প্রকল্প পরিচালক বলছেন, নভেম্বরে কাজ শুরু হলে আগামী জুনের মধ্যে শেষ করতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদী।
Published : 04 Nov 2024, 11:57 PM
আর্থিক সংকট আর অংশীদারি মামলার জটিলতায় প্রায় আট মাস ধরে বন্ধ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের শেষ ধাপের কাজ আবার শুরু হওয়ার আশা জেগেছে।
প্রকল্প পরিচালক বলছেন, সমস্যা মিটে যাওয়ায় নভেম্বর মাসেই ফের কাজ শুরু হতে পারে।
আর সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের জুন মাসে নির্ধারিত সময়েই ঢাকার প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পুরো নির্মাণকাজ শেষ করার আশা করছে সেতু বিভাগ।
ঢাকার কাওলা থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত মূল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। প্রথম অংশে বনানী রেল স্টেশন পর্যন্ত ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং দ্বিতীয় অংশে বনানী রেল স্টেশন থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার এবং তৃতীয় অংশে মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার।
এর মধ্যে কাওলা থেকে কারওয়ানবাজার পর্যন্ত অংশ নির্মাণকাজ শেষে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। কারওয়ানবাজার থেকে মালিবাগ পর্যন্ত পায়ার নির্মাণ হয়েছে, বাকি অংশের কাজ শুরু হয়নি।
বৃহস্পতিবার ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ এলাকার কারওয়ানবাজার থেকে খিলগাঁও পর্যন্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে নির্মাণকাজ বন্ধ। পান্থকুঞ্জ ও কমলাপুর এলাকায়ও কাজ চলছে না।
মগবাজার হয়ে মালিবাগ রেলগেইট পর্যন্ত ৫৫৪ নম্বর পায়ার পর্যন্ত পায়ারের কাজ হয়েছে। তবে সেগুলোতে গার্ডার বসানো হয়নি।
মালিবাগ রেলগেইট থেকে খিলগাঁও পর্যন্ত সড়কের মাঝখানে টিনের বেড়া ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। তার ভেতরে এক্সপ্রেসওয়ের পায়ার নির্মাণের জন্য পাইলিং করা হচ্ছিল। তবে গত জুলাইয়ের পর থেকে সেখানে কাজ বন্ধ। দুপাশের বেড়া খুলে দেওয়া হয়েছে, নির্মাণ এলাকার ভেতর দিয়ে এখন যানবাহন চলাচল করে।
মগবাজার এলাকায় এক্সপ্রেসওয়ের একটি কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড আছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে ভেতরে যন্ত্রপাতি রাখা, দুই পাশের ফটকে তালা মারা।
জানতে চাইলে এক কর্মী বলেন, “কাজ বন্ধ। আমি এখানে আসছি পাঁচ মাস হইছে। আইসাও কাজ বন্ধই দেখছি। আবার কবে শুরু হবে তা স্যারেরা বলতে পারবে।”
ওই কর্মী তার নাম প্রকাশ করতে চাননি। তিনি বলেন, সে সময় ওইখানে কর্মকর্তাদেরও কেউ ছিলেন না।
মগবাজার রেলক্রসিংয়ের কাছে আছে আরেকটি কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড। সেখানে নির্মাণকাজে নিয়োজিত চীনা প্রকৌশলীরাও থাকেন।
সেখানকার একজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, চীনা প্রকৌশলীদের অনেকেই এখানে নেই গত কয়েক মাস ধরে। নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় তারা চলে গেছেন। তবে ওই কর্মী শুনেছেন, তারা আবার আসবেন।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বাকি অংশের কাজ কবে শুরু হবে জানতে চাইলে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিঙ্গাপুরে ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে প্রকল্পের উদ্যোক্তা ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের (ইতালথাই) যে সালিস নোটিস ছিল, তা ২০ অক্টোবর খারিজ হয়ে গেছে। তাতে ইতালথাইয়ের শেয়ার চলে যাবে চীনের দুই কোম্পানি শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ এবং সিনো হাইড্রো করপোরেশনের হাতে।
“ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান চায়না এক্সিম ব্যাংক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি) অর্থায়ন বন্ধ রেখেছিল। শেয়ার ট্রান্সফার হওয়ার পর সেটা আবার চালু হয়ে গেছে। এখন অর্থ ছাড় শুরু হলেই নির্মাণকাজ ফের শুরু হবে। আমরা আশা করছি সব ঠিক থাকলে আগামী নভেম্বরের মধ্যেই নির্মাণকাজ ফের শুরু হয়ে যাবে।”
এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার বলেন, নভেম্বরে কাজ শুরু হলে আগামী জুনের মধ্যে শেষ করতে পারবেন বলে তিনি আশা করছেন।
“এখনও অনেক সময় আছে, ৮ মাস। এখনও কাজ বাকি আছে ২৫ শতাংশ। প্রতি মাসে যদি ২ পার্সেন্টের বেশি কাজ করে তাহলে ওই সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। আমরা তাদের বলেছি এই টাইমের মধ্যে শেষ করতে। তারা এর আগেও তিন শিফটে কাজ করেছে। তাদের বলেছি যে সময়টুকু নষ্ট হয়েছে সেটা যেন পুষিয়ে দেয়।”
যে কারণে জটিলতা
পিপিপির আওতায় এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হবে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এক্সপ্রেসওয়ের মূল কাঠামো নির্মাণের মোট ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জোগান দেওয়ার কথা বিনিয়োগকারী কোম্পানির। বাকি ২৭ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের দেওয়ার কথা।
২০১৩ সালে ইতালিয়ান ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করার জন্য বাংলাদেশ সরকার কার্যাদেশ দেয়। কিন্তু তারা কাজ শুরু করতে ব্যর্থ হলে চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনো হাইড্রো করপোরেশনকে অংশীদার হিসেবে নেয়। এই জয়েন্ট ভেঞ্চারের নাম দেওয়া হয় ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেড।
ইতাল-থাইয়ের হাতে কোম্পানির ৫১ শতাংশ, চায়না শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপের হাতে ৩৪ শতাংশ এবং সিনো হাইড্রো করপোরেশনের হাতে ১৫ শতাংশ মালিকানা থাকে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিনিয়োগকারী কোম্পানি ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ৪৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার সঙ্গে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ চুক্তি করে। এরমধ্যে ৪২৭ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ ছাড় করেছে ব্যাংক দুটি।
ঋণের শর্ত অনুযায়ী, অংশীদারদের কেউ জানুয়ারি বা জুনে ঋণের সুদ দিতে ব্যর্থ হলে সুদের ওই অংশটা বাকি দুই গ্যারান্টারকে দিতে হবে এবং সুদ দিতে ব্যর্থ কোম্পানির শেয়ার বাকিদের কাছে চলে যাবে। বাংলাদেশ সরকারও ওই শর্তে অনুমোদন দেয়।
২০২৩ সালে ইতালিয়ান-থাই কোম্পানি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। সে কারণে ঋণদাতা চীনা ব্যাংক ২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি ইতালিয়ান কোম্পানিকে চিঠি দিলে তারা আরবিট্রেশানে যায়। মামলার কারণে ঋণদাতা ব্যাংক অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেয়।
সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে সালিস নোটিস পাঠানোর পাশাপাশি শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে বাংলাদেশের হাই কোর্টে আবেদন করে ইতালথাই। হাই কোর্ট মামলাটি ‘চলার যোগ্য না’ বলে রায় দিলে ইতালথাই আপিল বিভাগে যায়।
আপিল বিভাগ তখন শেয়ার হস্তান্তরের ওপর আবার স্থগিতাদেশ দেয়। সবশেষ ১ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ স্থগিতাদেশ খারিজ করে রায় দেয়।
এদিকে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে ইতালথাইয়ের সালিসি মামলাও গত ২০ অক্টোবর খারিজ হয়ে যায়। ফলে শেয়ার স্থানান্তর করার বাধা কাটে।
এখন ইতালথাই তাদের শেয়ার ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করবে। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা অনুযায়ী, চীনের দুটি কোম্পানি যদি ওই শেয়ার কিনতে চায়, তাহলে ব্যাংক তা তৃতীয় কোনো কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে পারবে না। চায়না শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ওই শেয়ার কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। ফলে তারা ব্যাংকের কাছ থেকে শেয়ার নেবে।
২০০৯ সালে প্রকল্পটি নেওয়া এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত এবং পরে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর কাওলা থেকে ফার্মগেট এবং এ বছরের ২০ মার্চ কারওয়ান বাজার (এফডিসি) এক্সপ্রেসওয়ের অংশ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।