দেড়শ কোটি টাকা মূল্যের গুলশানের ওই সম্পত্তির মালিকানা ও দখল বুঝে পেতে এ মামলা করেছেন ওয়ালীউল্লাহর ফ্রান্স প্রবাসী ছেলে ও মেয়ে।
Published : 04 Jul 2024, 01:25 PM
ঢাকার গুলশানে কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বাড়ির প্রকৃত অবস্থা জানতে পরিদর্শক নিয়োগের আবেদন মঞ্জুর করেছে আদালত।
ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আলমগীর আল মামুন গত ৯ এপ্রিল দুই পক্ষের শুনানি শেষে এ আদেশ দিলেও সম্পূর্ণ লিখিত আদেশ পাওয়া যায় বুধবার।
এ বিষয়ে বিবাদীদের আপত্তি নাকচ করে বিচারক আদেশে বলেছেন, এ মামলার সুষ্ঠু নিষ্পত্তির স্বার্থে ওই বাড়ির প্রকৃত অবস্থা জানা দরকার। সে কারণে একজন আইনজীবীকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হবে এবং তিনি আদালতে প্রতিবেদন জমা দেবেন।
আদালতে বাদীপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত, চিত্তরঞ্জন বল সুশান্ত বসু, ও দীপঙ্কর ঘোষ। আদালতের আদেশের বিষয়টি আইনজীবী দীপঙ্কর ঘোষ সাংবাদিকদের জানান।
জাল দলিলের মাধ্যমে গুলশানে ওয়ালীউল্লাহর জমি-বাড়ি আত্মসাতের অভিযোগে ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে দেওয়ানি মামলা করেন তার ছেলে ইরাজ ওয়ালীউল্লাহ ও মেয়ে সিমিন ওয়ালীউল্লাহ।
মামলায় তারা অভিযোগ করেন, ওয়ালীউল্লাহর মৃত্যুর পর ‘ভালোবেসে ও বিশ্বাস করে’ তারই মামাতো ভাই ও পরিবারের ঘনিষ্ঠ কামাল জিয়াউল ইসলামকে (কে জেড ইসলাম) নিজেদের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিল তাদের পরিবার। কিন্তু তিনি সেই ‘ভালোবাসার দাম’ দেন সম্পত্তি নিজের ছেলের নামে হস্তান্তর করে।
দেড়শ কোটি টাকা মূল্যের গুলশানের ওই সম্পত্তির মালিকানা ও দখল বুঝিয়ে দেওয়ার আবেদন করা হয় ফ্রান্স প্রবাসী ইরাজ ও সিমিনের ওই মামলায়।
একইসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে জমির উপর যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ এবং সম্পত্তির আকারের পরিবর্তন বা ক্ষতিসাধনের উপর নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়।
মামলায় তাদের আত্মীয় ও গৃহনির্মাণ ব্যবসায়ী কামাল জিয়াউল ইসলাম, তার স্ত্রী খাদিজা ইসলাম, ছেলে রাইয়ান কামাল ও রাহাত কামাল এবং তাদের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নির্মাণ বিল্ডার্স অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেডকে মূল বিবাদী করা হয়।
এছাড়া রাজউক, গৃহায়নও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ (রাজস্ব) ছয়জনকে মোকাবেলা বিবাদী করা হয়।
মামলার আরজিতে বলা হয়, ওয়ালীউল্লাহ ১৯৭০ সালের ১২ মার্চ গুলশান মডেল টাউনের ১০ নম্বর প্লটের সিইএন (বি), ৯৬ নম্বর সড়কে ১ বিঘা ২ কাঠা জমি এবং তার ওপর দুই তলা ভবন জনৈক মোহাম্মদ আশরাফীর কাছ থেকে হস্তান্তর সূত্রে মালিকানা পান। রাজউকের এই সম্পত্তি ৯৯ বছরের জন্য লিজ সূত্রে মালিক ছিলেন আশরাফী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্যারিসে চাকরিতে থাকাকালে ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর মারা যান সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। তখন তার স্ত্রী আন-মারি ওয়ালীউল্লাহ (আজিজা নাসরিন) ছিলেন ফরাসি নাগরিক এবং তাদের দুই সন্তান ছিলেন অপ্রাপ্ত বয়স্ক।
এ অবস্থায় গুলশানের ওই সম্পত্তি দেখাশুনার জন্য আন-মারি তার স্বামী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মামাত ভাই ও তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ কে জেড ইসলামকে আম-মোক্তারনামা দেন।
