বাসার বারান্দা, ছাদ আর অলিগলিতে ভিড় জমানো তরুণ, কিশোর-কিশোরী স্বাগত জানাল নতুন বছরকে, বলে উঠল ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’।
Published : 01 Jan 2024, 12:06 AM
ঘড়ির কাঁটা ১২টার ঘরে যাওয়ার ঠিক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় আনন্দ আয়োজন; স্বল্প সময়ের জন্য রাতের নিরবতা ভেঙে চারিদিক হয়ে ওঠে বর্ণিল, শব্দে কেঁপে ওঠে শীতের রাতের ঢাকা।
উৎসব উদযাপনের আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ারে উবে যায় নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল। আতশবাজিতে রঙিন হয়ে ওঠে কুয়াশা ছড়ানো রাতের আকাশ, অসংখ্য ফানুস আলো ছড়ায় চারিদকজুড়ে।
বাসার বারান্দা, ছাদ আর অলিগলিতে ভিড় জমানো তরুণ, কিশোর-কিশোরী স্বাগত জানাল নতুন বছরকে, বলে উঠল হ্যাপি নিউ ইয়ার।
বিধি নিষেধের কড়াকড়ি ও বেড়াজালের মধ্যেই এভাবে নতুন খ্রিষ্টীয় বছর বরণে ঢাকাজুড়ে আতশবাজি পুড়ল, পটকার শব্দে প্রকম্পিত হলো এলাকার পর এলাকা।
রোববার রাত ১২টা ১ মিনিট হওয়ার আগেই একে একে আতশবাজির আলো বর্ণিল হয়ে উঠতে শুরু করে রাজধানীর আকাশ। থেমে থেমে পটকার শব্দের সঙ্গে বাসাবাড়ি থেকে উল্লাস ধ্বনিতে স্বাগত জানানো হয় নতুন বছরকে।
আগের বছরের অভিজ্ঞতায় এবার অনেক আগে ভাগেই কড়া অবস্থানে ছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। আতশবাজি, পটকা ও ফানুস ওড়ানোতে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি চার দেয়ালের বাইরে উন্মুক্ত স্থানে এমনকি ছাদেও অনুষ্ঠান আয়োজনে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।
তবে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উচ্ছ্বাসে বিধিনিষেধের এ বেড়াজাল বাধা হয়ে থাকল না, আলোকিত হয়ে উঠল ঢাকার আকাশ; শব্দে কাঁপল চারিদিক।
আগের বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও ফানুস উড়েছে বিভিন্ন এলাকায়। নিষেধাজ্ঞার কড়াকড়ি মাড়িয়ে ফানুস ওড়ানো হয়েছে বিভিন্ন বাসাবাড়ির ছাদ ও অলি গলি থেকে।
এর মধ্যে পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারের ঐতিহ্যবাহী বিউটি লাচ্ছির দোকানের পাশে একটি গুদামে আগুন লাগার খবর দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
রাত ১২টা ৩৬ মিনিটের দিকে আগুনের খবর পেয়ে তিনটি ইউনিট গিয়ে সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনে।
ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা রাশেদ বিন খালেদ জানান, আগুনটা ফানুস থেকে না অন্য কোনভাবে লেগেছে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আগুন নেভানোর প্রতিবেদন পেলে তা বলা যাবে।
খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে গত কয়েকবছর ধরেই বাজি-পটকা এবং ফানুসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে ডিএমপি। তবে প্রতিবছরের মত এবারও নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে ঢাকাবাসী বাজি আর পটকার সঙ্গে ফানুস উড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছেন নতুন বছরকে।
আকাশে ভেসেছে অসংখ্য ফানুসে। আতশবাজির আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে ঢাকার শীতের আকাশ।
রাতে কড়াকড়ি আসবে জেনেই পুরনো বছরকে বিদায় জানানোর আমেজ রোববার দিনভরই ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘেরাটোপে বন্দি হতে হবে জেনেও মধ্যরাতে বেরিয়ে ছিলেন অনেকেই। রাত আটটার পর ঢোকা বন্ধ হয়ে যায় অনেক এলাকায়। পুলিশের বেষ্টনিতে বাধা পেয়ে তাদের ফিরতে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গুলশান, বনানী, হাতিরঝিলের রাস্তায় ছিল যথারীতি ব্যারিকেড। বের হওয়া গেলেও এসব এলাকায় ঢোকা বন্ধ ভোর পর্যন্ত। উন্মুক্ত স্থানে কনসার্ট বা ডিজে পার্টিও ছিল বন্ধ। তবুও ছাদবন্দি উদযাপনে যার যার মত উপায় খুঁজে নিয়েছেন নগরবাসী।
নীরব ছিল টিএসসি
এদিকে কড়া নিরাপত্তা ও নানা বিধিনিষেধের কারণে এবার খ্রিষ্টীয় নববর্ষ বরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ছিল না শিক্ষার্থীদের তেমন উল্লাস-উদ্দীপনা।
