ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবর্তে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুদান বেশি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
Published : 14 May 2024, 05:48 PM
বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিলের অন্যতম উৎস গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) বাংলাদেশের ওপর ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে এবং বৈষম্যমূলক আচরণ করছে বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
মঙ্গলবার ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের (জিসিএফ) ভূমিকা হতাশাব্যঞ্জক ও বৈষম্যমূলক। আমলাতান্ত্রিক ও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া স্বত্ত্বেও কোন সুফল পাচ্ছে না।
“‘কান্ট্রি ওনারশিপ’ নিশ্চিতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠানে অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া জিসিএফের মূলনীতি হলেও তা অগ্রাহ্য করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।“
এই বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য আন্তর্জাতিক অংশীজনদরে সঙ্গে দেন-দরবারের প্রয়োজন রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে অভিযোগ থাকলে তা নিরসন, প্রশ্ন থাকলে জবাব দেয়ার প্রক্রিয়া, সেটাও করতে ব্যর্থ হয়েছে জিসিএফ।
আমলাতান্ত্রিক ও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবর্তে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুদান বেশি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
“জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, সুফল যাদের পাওয়ার কথা, তারা পাচ্ছে না। আমাদের জাতীয় সংস্থাগুলোর জন্য ঋণ বেশি দিচ্ছে। ফলে ঋণের বোঝা বাড়ছে। আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে অনুদান বেশি দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর যেটি পাওয়ার যোগ্যতা নেই বলে আমি মনে করি।”
জিসিএফ অভিযোজনে কম অর্থায়ন করছে, অন্যদিকে প্রশমনে বেশি নজর দিচ্ছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, “ফলে ঝুঁকি পূর্ণ দেশের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কার্যক্রম অগ্রাধিকার পাচ্ছে না।
“অন্যদিকে, জিসিএফে তহবিল স্বল্পতা রয়েছে। উন্নত দেশের প্রতিশ্রুত জলবায়ু অর্থ সংগ্রহ করে তা ঝুঁকিপূর্ণ দেশে সরবরাহে অনুঘটকের ভূমিকা পালনসহ কার্যকর কৌশল ও পদক্ষেপ গ্রহণে জিসিএফের ঘাটতি বিদ্যমান। এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত দায়িত্ব পালন ও সমন্বয় সাধনেও জিসিএফের ঘাটতি রয়েছে। অনুদানভিত্তিক কার্যক্রম থেকে জিসিএফ মুনাফাভিত্তিক কার্যক্রম বেশি করছে। কারণ নিজেদের ব্যর্থতার কারণে তারা তহবিল সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে।”
সংবাদ সম্মেলনে ‘সবুজ জলবায়ু তহবিলে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশের অভিগম্যতা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক নেওয়াজুল মাওলা ও সহিদুল ইসলাম।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অনুদানভিত্তিক তহবিল বিতরণে জোর দেওয়া হলেও জিসিএফ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশে ঋণ দেওয়া হচ্ছে বেশি।
দর কষাকষিতে সক্ষমতা কম থাকায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেশি অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ প্রস্তাবে সম্মত হয়।
এতে আরও বলা হয়, ফলে অনুদানের চেয়ে ঋণ প্রাপ্তির হার বেশি। জিসিএফ অর্থায়নের ক্ষেত্রে জাতীয় এবং আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের হার যথাক্রমে ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ৬৯ দশমিক ৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের হার ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ, যা জাতীয় এবং আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কম। এক্ষেত্রে অনুদানের পরিমাণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য ৪৪ দশমিক ১ শতাংশ, আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জিসিএফ অনুমোদিত সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য দেওয়া হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার (১২ দশমিক ২ শতাংশ)। আর আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুমোদন করা হয়েছে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার (৮ শতাংশ)।
১০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুমোদন করা হয়েছে (৭৯ দশমিক শতাংশ)।
টিআইবি জানিয়েছে, মাত্র পাঁচটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের (ইউএনডিপি, বিশ্ব ব্যাংক, ইবিআরডি, এডিবি এবং আইডিবি) জন্য জিসিএফের মোট অনুমোদিত অর্থের ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে, বাকি ২২টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ৪০ দশমিক ৪ শতাংশ।
গবেষক নেওয়াজুল মাওলা বলেন, বাংলাদেশে জিসিএফ তহবিলের ৯টি প্রকল্পে মোট অনুমোদিত অর্থের মাত্র ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ ছাড় করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোতে জিসিএফ থেকে অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হয়। একটি প্রকল্প অনুমোদনের দীর্ঘ তিন বছর পর প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড় করা হয়েছে। অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নেও বিলম্ব হয়েছে। ফলে প্রকল্পভুক্ত এলাকায় জলবায়ু ঝুঁকি বেড়েছে।
অঞ্চলভিত্তিক বিশ্লেষণ থেকে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জিসিএফ স্বীকৃত ‘তহবিল পাওয়ার যোগ্য’ ১৫৪টি দেশের মধ্যে ২৫টি (১৬ দশমিক ২ শতাংশ) দেশ প্রকল্প পায়নি। জিসিএফ ‘তহবিল পাওয়ার যোগ্য’ দেশগুলোর মধ্যে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সর্বোচ্চ (১৪টি দেশ) সংখ্যক দেশ প্রকল্প পায়নি এবং আফ্রিকা অঞ্চলের ৬টি দেশ প্রকল্প পায়নি।
ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ও পূর্ব ইউরোপের যথাক্রমে ১টি করে দেশ প্রকল্প পায়নি।
জিসিএফের নীতি অনুসারে ‘বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশের জন্য অভিযোজন তহবিল বরাদ্দে গুরুত্ব দেওয়া হলেও ৪২টি দেশে অভিযোজন অর্থায়ন হয়নি। যে কয়টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশে অভিযোজনের অর্থায়ন হয়েছে তার অধিকাংশই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি।