বাংলাদেশে কোকেনের ব্যবহারকারী তেমন নেই। তারপরও কদিন পর পর ধরা পড়ে মাদকটি, যেটির সিংহভাগই উৎপাদন হয় দক্ষিণ আমেরিকায়।
Published : 26 Jan 2024, 07:59 AM
বাংলাদেশে কোকেন ব্যবহারকারী তেমন না থাকলেও সাড়ে আট কেজি কোকেনসহ আফ্রিকার দেশ মালাউইয়ের একজন নারী ধরা পড়ার পর বাংলাদেশ পাচারের রুট কি না, সেই বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা উঠেছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে কোকেনের ব্যবহারকারী নেই। আর মালাউইতে কোকেন উৎপাদন হয় না। তাদের ধারণা, এই কোকেন অন্য কোনো দেশে পাচারের চেষ্টা ছিল।
এর আগে বাংলাদেশে কোকেনের যে চালানগুলো ধরা পড়েছিল তার প্রায় সবই এসেছিল দক্ষিণ আমেরিকা থেকে, গন্তব্য ছিল ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা।
নোমথানডাজো তোয়েরা সোকো নামের মালাউইয়ের ৩৫ বছর বয়সী ওই নারী বুধবার রাতে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে আফ্রিকা থেকে ঢাকায় পৌঁছেন। বিমানবন্দর থেকে তার একটি আবাসিক হোটেলে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ।
অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে কঠিন অবস্থায় আনা কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান এটি। জব্দ করা আট কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেনের দাম আনুমানিক ১০০ কোটি টাকা।
এ নিয়ে আলোচনা মিইয়ে যেতে না যেতেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় 'এফোর্ড ইন' হোটেলে ২০০ গ্রাম কোকেনসহ ধরা পড়েন মোহাম্মেদি আলি নামের তানজানিয়ার এক নাগরিক।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারি বলছেন, এর আগে যে কোকেন বাংলাদেশে ধরা পড়েছিল, তা মূলত ইউরোপের বাজারে পাচারের জন্য এ দেশে আনা হয়েছিল। মালাউই থেকে আসা এই মাদক কোথায় নেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছিল সে বিষয়ে গ্রেপ্তার সোকোকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এই কর্মকর্তা বলছেন, “মালাউইতে পেশায় নার্স সোকো এর আগেও ‘ব্যবসায়িক কারণ’ দেখিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু মালাউই কোকেন উৎপাদন করে না। আমরা ধারণা করছি বাংলাদেশের কেউ বিদেশে কোকেন পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তার (সোকো) পৃষ্ঠপোষককে আমরা খুঁজছি, দেশি-বিদেশি সন্দেহভাজনদের নিয়ে কাজ শুরু করেছি।”
মূল উৎপাদনকারী দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আফ্রিকা হয়ে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে কোকেন ঢুকছে, এ রকম তথ্য দিচ্ছে জাতিসংঘের অপরাধ ও মাদক বিষয় কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) ‘গ্লোবাল কোকেন রিপোর্ট- ২০২৩’।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ব্রাজিল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার মোজাম্বিকে আকাশপথে কোকেন পাচারের সময় ১০টি চালান ধরা পড়ে। এর মধ্যে দুটি ধরা পড়েছিল মোজাম্বিকের মাপুতু বিমানবন্দরে, বাকিগুলো ব্রাজিলে (মূলত সাও পাওলো বিমানবন্দরে)।
এর মধ্যে নয়টি চালানে ২০ কেজির কম কোকেন ছিল। আর ২০১৯ সালে সাও পাওলো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে কার্গো বিমান থেকে উদ্ধার করা হয় ১১০ কেজি।
মোজাম্বিকের পাশের দেশ হচ্ছে মালাউই।
মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মজিবুর রহমান পাটোয়ারি বলছেন, “ঢাকায় ধরা পড়া সোকো মালাউই থেকে বাসে করে ইথিওপিয়া যান। সেখান থেকে তিনি কাতারের দোহায় আসেন। সেখান থেকে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় নামেন।
