এক হাজার কোটি টাকার এ বন্ডের অর্থ ‘নগদে এবং সন্দেহজনক বিভিন্ন লেনদেনের’ মাধ্যমে উত্তোলন করে ‘আত্মসাৎ’ করা হয়, অভিযোগ দুদকের।
Published : 20 Apr 2025, 10:36 PM
‘প্রতারণার’ মাধ্যমে আইএফআইসি আমার বন্ড এর ১০০০ কোটি টাকা তুলে তা ‘আত্মসাতের’ অভিযোগে আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, তার ছেলে শায়ান ফজলুর রহমান এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জনসাধারণের কাছ থেকে বন্ড ছেড়ে তোলা এই অর্থ ‘সন্দেহজনক বিভিন্ন লেনদেনের মাধ্যমে উত্তোলন করে আত্মসাৎ’ করার অভিযোগের এ মামলায় তাদের সঙ্গে আসামি করা হয়েছে মোট ৩০ জনকে; যাদের বেশির ভাগ আইএফআইস ব্যাংকের কর্মকর্তা।
রোববার দুদকের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন বাদী হয়ে এ মামলা করেছেন।
এ তথ্য দিয়ে কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম বলেন, সংস্থার সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি দায়ের করা হয়।
এজাহারে অভিযোগ করা হয়, আইএফআইসি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় বন্ধক রাখা সম্পত্তি ‘অস্বাভাবিকভাবে অতিমূল্যায়ন’ দেখিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে বন্ড বিক্রির মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। এই অর্থ শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের (এসটিএল) চলতি হিসাবে জমা হওয়ার পর সেখান থেকে ২০০ কোটি টাকা ‘রিডেম্পশন অ্যাকাউন্টে’ এফডিআর (মেয়াদী আমানত) করা হয়। বাকি ৮০০ কোটি টাকা, যা সরকারি অর্থ হিসেবে বিবেচিত, তা বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডসহ বেক্সিমকো গ্রুপ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন হিসেবে স্থানান্তর করা হয়।
এরপর ‘ব্যাংকিং নিয়মনীতি উপেক্ষা’ করে সেই অর্থ ’নগদে এবং সন্দেহজনক বিভিন্ন লেনদেনের’ মাধ্যমে উত্তোলন করে ‘আত্মসাৎ’ করা হয় বলে মামলায় ৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে দুদক।
এতে বলা হয়, ’আত্মসাৎ’ করা অর্থ একাধিক ধাপে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে ’লেয়ারিং’ (অর্থ গোপনের কৌশল) করে দোষীরা ’শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ করেছেন।
আলোচিত এ বন্ড বাজারে আনার সময় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান রহমান এবং তার ছেলে শায়ান যথাক্রমে আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
অপরদিকে ‘আইএফআইসি আমার বন্ড’ অনুমোদনের সময় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ছিলেন শিবলী রুবাইয়াত।
মামলায় আরও আসামি করা হয়েছে শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মশিউজ্জামান ও পরিচালক তিলাত শাহরিন, আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহ আলম সারোয়ার ও সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক সুধাংশু শেখর বিশ্বাস, এআরএম নাজমুস সাকিব, কামরুন নাহার আহমেদ, রাবেয়া জামালী, গোলাম মোস্তফা ও মো. জাফর ইকবাল, বিএসইসির সাবেক কমিশনার রুমানা ইসলাম, মিজানুর রহমান, শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ও মো. আবদুল হালিমকে।
অন্য আসামিরা হলেন- আইএফআইসি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চিফ ক্রেডিট অফিসার সৈয়দ মনসুর মোস্তফা, হেড অব লোন পারফরমেন্স ম্যানেজমেন্ট শাহ মো. মঈনউদ্দিন, চিফ বিজনেস অফিসার (রিটেইল) মো. রফিকুল ইসলাম, চিফ বিজনেস অফিসার (করপোরেট) গীতাঙ্ক দেবদীপ দত্ত, চিফ অব আইটি মো. নুরুল হাসনাত, চিফ ইনফরমেশন অফিসার মনিতুর রহমান ও হেড অব ট্রেজারি মোহাম্মদ শাহিন উদ্দিন।
