানবাধিকার কর্মী, সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষ, যাদের নাগরিক সমাজ বলি। আমাদের যে উদ্বেগ, আমাদের যে দাবিগুলো দীর্ঘদিন যাবত উত্থাপিত হয়ে আসছে, সে দাবিগুলো যদি পূরণ হতো সে দাবিগুলো যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে বিবেচনা করত তাহলে একদিকে যেমন এ প্রতিবেদনের দরকার হয় না, অন্যদিকে বাংলাদেশে যেভাবে কর্তৃত্ববাদ বিকাশ হয়েছিল সেটা হত না।”
সংস্কার কমিশনের ছয়টি প্রতিবেদন হয়েছে, আরও পাঁচটি হবে তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমার জানামতে পাঁচটিসহ ছয়টি প্রবিবেদনের সুপারিশের সাথে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের মিল আছে। যে কথাগুলো জাতিসংঘ বলেছে সেগুলো খুব একটা রকেট সায়েন্স তা না, তবে আমাদের দীর্ঘদিনের যে উদ্বেগ ছিল সেটাকে একটা আন্তর্জাতিক দলিলের মধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে। সে কারণেই এটি গুরুত্বপূর্ণ।”
“আমরা যদি প্রতিরোধের কথা চিন্তা করি, যদি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করি, প্রতিরোধের যে সুপারিশগুলোকে আমরা সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে চাই।
“সরকারের কাছ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট সময়বদ্ধ একটা রোডম্যাপ চাই। যা প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে করণীয়গুলো নির্ধারণ করবে।”
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশে যেভাবে দুর্নীতির ব্যপকতা, গভীরতার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল, যে কারণে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্থপাচারের সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। সেটি কিন্তু ছিল কর্তৃত্ববাদের বিকাশের অন্যতম অনুঘটক।”
পুলিশ ও নিরাপত্তার খাত সম্পর্কে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, “এরমধ্যে একটি আন্তর্জাতিক চর্চার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পুলিশ অধ্যাদেশ যেটা আছে ১৮৬১, এমন কোন দেশ আছে যেখানে দুইশ বছরের পুরাতন একটা আইন দিয়ে পুলিশ চলে? তারা বলেছে এটাকে আন্তর্জাতিক চর্চার আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
“আরেকটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন, এটা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি এটা এ প্রতিবেদনেও এসেছে। এটা নিশ্চিত হোক আমরা প্রত্যাশা করব। আনফরচুনেটলি পুলিশ সংস্কার কমিশন এটার বিষয়ে জোরালোভাবে অবস্থান নেয়নি, কেন নেয়নি আমাদের কাছে বোধগম্য না। আমরা মনে করি, অবশ্যই স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে।”
তিনি বলেন, “র্যাব বিলুপ্তির সুনির্দিষ্ট সুপারিশ এসেছে, যেটা দীর্ঘদিনের মানুষের প্রত্যাশা। বিজিবির দায়িত্ব একটা সুনির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে, বর্ডার গার্ড বাহিনী। তাকে তার ম্যান্ডেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা।”
“ডিজিএফআইকে বলেছে পরিস্কারভাবে, ডিজিএফআই এর ম্যান্ডেট হচ্ছে এটি নিরাপত্তা সংস্থা সংক্রান্ত গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান। যদের উপর মানুষের অধিকার সংক্রান্ত গোয়েন্দাগিরির দায়িত্ব বর্তায় না। শুধুমাত্র সামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। আনসার ভিডিপির সামরিক কর্তৃত্ব বন্ধ করতে হবে।
“আরেকটি প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তির কথা বলা হয়েছে, সেটি হচ্ছে এনটিএমসি। এটিকে বিলুপ্ত করতে হবে। একইসাথে সংশ্লিষ্ট একটা প্রস্তাব আছে, আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। বাংলাদেশকে নজরদারিভিত্তিক সমাজে পরিণত করা হয়েছিল। নজরদারির ক্ষেত্রে তারা বলছে পরিস্কারভাবে যে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে বিশেষ করে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, এ ধরণের কোন নজরদারি আমাদেরকে সরে আসতে হবে।”
জাতিসংঘের প্রতিবেদনের কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে এইচআরএফবি সদস্য ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সব প্রতিবেদনেই সীমাবদ্ধতা থাকে। আমরা সেটা উল্লেখ করেছি। আমরা এ কারণেই উল্লেখ করেছি, যাতে বিষয়গুলো সরে না যায়। আমাদের এ ধরনের যে সংস্কার কার্যক্রম বা রাষ্ট্র সংস্কারের যে পরিকল্পনা চলছে তারমধ্যে এ বিষয়গুলো যেন আমাদের দৃষ্টির ভেতরেই থাকে সবসময় বা মনোযোগের মধ্যে থাকে সেজন্য উল্লেখ করেছি।”
প্রতিবেদনে আদিবাসী এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপর হামলার বিষয়গুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, “পরিচয়ভিত্তিক যে মানুষের অবস্থান। সেটাকে ভিত্তি করে মানুষকে হয়রানি করা, নির্যাতন করা, বৈষম্য করা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।”
নজরদারি বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যে কারণে নজরদারির বিষয়টি, সুপারিশমালার বিষয়টি উল্লেখ করেছি, আমরা আগেও বলেছি। আমাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তি পরিচয়ের পরিবর্তন হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন হয়নি, চর্চার পরিবর্তনতো হয়ইনি।
“সে কারণে এই নজরদারির যে চর্চা, পাশাপাশি নজরদারি যে সংস্থাগুলো করে থাকে তাদের সংস্কারের বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের অধিকারভিত্তিক বিষয়গুলোকে, মৌলিক অধিকার হরণ করা হয় যে ধরনের নজরদারির মাধ্যমে, সেগুলো থেকে নিজেদের বিরত না রাখে তাহলে বাস্তবে যে সম্ভাবনার কথা বলছি- এ ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘন বাংলাদেশে হবে না, এ স্বপ্নটা অধরা থেকে যাবে।”
ব্লাস্টের পরিচালক মো. বরকত আলী বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা ছিল আমরা বিচার বিভাগ কিছুটা হলেও স্বাধীন দেখতে পাব। সে আশা পূরণ হয়নি। দীর্ঘদিনের জঞ্জাল হয়ত দুদিনে শেষ হবে না। কিন্তু কিছুটা উদ্যোগ থাকা দরকার ছিল। যেগুলো এখনো আমাদের জন্য আসেনি।”
নারী পক্ষের প্রতিনিধি রওশন আরা বলেন, “জাতিসংঘের প্রতিবেদনে কিন্তু বলা হয়েছে যে এটা আরো বেশি তদন্ত করতে হবে, কিন্তু সেটা কে করবে? এটা নিয়ে এখন আমরা খুব একটা পরিষ্কার ধারণা পাই না।”
“আমরা শুনেছি যারা আহত হয়েছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত অনুদান আসছে। সে ধরনের একটা পরিকল্পনা করা হয়েছে। আহতরা যাতে সুস্থ জীবন ফিরে পায়। কিন্তু সেটা আসলে কতটুকু হচ্ছে?”
সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের সুপারিশমালার লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরেন আইন ও সালিস কেন্দ্রের সমন্বয়ক তামান্না হক রীতি।
সেখানে বক্তব্য রাখেন- নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভলপমেন্ট এর নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন কর্মকার ও এএলআরডি এর নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।