পুরাতন বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ করে নিতে প্রতি বছর থার্টি ফার্স্ট নাইটে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হলেও এবার তা ছিল খুবই কম।
রোববার রাত ১২টার দিকে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। পাশাপাশি কিছু শিক্ষার্থীকে ঘুরাফেরা করতে এবং সেলফি তুলতে দেখা গেছে।
ঢাকায় সব ধরনের আতশবাজি, মশাল মিছিল, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ থাকায় এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত ছিলেন শিক্ষার্থীরা।
টিএসসিতে এবার বর্ষবরণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম ছিল। এ কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শীতকালীন ছুটি ও জাতীয় নির্বাচন থাকায় শিক্ষার্থীদের বড় অংশই ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করছে।
এদিকে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনকে ঘিরে সন্ধ্যা থেকেই ক্যাম্পাসে রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, প্রক্টরিয়াল টিমসহ পুলিশ প্রশাসন সতর্ক অবস্থান নেয়।
প্রবেশপথগুলোতে ব্যারিকেড বসিয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং বহিরাগতদের তল্লাশি চালানো হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্টিকারযুক্ত গাড়ি ও অ্যাম্বুলেস প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড দেখে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়।
অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এ নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. মাকসুদুর রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য আমাদের প্রক্টরিয়াল বডিসহ পুলিশ প্রশাসন ক্যাম্পাসে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ক্যাম্পাসের প্রবেশদ্বারগুলোতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে, বহিরাগত কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
"আমরা শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেছি, তারা যাতে ফানুস উড়ানো, ফটকা বা আতশবাজি ফোটানো থেকে বিরত থাকে এবং গ্রুপ করে কোনো প্রোগ্রাম যাতে না করে।"
এদিকে বর্ষবরণে এত কড়াকড়ি বিধি-নিষেধ আরোপ করায় শিক্ষার্থীদের অনেকেই মনোক্ষুণ্ণ হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান বলেন, টিএসসিতে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপন ও নতুন বছরকে বরণ একটি ঐতিহ্যবাহী আয়োজন।
"এই দিনটিকে বন্ধুদের সঙ্গে উদযাপন করতে বন্ধের মধ্যেও ক্যাম্পাসেই রয়ে গেছি। কিন্তু এত কড়াকড়ি বিধি নিষেধের মধ্যে তেমন আনন্দ করা গেল না।"
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনিম জাহান অর্পিতা বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ জমকালো আয়োজনে এদিনটিকে উদযাপন করছে। আমরা কেন পারছি না? আমাদের দেশ কবে নিরাপদ হবে?
তবে বিধি নিষেধের বিষয়টিকে সমর্থন জানিয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আনিসুর রহমান বলেন, যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তার জন্য এবারের নববর্ষ উদযাপন অনেকটাই সাদামাটা। তবে আমরা বিষয়টিকে পজিটিভ হিসেবেই নিয়েছি।
"কেননা আপনারা দেখেছেন সম্প্রতি ক্যাম্পাসে বেশ কয়েকবার ককটেল বিস্ফোরণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা জোরদার করাটা সঠিক উদ্যোগ।"
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শৈবাল রায় বলেন,আতশবাজি ফোটালে বা ফানুস উড়ালে অনেক জায়গায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। সেদিক থেকে এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকাই ভালো।
"নতুন বছরে আশা করছি, ক্যাম্পাসে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তা যেন আর না ঘটে। নতুন বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকবে এটাই কামনা করি।"