এছাড়া ব্যাংকটির ধানমন্ডি শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক ও এফভিপি নাজিমুল হক, সাবেক ব্যবস্থাপক হোসাইন শাহ আলী এবং রিলেশনশিপস ম্যানেজার সরদার মো. মমিনুল ইসলাম, সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিমাই কুমার সাহা, কোম্পানি সেক্রেটারি মো. মিজানুর রহমান, আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক ব্রাঞ্চ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কমপ্লায়েন্স অফিসার আয়েশা সিদ্দিকা ও সিলভিয়া চৌধুরীও মামলার আসামি হয়েছেন।
এজাহারে যেসব অভিযোগ
এ বন্ডের অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে অভিযোগ করে মামলায় দুদক বলেছে, বন্ড ছেড়ে পাওয়া অর্থ ‘রিডেম্পশন অ্যাকাউন্টে’ সংরক্ষণ করে পরে পর্ষদের অনুমোদনক্রমে বিনিয়োগকারীদের মাঝে পরিশোধ করার কথা থাকলেও তা না করে বরং পর্ষদের কোনো অনুমোদন ছাড়াই অর্থ উত্তোলন করা হয়। এতে গ্রাহকের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ে এবং সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহারে চরম গাফিলতির প্রমাণ মেলে।
এজাহারে বলা হয়, অভিযোগ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ‘শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি ২০২৩ সালের ২ মার্চ রিয়েল এস্টেট ও ভূমি উন্নয়ন ব্যবসায় যুক্ত একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে (আরজেএসসি) নিবন্ধিত হয় (নিবন্ধন নম্বর: সি-১৮৭৩৬৪/২০২৩)। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে মো. মশিউজ্জামান এবং পরিচালক হিসেবে তিলাত শাহরিন ‘সিগনেটরি’ হিসেবে মনোনীত হন। দুজনই সমানভাবে ৫০ লাখ করে মোট ১ কোটি টাকার শেয়ারের মালিক। কিন্তু তদন্তে জানা যায়, মশিউজ্জামান প্রকৃতপক্ষে ‘পলি কভারস লিমিটেড’ নামক একটি টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত এবং তিলাত শাহরিন একজন শিক্ষার্থী, যিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত। অর্থাৎ, এই দুইজনের কারোরই আবাসন বা ভূমি উন্নয়ন সংক্রান্ত কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। তবুও তাদেরকে সামনে রেখে একটি ‘ছায়া কোম্পানি’ তৈরি করা হয়।
এজাহারে অভিযোগ, এই কোম্পানিকে ব্যবহার করে আইএফআইসি ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা, ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান সন্ধানী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রতারণা করা হয়।
এতে মর্টগেজ করা সম্পত্তির অস্বাভাবিক অতি মূল্যায়নের ভিত্তিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বন্ড বিক্রির মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়, যা প্রথমে শ্রীপুর টাউনশিপের হিসাবে জমা হয়। সেখান থেকে ’২০০ কোটি টাকা রিডেম্পশন একাউন্টে এফডিআর করা হলেও বাকি ৮০০ কোটি টাকা বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডসহ’ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হয় বলে মামলার বর্ণনায় তুলে ধরা হয়।
পরে ব্যাংকিং নিয়ম নীতি না মেনে এই অর্থ নগদে এবং সন্দেহজনক বিভিন্ন লেনদেনের মাধ্যমে তুলে আত্মসাৎ, স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে ‘লেয়ারিং করে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ’ করা হয়েছে বলে অভিযোগে বলেছে দুদক।
অনুসন্ধানের তথ্যের ভিত্তিতে মামলায় বলা হয়, শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মশিউজ্জামান ও পরিচালক তিলাত শাহরিনের ব্যাংক হিসাবগুলোতে অস্বাভাবিক পরিমাণে লেনদেন দেখানোর উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের ৭ মার্চ আইএফআইসি ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় তাদের নামে দুটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলা হয়। এই দুই হিসাবে মাত্র ছয় কর্মদিবসের (২৯ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল ২০২৩) মধ্যে প্রত্যেকটিতে ১৬৭ কোটি ৫০ লাখ ২ হাজার টাকা করে মোট ৩৩৫ কোটি টাকার মতো লেনদেন দেখানো হয়, যা ছিল সম্পূর্ণ কৃত্রিম এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে দেখানো। অথচ তাদের ব্যক্তিগত ব্যাংক লেনদেনের প্রোফাইলে মাসিক লেনদেনের সীমা এক লাখ টাকারও কম।
