বাঘের ছবিকে নাজির ব্যবহার করেন নিজের ‘স্বাক্ষর’ হিসেবে। তিনি যখন কোনো মানুষের ছবি আঁকেন, তাতেও স্থান পায় বাঘ।
Published : 10 Nov 2023, 08:04 AM
রাজধানীর শাহবাগে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে গেলে চোখে পড়বে ফুটপাতঘেঁষা দেয়ালে ঝুলছে নানা পটচিত্র। পাশেই বসে একাগ্রচিত্তে ছবি এঁকে যাচ্ছেন নিভৃতচারী একজন শিল্পী। তিনি নাজির হোসেন।
পটচিত্রে মূলত বাঘ আঁকেন বলে নাজির হোসেন পেয়েছেন ‘বাঘ মামা’ খেতাব। ‘টাইগার নাজির’, ‘বাঘ নাজির’ নামেও ডাকেন অনেকে। আজকাল অবশ্য নাজির নিজেকে ‘পটুয়া’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন।
বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির অন্যতম শিল্পমাধ্যম পটশিল্পকে নগরের মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রায় দুই যুগ ধরে ফুটপাতে বসে এঁকে যাচ্ছেন নাজির হোসেন। ফুটপাতই তার শিল্পকর্মের গ্যালারি।
নাজিরের আঁকা পটগুলো অবশ্য একটু আলাদা; খানিকটা নকশীকাঁথার ছোঁয়া আছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে নাজির বলেন, “মা নকশীকাঁথা সেলাই করতেন। মাটির ঘরের দেয়ালে মায়ের লেপন, হাতপাখার নকশা আমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। আমি মায়ের কাছ থেকে দেখে দেখে মাটিতে কাঠি দিয়ে আঁকতাম। নিজের মত করে পশু-পাখি, গাছপালা, গ্রামীণ দৃশ্য আঁকার চর্চা করতাম।”
নাজির হোসেন নকশীকাঁথার ফোড়ের মত করে পটে রঙের ‘বুনন’ করেন প্রথমে। এরপর সাধারণত কামার-কুমার, জেলে-তাঁতি, বাউল-ফকির, মাঝিমাল্লা, নদী ও নারীকে চিত্রিত পটচিত্রে।
তবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার হল নাজিরের চিত্রকর্মের প্রধান উপজীব্য। তার প্রায় সব চিত্রেই দেখা মিলবে ডোরাকাটা বাঘের। এ পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি বাঘের পটচিত্র এঁকেছেন। তার পটচিত্রে কখনো বাঘ ঢাকঢোল পেটায়, কখনো সে গায়েন, কোনো ছবিতে জমিতে হাল চাষ করে, নৌকা, রিকশা, রেলগাড়ি ও বিমান চালায়।
বাঘের ছবিকে নাজির ব্যবহার করেন নিজের ‘স্বাক্ষর’ হিসেবে। তিনি যখন কোনো মানুষের ছবি আঁকেন, তাতেও স্থান পায় বাঘ।
‘বাঘপ্রীতি’ প্রসঙ্গে নাজিরের ভাষ্য, “সুন্দরবনের সবচেয়ে সুন্দর প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এটি আমাদের বীরত্বের প্রতীক। এই টাইগার নিয়ে আমি দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে ছবি আঁকছি। তাই আমার নামের সঙ্গে টাইগার শব্দটা একাকার হয়ে গেছে, আমি নিজেও নিজেকে টাইগার নাজির বলে পরিচয় দিয়ে থাকি।”
মফস্বলের একটি ছেলের স্বপ্ন
১৯৮২ সালে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার রুস্তম নগর নতুন বাজার গ্রামে জন্ম নেওয়া নাজির শৈশবে মায়ের নকশীকাঁথা সেলাই দেখে অনুপ্রাণিত স্কুলের পড়ার আঁকাআঁকিতে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন।
“বইয়ের লেখার চেয়ে ছাপা ছবিগুলো আমাকে বেশি আকৃষ্ট করত। একটু বড় হওয়ার পর পেপার-পত্রিকায় বিভিন্ন চিত্রপ্রদর্শনীগুলোর খবর দেখতাম, সেগুলো পড়তাম। সেসবের সাথে শিল্পীদের আঁকা দুয়েকটা ছবিও থাকত,” বলেন নাজির হোসেন।
১৯৯৪ সালে একটি স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘রংধনু’ তার একক চিত্র প্রদর্শনী করে। গ্রামীণ মেলাগুলোতেও চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হত তার। তখন থেকেই নাজির স্বপ্ন দেখেন, তিনিও একদিন বড় শিল্পী হবেন।
সেই স্বপ্ন আর মায়ের সঞ্চয়ের কিছু টাকা নিয়ে ১৯৯৬ সালে ঢাকায় আসেন নাজির। সারাদিন ঘুরঘুর করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। নিজের আঁকা ছবি দেখাতেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। তাদের উৎসাহে আগ্রহ আরো বাড়ে।
কিন্তু অর্থের অভাবে তখন ঢাকায় স্থায়ী হতে পারেননি। মাঝেমধ্যে পার্বতীপুরে কিছুদিন কাটিয়ে আবার ফিরে আসতেন ঢাকায়; সঙ্গে নিয়ে আসতেন তার শিল্পকর্মগুলো। কখনও ছবির হাটে, কখনো আবার চারুকলার দেয়ালে করতেন নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনী।
বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ২০০০ সাল থেকে ঢাকায় স্থায়ী হন। তখন থেকে পাবলিক লাইব্রেরির সামনের ফুটপাতে ছবি এঁকে যাচ্ছেন তিনি। ২০১২ সালে ঢাকার আদাবরে স্টুডিও গড়ে তোলেন। সেখানেই তিনি দুই সন্তানসহ স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। তার স্ত্রী শামীমা হোসেন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
শিল্পকর্ম বিক্রি করে সংসার চালানো কষ্ট, তারপরও এঁকে যাচ্ছেন নাজির। আর এই যাত্রায় পেয়েছেন স্ত্রীর অকুণ্ঠ সমর্থন-সহযেগিতা।
“সবাই যদি চাকরি করে, ছবি আঁকবে কে? আমি চেষ্টা করি আমার লোকজ সংস্কৃতি আমার মত করে তুলে ধরতে। তরুণ প্রজন্মের যেন এটা দেখে দেশপ্রেম আরও ভালোভাবে উজ্জীবিত হয়।”
ফুটপাত যখন গ্যালারি
শিল্পকর্ম গণমানুষের কাছে নিয়ে যেতে ফুটপাতকে বেছে নিয়েছেন নাজির।
তিনি বলেন, চারুকলা, শিল্পকলা বা জাদুঘরে আমজনতা কিন্তু সহজে ঢোকে না। ফুটপাত হল গণমানুষের গ্যালারি। এখানে শ্রমজীবী মানুষ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ পাচ্ছে, এটাই আমার অর্জন। তাই আমি ফুটপাতকে বানিয়েছি আমার শিল্পের আখড়া।
“আমি দিনাজপুর থেকে ঢাকা শহরে এসেছি আমাদের যে লোকজ মোটিফ রয়েছে, সেগুলো নগরবাসীর সামনে তুলে ধরতে। ঢাকা শহর শুধু কংক্রিটের বস্তি হলে হবে না, এখানে গ্রামীণ আদলের কিছু থাকা চাই। নগরবাসীর কাছে আমি বাংলার আবহমান সংস্কৃতিকে পটচিত্রের মধ্য তুলে ধরতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
নাজিরের যত প্রদর্শনী
এখন পর্যন্ত ৫৯টি একক প্রদর্শনী হয়েছে নাজিরের চিত্রকর্ম নিয়ে। এর মধ্যে একাধিকবার হয়েছে শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ এবং বেঙ্গল গ্যালারিতে।
এছাড়া পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়, সেখানেও নাজির অংশগ্রহণ করেন। প্রতি বছর বৈশাখ মাসে 'বাঘের দেশে বৈশাখ' শিরোনামে পট প্রদর্শনীর আয়োজন করেন নাজির হোসেন।
২০১৩ সালে জাপানের রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণে ‘সেতুচি আর্ট ট্রিনিয়াল’ প্রদর্শনীতে অংশ নেন নাজির। তখন বাংলাদেশ থেকে নবীন-প্রবীণ প্রায় ১০০ শিল্পী প্রদর্শনীতে অংশ নেন। নাজিরের বাঘের পটচিত্র সবার নজর কাড়ে। তার আঁকা বাঘের মাসকট নির্বাচিত হয় জাপান-বাংলাদেশ ‘গুডউইল অ্যাম্বাসাডর’ হিসেবে।
ফুটপাতে বসে থাকলেও নাজিরের পটচিত্রের ক্রেতা বিদেশিই বেশি।
এ শিল্পীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, পার্বতীপুরে নিজ গ্রামে লোকশিল্প জাদুঘর করা।
শিল্পীদের চোখে নাজির যেমন
দীর্ঘদিন ধরে পটুয়া নাজিরের কাজগুলো কাছ থেকে দেখছেন লেখক ও চিত্রশিল্পী দিলদার হোসেন।
তিনি বলেন, “নাজির আমাদের ভূখণ্ডের শেকড়ের শিল্প তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। আমি দেখি, চারুকলার স্টুডেন্টরা অনেকে এসে তার এখানে অঙ্কন শেখে। আমি বিশ্বাস করি, এই কালে না হলেও মহাকালে নাজির একজন প্রধানসারির পটুয়া শিল্পী হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন। আমার বিশ্বাস, তার মাধ্যমে আমাদের পটচিত্র একদিন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যাবে এবং ছড়াতে শুরু করেছেও।”
সরকারি-বেসরকারিভাবে নাজিরকে পৃষ্ঠপোষকতা করা দরকার বলে মনে করেন দিলদার হোসেন।
তবে পৃষ্ঠপোষকতার ‘বাড়াবাড়ি’ হলে নাজির তার স্বকীয়তা হারাতে পারেন বলে মনে করেন চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন।
“আমি মনে করি, টাইগার নাজির যেভাবে আছে, সেভাবে চলুক। তাকে গুলশান-বনানীতে ঠাঁই দিলে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হবে। যে ধারাটা টাইগার নাজির তৈরি করলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সেটা তিনি বিলং করতে পারবেন না। কেননা, আমাদের দেখা আছে, পৃষ্ঠপোষকতার নামে চারণ কবিরা হয়ে যান সভাকবি।”
পৃষ্ঠপোষকতায় গণমানুষের সঙ্গে শিল্পীদের দূরত্ব তৈরি হয় বলে মনে করেন নিসার হোসেন।