পরবর্তীতে তার ছেলে-মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলে কে জেড ইসলামের বরাবরে নতুন আরেকটি আম-মোক্তারনামা দেওয়া হয়। সেই সূত্রে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়ে কে জেড ইসলাম ওই বাড়িতেই পরিবারসহ থাকতেন। আন-মারি ও তার দুই সন্তান ঢাকায় এলে কে জেড ইসলামের সঙ্গেই ওই বাড়িতে উঠতেন।
১৯৯৭ সালের ১২ জুলাই আন-মারি মারা যান। তার মৃত্যুর আগেই মায়ের সঙ্গে তার দুই সন্তানও ওই সম্পত্তিতে নাম জারি করে মালিকনাপ্রাপ্ত হন। তখনও আম-মোক্তারনামা সূত্রে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের চাচা কে জেড ইসলামের কাছেই ছিল।
মামলায় বলা হয়, ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল ফ্রান্স থেকে ঢাকায় আসেন ইরাজ ওয়ালীউল্লাহ ও সিমিন ওয়ালীউল্লাহ। মৃত মা আন-মারিকে বাদ দিয়ে সম্পত্তিটি নিজেদের নামে নামজারি করার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন তারা।
তবে ঢাকায় এসে তারা ওই বাড়িতে গেলে জনতে পারেন যে, জায়গা ও বাড়িটি কে জেড ইসলাম তার বড় ছেলে রাইয়ান কামালের কাছে আম-মোক্তারনামার শর্ত লংঘন করে হস্তান্তর করেছেন। তবে সম্পত্তিটি নিজের নামে নামজারি করতে রাজউকে গিয়ে ব্যর্থ হন রাইয়ান কামাল। এরপর রাজউকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেও নামজারির আদেশ পাননি তিনি।
বাদীপক্ষে বলা হয়, মামলা করার সময় কে জেড ইসলাম এবং অন্যরা সেখানে ১৪ তলা ভবন নির্মাণে জন্য বেজমেন্ট নির্মাণ করেছেন। মামলা চলা অবস্থায় এ নির্মাণ বেআইনি। মামলা চলমান থাকা অবস্থায় সম্পত্তির আকার প্রকৃতি পরিবর্তন আইনসঙ্গত নয়।
নির্মাণ ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল জিয়াউল ইসলাম এক সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ছিলেন। ওই সময়েই বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে স্কুল ক্রিকেট চালু হয়।
কামাল জিয়াউল ইসলামের স্ত্রী খাদিজা ইসলাম নির্মাণ ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান। তাদের ছেলে রায়হান কামাল ও রাহাত কামালও কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য।
লাল সালু, কাঁদো নদী কাঁদোর মত উপন্যাসের লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ১৯৫১ ও ৬০ এর দশকে পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারির দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ওই বছর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রবাসে থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালান।
ওয়ালীউল্লাহর ছেলে-মেয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ওই জমি ফেরত পেলে সেখানে তারা একটি ফাউন্ডেশন করতেন চান।
অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নির্মাণ বির্ল্ডাস অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাহাত কামাল বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওয়ালীউল্লাহ একজন সন্মানী ব্যক্তি । কিন্তু তার সন্তানরা সেরকম নন। তারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করেছেন।”
এরপর জরুরি মিটিং থাকার কথা বলে পরে এ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার কথা বলেন রাহাত কামাল। বেলা দেড়টার পর তিনি ফোন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদককে বলেন, “সম্পত্তি পরিদর্শনে এরকম কোনো আদেশ হয়নি। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”
পুরনো খবর'