এ কৃত্রিম লেনদেন সম্ভব হয় মূলত ব্যাংকের পরিচালক এ. আর. এম. নাজমুস সাকিবের মালিকানাধীন ‘ট্রেড নেক্সট’ নামের কোম্পানির বড় অঙ্কের অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে। এসব লেনদেন সন্দেহজনক হওয়ার পরও ধানমন্ডি শাখার তৎকালীন ব্রাঞ্চ অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কমপ্লায়েন্স অফিসার (বিএএমএলসিও) সিলভিয়া চৌধুরী এবং শাখা ব্যবস্থাপক মো. নাজিমুল হক এ বিষয়ে কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপের প্রতিবেদন (এসএআর) বা সন্দেহজনক লেনদেনের প্রতিবেদন (এসটিআর) দাখিল করেননি। বরং তারা মশিউজ্জামান ও তিলাত শাহরিনকে অপরাধ সংঘটনের সুযোগ দিয়ে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধে যুক্ত হন।
এজাহারে বলা হয়, অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের নামে আইএফআইসি ব্যাংকে একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। হিসাব খোলার ফরমে মশিউজ্জামানকে চেয়ারম্যান এবং তিলাত শাহরিনকে পরিচালক হিসেবে দেখানো হলেও কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন ফরম ১১২ অনুসারে মশিউজ্জামান ছিলেন ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল এই প্রতিষ্ঠান থেকে আইএফআইসি ব্যাংকে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের জন্য গ্যারান্টির আবেদন করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখা ৩ মে প্রধান কার্যালয়ে একটি ক্রেডিট প্রস্তাবনা পাঠায়। সেখানে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি একটি নতুন গ্রাহক এবং তাদের সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান বা পরিচালকদের আর্থিক ইতিহাস যাচাই করা হয়নি এবং তাদের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে এমন কোনো প্রমাণও ছিল না।
অনুসন্ধানের তথ্য তুলে ধরে এজাহারে অভিযোগ করা হয়, আইএফআইসি ব্যাংকের কাছে শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের জামানত হিসেবে বন্ধক রাখা মোট ৩ হাজার ৭১৬ দশমিক ৫ শতাংশ জমির প্রকৃত মূল্য ছিল প্রায় ৮৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা (সরকারি মৌজা রেট অনুযায়ী)। কিন্তু এই জমির মূল্য অতিমূল্যায়ন করে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা দেখানো হয় এবং এই অতিমূল্যায়িত সম্পত্তিকে ভিত্তি করেই শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের পক্ষে এক হাজার কোটি টাকার বন্ডের জন্য আইএফআইসি ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করে। ব্যাংকের শাখা, প্রধান কার্যালয় বা পরিচালনা পর্ষদ—কোনো পর্যায়েই এই অতিমূল্যায়ন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি বা যাচাই করা হয়নি।
এছাড়া বন্ধক রাখা ৩৭১৬.৫ শতাংশ জমির মধ্যে ১২১৬ শতাংশ জমি শ্রীপুর টাউনশিপে সরাসরি বন্ধক দিলেও অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটির ওই জমি কেনার আর্থিক সামর্থ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশিষ্ট জমিগুলো থার্ড পার্টি বন্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যেগুলো ছিল বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির মালিকানাধীন। এর মাধ্যমে এটি স্পষ্ট যে, শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেড প্রকৃতপক্ষে বেক্সিমকো গ্রুপেরই নিয়ন্ত্রিত একটি প্রতিষ্ঠান এবং তাদেরই ‘আলটিমেট বেনিফিশিয়ারি ওনার’ (ইউবিও) বলে এজাহারে বলা হয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং তার ছেলে শায়ান ফজলুর রহমান বিভিন্ন বেক্সিমকো কোম্পানির এমডি, চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মামলায় বলা হয়েছে, ব্যাংকিং আইনের অধীনে কোনো ব্যাংকের পরিচালক নিজ ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ সুবিধা নিতে পারেন না। কিন্তু এই বিধান লঙ্ঘন করে তারা তাদের অধীনস্ত ব্যক্তিদের ব্যবহার করে ‘শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন এবং এর মাধ্যমে আইএফআইসি ব্যাংকের গ্যারান্টি নিয়ে বন্ড ছাড়ে। এর মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে তোলা হয়। এই অর্থের প্রকৃত সুবিধাভোগী ছিল বেক্সিমকো গ্রুপ।
