বাম হাত দিয়ে ডান হাত তুলে দেখিয়ে তিনি বলেন, “পায়ের সাথে হাতটাও অকেজো হয়ে গেল ভাইজান। কেমনে অটো চালাব? দুঃখ গরীবের সাথ ছাড়ে না।”
Published : 21 Jan 2024, 08:21 AM
যেতে চেয়েছিলেন পঙ্গু হাসপাতালে, মাঝপথে দালালের খপ্পরে বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন বেসরকারি একটি হাসপাতালে। এতে সড়ক দুর্ঘটনায় কাতরাতে থাকা মাদারীপুরের এক অটোরিকশা চালকের দুর্ভোগ-যন্ত্রণায় নতুন মাত্রা যোগ হল; হাসপাতালের চাহিদা মত টাকা না দেওয়ায় প্রায় সাত দিন মিলল না চিকিৎসা সেবা, এমনকি বন্ধ রাখা হল খাবারও।
পরে প্রায় সোয়া তিন লাখ টাকা আদায়ের পর ভয়ভীতি দেখিয়ে শ্যামলীর বেসরকারি ওই হাসপাতাল থেকে ‘তাড়িয়ে’ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ শাহাবুদ্দিন ফকির (৪০) নামের ওই অটোরিকশা চালকের।
সেই ‘প্রাইম জেনারেল হাসপাতালে ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ এ ১৪ দিন কাটিয়ে ‘যথাযথ’ চিকিৎসা না পেয়ে শাহাবুদ্দিন আবার ভর্তি হয়েছেন পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)। দুই মাস ধরে সেখানেই চিকিৎসাধীন তিনি।
শনিবার এ হাসপাতালের ওয়ার্ডেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকের সঙ্গে দুদর্শার কথা বলছিলেন শাহাবুদ্দিন। দালালের খপ্পরে পড়ে কীভাবে চরম ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করেছেন সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে তিনি ধরেন।
শুক্রবার শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী মুক্তা বেগম প্রাইম জেনারেল হাসপাতালের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিলে সামনে আসে এ অটোরিকশা চালকের দুর্ভোগের বিষয়টি।
অভিযোগ পাওয়ার পর প্রাথমিক তদন্তে ওই থানার এএসআই রাসেল হাওলাদার এ ঘটনার সতত্য পাওয়ার কথা বলেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে শাহাবুদ্দিন ও প্রাইম হাসপাতালের কর্ণধার আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রাথমিকভাবে ওই নারীর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
তবে প্রাইম জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
কী ঘটেছিল শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে
মাদারীপুরের কেন্দুয়া ইউনিয়নের অটোরিকশা চালক শাহাবুদ্দিন ফকির (৪০) বর্তমানে নিটোর এ চিকিৎসাধীন। চিকিৎসা শেষ না হলেও টাকা না থাকায় চিকিৎসককে অনুরোধ করে ছাড়পত্র নিয়েছিলেন তিনি।
পরে নিটোর এর পরিচালক অধ্যাপক কাজী শামীম উজ্জামান বিষয়টি জানতে পেরে সেই ছাড়পত্র বাতিল করে তাকে ভর্তি রেখেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর শাকুরা পরিবহনের বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে দুর্ঘটনায় পড়েন শাহাবুদ্দিন। দুর্ঘটনায় তার অটোরিকশা দুমড়ে মুচড়ে যায়। বাঁ পা ও ডান হাত প্রায় গুঁড়িয়ে যায়।
নিটোরের মডেল-বি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শাহাবুদ্দিন প্রায় দুই মাস হল এখানে আছেন। এরই মধ্যে তিনবার তার অপারেশন হয়েছে, সঙ্গে চলছে অন্য চিকিৎসা।
বাঁ পায়ে নাট বল্টু ঢুকিয়ে প্লাস্টার করে রাখা হয়েছে। তবে ডান হাতটি একবারে নিথর।
বাঁ হাত দিয়ে ডান হাত তুলে দেখিয়ে তিনি বললেন, “পায়ের সাথে হাতটাও অকেজো হয়ে গেল ভাইজান। কেমনে অটো চালাব? দুঃখ গরীবের সাথ ছাড়ে না।”
দালালের খপ্পরে
এতদিন ধরে হাসপাতালে থাকতে থাকতে ক্লান্ত এবং অর্থাভাবে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চল্লিশোর্ধ্ব এ অটোরিকশা চালক বলেন, দুর্ঘটনার পর স্বজনরা তাকে রাজৈর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় নিয়ে আসেন তারা। তবে এ হাসপাতালে ঢোকার আগেই পড়েন দালালের খপ্পরে।