“সন্দেহ এড়াতে তারা একটি নন ট্র্যাডিশনাল রুট ব্যবহার করেছে, যে রুটটাতে সবাই যায় না।”
গত বছরের ১০ জুন ঢাকা বিমানবন্দরে পৌনে ২ কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার হন মরক্কো থেকে আসা ভারতীয় নারী সালোমি লালরামধারি। তিনি মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কা থেকে কাতার হয়ে ঢাকায় আসেন। ওই কোকেনের গন্তব্য ছিল দিল্লি। ঢাকার গুলশানে একটি হোটেলে ওঠার কথা ছিল সালোমির।
উৎপাদনের কেন্দ্রে দক্ষিণ আমেরিকা
ইউএনওডিসির ‘গ্লোবাল কোকেন রিপোর্ট- ২০২৩’ এ বলা হচ্ছে, মাদকের বাজারে কোভিড মহামারীর কারণে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে মাদক পাচারকারীদের জন্য তাদের অবৈধ পণ্যগুলোকে বাজারে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। ভাইরাস ছড়ানো রোধে কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কারণে নাইট ক্লাব ও বারগুলোও বন্ধ থাকায় কোকেনের মতো মাদকের চাহিদা কমে যায়।
তবে সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতার ওপর কোভিডকালীন মন্দা সামান্যই প্রভাব ফেলেছে। কোকেনের নাটকীয় উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে ২০২০ সালে বিশ্বে রেকর্ড পরিমাণ দুই হাজার টন উৎপাদিত হয়।
২০২০ সালে বিশ্বে মোট কোকেনের ৬১ শতাংশ কলম্বিয়ায়, ২৬ শতাংশ পেরুতে ও বলিভিয়া ও সংলগ্ন এলাকায় ১৩ শতাংশ উৎপাদিত হয়।
ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে কোকেন ব্যবহারকারীদের ২৪ শতাংশ মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের, ৩০ শতাংশ উত্তর আমেরিকার (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, গ্রিনল্যান্ড, বারমুডা এবং সেইন্ট পিয়েরে অ্যান্ড মিকুইলান), ২১ শতাংশ মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপের।
এর বাইরে আফ্রিকায় ৯ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় ৫ শতাংশ, পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ৪ শতাংশ, পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপে ৩ শতাংশ, ওশেনিয়ায় ৩ শতাংশ এবং পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় এক শতাংশ ব্যবহারকারী রয়েছে।
ওই সময়ে পৃথিবীব্যাপী জব্দ হওয়া কোকেনের ৭২ শতাংশই ধরা পড়ে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। এর বাইরে উত্তর আমেরিকায় ১২ শতাংশ এবং পশ্চিম ও মধ্য ইউরাপে ১৫ শতাংশ এবং পৃথিবীর বাকি অংশে এক শতাংশ কোকেন ধরা পড়ে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, পশ্চিম ও উত্তর আফ্রিকা জুড়ে মাদক পাচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে নাইজেরিয়ান কিছু চক্র। বৈশ্বিকভাবেও নাইজেরিয়ান বংশোদ্ভূত লোকেদের মাধ্যমে তারা মাদক পাচার চক্রের বিস্তার ঘটিয়েছে।
এই চক্র যাত্রীবাহী ফ্লাইটগুলোতে যাত্রীদের মালপত্রের মধ্যে মাদক পাচার করে থাকে। ব্রাজিলের ডেটা অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে দেশটির বিমানবন্দরগুলোতে যাত্রীদের ব্যাগে মাদক নিয়ে গ্রেপ্তার বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে নাইজেরিয়ান।
দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ
২০১৩ সালের ১১ জুন কারওয়ানবাজারের হোটেল লা ভিঞ্চি থেকে তিন কেজির মতো কঠিন কোকেনসহ আটক হন পেরুর নাগরিক হুয়ান পাবলো রাফায়েল জাগাজিটা।