অনুসন্ধানের বরাতে মামলায় বলা হয়েছে, গ্রাহকের জমির মূল্য ও আর্থিক সক্ষমতা যাচাই না করেই ব্যাংকের পক্ষ থেকে ‘ক্রেডিট প্রোপোজাল’ তৈরি করা হয়। মাত্র এক মাস আগে গঠিত একটি কোম্পানির পক্ষে এত বড় অঙ্কের বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য বা সতর্কতা উত্থাপন করা হয়নি। বরং গ্রাহকের আবেদনে না থাকলেও আইএফআইসি ব্যাংক স্বপ্রণোদিত হয়ে 'আইএফআইসি গ্যারান্টিযুক্ত শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ড' নাম ব্যবহারে অনাপত্তিপত্র দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার চিফ ম্যানেজার হোসেন শাহ আলী ও রিলেশনশিপ ম্যানেজার সরদার মো. মমিনুল ইসলাম গ্রাহকের প্রস্তাবের পক্ষে ইতিবাচক সুপারিশ করে প্রধান কার্যালয়ের চিফ ক্রেডিট অফিসারের কাছে ক্রেডিট প্রোপোজাল পাঠান। তাদের এই ভূমিকা শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডকে এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দেয়। ফলে তারা সরাসরি সহযোগিতা করে শাস্তিযোগ্য অপরাধে যুক্ত হন বলে এজাহারে অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ মে মাসুদা বেগম, আইএফআইসি ব্যাংকের সিআরএম ইউনিট-১ এর ম্যানেজার, শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেড (এসটিএল)-এর প্রস্তাবটি নোটশিট আকারে ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটির কাছে পাঠান। ওই দিনই ১৯২০তম ক্রেডিট কমিটির সভায় কোনো নেতিবাচক মন্তব্য ছাড়াই প্রস্তাবটি সুপারিশ করা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন সৈয়দ মনসুর মোস্তফা, শাহ মো. মঈনউদ্দিন, মো. রফিকুল ইসলাম, গীতাঙ্ক দত্ত, মো. নুরুল হাসনাত, মতিউর রহমান ও মোহাম্মদ শাহিন উদ্দিন। তারা সবাই প্রস্তাব অনুমোদনের মাধ্যমে আত্মসাতের পথ সুগম করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সেদিন রাতেই (৭ মে) ৮৫৬তম বোর্ড সভায় এসটিএলের কোনো সিআইবি রিপোর্ট ছাড়াই এবং মর্টগেজ মূল্য যাচাই না করে এক হাজার কোটি টাকার গ্যারান্টি অনুমোদন দেওয়া হয়। দুদিন পর ৯ মে "আইএফআইসি গ্যারান্টিযুক্ত শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ড" নামে বন্ড ইস্যুর জন্য অনাপত্তিপত্র প্রদান করা হয়, যা পরবর্তীতে প্রচার হয় "আইএফআইসি আমার বন্ড" নামে।
এজাহারে ঘটনাক্রম তুলে ধরে, ২০২৩ সালের ৪ জুন বিএসইসি কমিশনের সভায় পাঁচটি নেতিবাচক মন্তব্য থাকার পরও বন্ড ইস্যুর অনুমোদন দেওয়া হয়।
মামলায় কমিশনের সভাপতি শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম এবং অন্যান্য কমিশনারদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও যোগসাজশের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এরপর ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে ট্রাস্টি নিযুক্ত করা হলেও তারা বন্ডের অর্থ অপব্যবহারের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং কোম্পানির সিইও ও সেক্রেটারির বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। বিনিয়োগকারীরা এক মাসের মধ্যে বন্ডে এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন, যা এসটিএল-এর হিসাব নম্বরে জমা হয়।
এর মধ্যে ২০০ কোটি টাকার এফডিআর করা হলেও বাকি ৮০০ কোটি টাকা বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে স্থানান্তর ও পরে উত্তোলন করা হয় বলে এজাহারে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আইএফআইসি আমার বন্ড 'প্রতারণা': আসামি হচ্ছেন সালমান, শায়ান, শিবলী