নিটোর এর ওয়ার্ডে স্বামীর পাশে থাকা মুক্তা বেগম বলেন, “গত ৭ নভেম্বর ঢাকায় ঢুকে পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার পথে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনের পথে পরিচিত একজনের সাথে কথা বলতে গিয়েই আমরা দালালের খপ্পরে পড়ি।
“পঙ্গু (নিটোর) হাসপাতালে গেলে পা কেটে ফেলবে, হাত কেটে ফেলবে এ ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে বেসরকারি প্রাইম জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়।”
সেখানে তারা প্রায় ১৪ দিন ছিলেন। তবে ঠিকঠাক চিকিৎসা সেবা না দেওয়ায় শাহাবুদ্দিন সুস্থ হয়ে ওঠেননি বলে দাবি মুক্তার। অথচ তিন লাখ ২০ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয় বলে তাদের অভিযোগ।
মুক্তা বলেন, “আমরা কয়েক ধাপে ঋণ কর্জ করে ৮৫ হাজার টাকা দিই। কিন্তু পুরো টাকা না দেওয়ায় সাত দিন পর আমাদের সব ধরনের চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি খাওয়াও দেওয়া হয়নি। বাইরে বের হতে দেয়নি। পাশের রোগীর স্বজনদের কাছে অনুরোধ করে সাত দিন কোনোমতে দিনে এক দুই বেলা রুটি কলা এনে খাই।”
তাদের সঙ্গে ছিল চার বছরের শিশু কন্যা। এরপরও তাদের খাবার দেওয়া হয়নি। মুক্তা বলেন, “ছোট্ট বাচ্চা থাকায় না খাওয়ার কষ্ট যে কী তা বুঝিয়ে বলা যাবে না।”
শাহাবুদ্দিন বলেন, বিলের টাকা দিতে না পারায় প্রাইম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার কয়েকজন আত্মীয়র মাধ্যমে দুর্ঘটনায় জড়িত বাস কোম্পানি শাকুরা পরিবহনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের কাছ থেকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা আদায়ও করে।
প্রাইম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের সব টাকা বুঝে পাওয়ার পরও ‘সুষ্ঠু চিকিৎসা না দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়’ বলে থানায় অভিযোগ করেছেন মুক্তা।
দুর্ঘটনার পর থেকে আহত এ অটোরিকশা চালকের পরিবার চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে।
শাহাবুদ্দিন বলেন, অটোরিকশা চালিয়ে যতটুকু পুঁজি ছিল তা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। হাসপাতাল থেকে যে খাবার দেওয়া হয় শিশু সন্তান ও স্ত্রীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।
এমন অবস্থায় টাকা জোগাড় করতে না পেরে চিকিৎসা শেষ না করেই বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য ছাড়পত্র নিয়েছিলেন। পরে নিটোর এর পরিচালক তাকে ভর্তি রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
প্রাইম হাসপাতালের বক্তব্য
প্রাইম জেনারেল হাসপাতালের কর্ণধার আব্দুর রাজ্জাকের দাবি, তাদের হাসপাতালের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ঠিক নয়; অত টাকা তারা নেননি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ওই রোগীর ৪-৫ ধরনের সমস্যা ছিল। মোটামুটি একটা চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এই রোগী গরীব মানুষ, আরও চিকিৎসা দরকার। এজন্য তাকে এখানে ১৪ দিন রেখে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। পরে তার (শাহাবুদ্দিন) এলাকার এক সংসদ সদস্যের অনুরোধে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হয়।”
দালালের মাধ্যমে এ রোগী আনার বিষয়টিও অস্বীকার করেন তিনি।
‘অন্য কারও প্ররোচনায়’ রোগীর স্ত্রী থানায় অভিযোগ করেছেন বলে তার ধারণা।
নিটোরের পরিচালক যা বললেন
নিটোর এর পরিচালক অধ্যাপক শামীম উজ্জামান বলেন, ভর্তির পর রোগীর প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসা তারা দিচ্ছেন; অস্ত্রোপ্রচারও হয়েছে।
আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা শেষ না করেই ওই রোগীর চলে যাওয়ার বিষয়টি শনিবার পরিচালকের নজরে আসে। এরপর তিনি চিকিৎসা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়পত্র না দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা সব ধরনের রোগীকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি।”