তকে আটক করা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দলের নেতৃত্বে তখন ছিলেন মজিবুর রহমান পাটোয়ারি। তিনি তখন সংস্থাটির ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের উপ পরিচালক ছিলেন।
সেই মামলায় হুয়ান পাবলো এখনো কারাগারে। মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি।
মজিবুর রহমানের ভাষ্য, তদন্তে জানা গিয়েছিল হুয়ান কোকেন এনেছিলেন ইউরোপে পাচারের জন্য। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সরাসরি ইউরোপে গেলে সন্দেহের মধ্যে থাকতে হয়। সেই সন্দেহ এড়াতে বাংলাদেশ হয়ে পাচারের পরিকল্পনা ছিল তাদের।
হুয়ান তখন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, তিনি পেরুর রাজধানী লিমার একটি ডিস্কোতে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন। সেখানে এক নারীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে চার দেশ ঘুরে আসেন ঢাকায়।
প্রথমে তিনি মাদকের ব্যাগ নিয়ে বাসে করে প্রতিবেশী দেশ ইকুয়েডরে যান। সেখান থেকে ফ্লাইটে যান পানামায়, সেখান থেকে আরেকটি ফ্লাইটে যান ব্রাজিলে। ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে এমিরেটসের ফ্লাইটে দুবাই হয়ে ঢাকায় আসেন।
তার কাগজপত্রে একটি বায়িং হাউজের নাম আসে, তবে সেটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে ২ কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেনসহ গ্রেপ্তার হন আরেক পেরুর নাগরিক হলেন জেইম বার্গলে গোমেজ। তাকে সহায়তার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন সিভিল এভিয়েশনের দুজন কর্মীও।
বার্গলেও বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে পাচারের জন্য ওই কোকেন এনেছিলেন। গত বছরের ১১ জানুয়ারি ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফাতেমা ফেরদৌস তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় সিভিল এভিয়েশনের দুই কর্মী খালাস পান।
২০১৫ সালের জুন মাসেই চট্টগ্রাম বন্দরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া থেকে আসা সূর্যমুখী তেলের ড্রামে ভরা তরল কোকেন ধরা পড়ে। জাহাজে একটি কনটেইনারে আসা ১০৭টি তেলের ড্রামের মধ্যে একটিতে কোকেন থাকার কথা জানান কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ থেকে কোন দেশ?
কর্মকর্তারা ধারণা করেন, এসব কোকেন ইউরোপ বা আমেরিকার বাজারে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশে আনা হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে কোনো মামলাতেই উপসংহারে আসার মতো তথ্য-প্রমাণ যোগাতে পারেননি তারা। যার কারণে শনাক্ত হয় না তাদের এ দেশীয় পৃষ্ঠপোষকরা।
২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর ৩২ কেজি ৩২৯ গ্রাম হেরোইনসহ শ্রীলঙ্কায় গ্রেপ্তার হন বাংলাদেশি নারী সূর্যমণি। তাকে গ্রেপ্তারের সূত্র ধরে ৩১ ডিসেম্বর ২৭০ কেজি হেরোইন ও পাঁচ কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেনসহ দুই বাংলাদেশি দেওয়ান রাফিউল ইসলাম হিরো ও জামাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে শ্রীলঙ্কার পুলিশ।
ওই ঘটনায় দেশেও তোলপাড় হয়, ঢাকায় তদন্তে নামে সিআইডি। তখন সিআইডির তদন্তে এসবের পেছনে বায়িং হাউজ ব্যবসায়ী চয়েজ রহমানের নাম আসে।
চয়েজ রহমানের বায়িং হাউজের ১৫ হাজার টাকা বেতনের কর্মী ছিলেন শ্রীলঙ্কায় গ্রেপ্তার হওয়া সূর্যমণি। ওই মামলায় দেশে চয়েজকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১১ মাস তদন্তের পর ২০১৯ সালের নভেম্বরে সূর্যমণি, চয়েজসহ ১৪ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি।