নীতিমালা অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় বইমেলা এর চরিত্র ধরে রাখতে পারছে না বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
Published : 24 Feb 2024, 10:43 PM
কবিতা, গল্প, উপন্যাসের বিক্রি কমলেও অনুপ্রেরণামূলক ও পেশা বা কর্মজীবনে উন্নতির পরামর্শমূলক বইয়ের বিক্রি বেড়েছে একুশে বইমেলায়। সাম্প্রতিক ঘটনার কারণে সোশাল মিডিয়ার আলোচনায় থাকা লেখকদের বইয়ের কাটতিও বাড়তি।
বইমেলা ঘুরে ও সৃজনশীল সাহিত্যের বই প্রকাশ করেন, এমন অন্তত ১০ জন প্রকাশকের কথায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে প্রকাশকরা বলছেন, এতে একুশে বইমেলা আদর্শিক বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। ফেইসবুক, ইউটিউবে নানামুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়া ব্যক্তিদের চটকদার লেখক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে বই প্রকাশ মেলার পরিবেশ নষ্ট করছে।
নীতিমালা অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই ক্রমশ বইমেলা এর চরিত্র ধরে রাখতে পারছে না বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
মেলার পরিবেশ ও বই বিক্রি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী রবিন আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাহিত্যের বই থেকে পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তারা এখন ক্যারিয়ারমুখি বই, মোটিভেশনাল বই বেশি কিনছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়াদের দিয়ে জোর করে বই প্রকাশ করছেন এক শ্রেণির প্রকাশক। তারা বইমেলার পরিবেশ নষ্ট করছেন।“
অ্যাডর্ন পাবলিকেশনের স্বত্তাধিকারী সৈয়দ জাকির হোসাইন বলেন, "আমরা মাছ চাষ নিয়ে একটা বই করেছিলাম। সেই বইটার দামও ছিল বেশি। কিন্ত সেই বইটা অনলাইনে প্রচুর অর্ডার হচ্ছে। এর চেয়ে অনেক কম দামে সাহিত্যের ভালো বই আছে, কিন্তু সেই বইগুলো বিক্রি কম হচ্ছে।"
বাংলা একাডেমির সাম্মানিক ফেলো রামেন্দু মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "বই কেনার বিষয়টি একেবারেই পাঠকের স্বাধীনতা এবং রুচির ব্যাপার। তারা যে বইটি প্রয়োজন মনে করবেন, সেটিই কিনবেন। তবে পাঠকের রুচি গড়ার ক্ষেত্রে প্রকাশক এবং লেখকের দায় রয়েছে।"
সেই সঙ্গে কোন ধরনের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে মেলায় স্টল দেওয়া হবে, সেটা নীতিমালা মেনে কমিটিকে আরও বেশি যাচাই করে স্টল বরাদ্দ দেওয়ার পরামর্শ তার।
কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের দৌড়ঝাঁপ
শনিবার মেলার মাঠে সোশাল মিডিয়ার কিছু কন্টেন্ট ক্রিয়েটরকে দেখা যায় তারা হিরো আলমকে ঘিরে রেখেছেন।
হিরো আলম বিভিন্ন স্টলের সামনে দিয়ে ঘুরছেন আর জটলা তৈরি করছেন কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের দল।
এর আগের কয়েকদিন এমন জটলা ছিল সোশাল মিডিয়ায় আলোচিত অন্য ব্যক্তিদের নিয়ে।
এসব বিষয় মেলার পরিবেশ নষ্ট করছে বলে মনে করছেন দর্শনার্থীদের কেউ কেউ।
ধানমন্ডি থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিকাল থেকেই মেলায় ঘুরছিলেন তাসমিয়া জান্নাত। সন্ধ্যার পর মুক্তধারার স্টলের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "বিকালে মেলার জলাধারের কাছে কয়েকজন ইউটিউবারকে দেখলাম ক্যামেরা নিয়ে বসে আছেন, তাদের একজন অপরজনকে বলছিলেন হিরো আলম ৫টার দিকে আসবেন।
“পরে সাডে ৫টার দিকে দেখি হিরো আলমকে ঘিরে ওইসব ইউটিউবারেরা জটলা করে টানা ভিডিও করছেন। আচ্ছা, ইন্টারভিউ নিলে তো ১০ মিনিটেই হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তারা টানা কি ভিডিও করেন?”
পাশা থাকে জুলফিকার নামে আরেকজন বলেন, মূলধারার সংবামাধ্যম কিন্তু সেখানে নেই। এসব ইউটিউবারদের আলমই নিয়ে আসছে। আলম যেদিকে যায়, ওরাও সারাক্ষণ ক্যামেরা অন করে পেছনে ছুটছেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মুক্তমঞ্চের পাশে দেখা যায়, করোনাকালে ভুয়া 'করোনাভাইরাসের সনদ' দিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে আলোচনায় আসা ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে ঘিরে জটলা তৈরি করেছেন আরেকদল কন্টেন্ট ক্রিয়েটর।
তার পাশে দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলেন মুহিবউল্লাহ নামে একজন। তিনি বলছিলেন, "এরাই বইমেলাটাকে শেষ করে দিল।"
মেলার নীতিমালার সুষ্ঠ প্রয়োগ হলে অনেক কিছুতেই শৃংখলা ফিরবে বলে মনে করেন কবি ও নাট্যকার অপু মেহেদী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতিবারই মেলায় নীতিমালা লঙ্ঘনের দায়ে কিছু প্রকাশনীকে শোকজ করা হয়, পরেরবার দেখি তারা মেলায় স্টল বরাদ্দ পায় এবং আবারও একই কাজ করে।
মিজান পাবলিশার্সের বিরুদ্ধে শুক্রবার বাংলা একাডেমির কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কথাসাহিত্যক মাসউদ আহমাদ।
‘একুশে বইমেলায় বিব্রতকর পরিস্থিতির ঘটনা নিয়ে তদন্তের আবেদন’ শীর্ষক অভিযোগে তিনি মেলায় মিজান পাবলিশার্সের স্টলে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত মুশতাক আহমেদের তিশাকে নিয়ে প্রকাশিত বই কিনতে গিয়ে প্রতারিত হওয়ার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, মুশতাকের বই দেখতে চাইলে বিক্রয়কর্মী তা দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, দেখতে চাইলে কিনতে হবে। পরে টাকা দিলে সেই বই না দিয়ে অন্য বই ব্যাগে করে হাতে দেন। সেটি কাঙ্খিত বই না হওয়ায় নিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই কর্মী টাকা ফেরত দেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেয়।
এরপর মাসউদ আহমদ টাকা না নিয়েই ওই স্টল থেকে চলে আসেন এবং একাডেমির কাছে অভিযোগ দেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মিজান পাবলিশার্সের স্টলে গেলে বিক্রয়কর্মীরা কেউ কথা বলতে চাননি। এটির প্রকাশক মিজানুর রহমান পাটোয়ারীকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
তবে মুশতাকের তিশাকে নিয়ে লেখা বইটি তারা শনিবার বিক্রি করেনি।
কী করছে টাস্কফোর্স
বইমেলায় স্টলের অনিয়ম ও পাইরেটেড বই বিক্রি হচ্ছে কি না-তা দেখার জন্য একটি টাস্কফোর্স কমিটি কাজ করছে। এ কমিটির চারজন সদস্যের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেছেন, নীতিমালা লঙ্ঘনের অনেকগুলো ঘটনা মেলা কমিটিকে জানানো হয়েছে। টাস্কফোর্স কেবল প্রতিবেদন দিতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মেলা কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।
গতবার পাইরেটেড বই বিক্রির কারণে শোকজ করা হয়েছিল, এমন স্টলও এবার মেলায় বরাদ্দ পেয়েছে এবং তারা এবারও একই কাজ করছে বলেও জানান টাস্কফোর্সের ওই সদস্য।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এবার আমরা ১৯টি স্টলকে শোকজ করেছি। তবে মেলা চলাকালীন কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। মেলার পর কমিটির সভায় নিয়মভঙ্গকারীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।
এসব বিষয়ে লেখক ও প্রকাশকরা মেলা কমিটিকে কঠোর হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।
সংবিধান প্রণেতাদের নিয়ে বই, আড্ডা
আমীন আল রশীদের লেখা 'সংবিধান প্রণেতাগণ' নামে একটি বই প্রকাশ করেছে শিলালিপি প্রকাশনী। স্বাধীন বাংলাদেশে ৩৪ জন সংবিধান প্রণেতার মধ্যে ১২ জনকে নিয়ে এবার মেলায় এসেছে বইটির প্রথম খণ্ড। আগামী মেলায় বাকিদের নিয়ে বইটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ হবে।
আমীন আল রশীদ বলেন, "এই বইটি প্রকাশ হওয়ার আগে ১২ পর্বে আমার সিরিজ লেখা প্রকাশ করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। এবার বই আকারে এসেছে।"
শনিবার সন্ধ্যায় স্টলটির সামনে বইটিকে ঘিরে আড্ডার আয়োজন হয়। সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন সংবিধান প্রণেতাদের পরিবারের সদস্যরা।
উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক হাফেজ হাবিবুর রহমানের ছেলে মঈনুর রহমান, একে মোশাররফ হোসেন আকন্দের ছেলে মাসুদ আলম আকন্দ, অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মেয়ে নাসরিন ইসলাম, লুৎফর রহমানের ছেলে মো. সাজ্জাদুর রহমান ও মোছা. জেবুন্নাহার শিউলী।
আমীন আল রশীদ বলেন, "সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে এখন মাত্র চারজন জীবিত রয়েছেন। এই বইতে ১২ জনকে নিয়ে লিখেছি। তাদের পরিবারের সদস্যরা নানাভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। বইটি প্রকাশ উপলক্ষে আমরা অনানুষ্ঠানিক এই আড্ডায় মিলিত হলাম।"
শনিবার ছিল বইমেলার ২৪তম দিন। মেলা শুরু হয় সকাল ১১টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ছিল শিশুপ্রহর। সকালে লোক সমাগম কম হলেও বিকেলের পর দর্শনার্থীদের আগমন বেড়েছে।
মেলা পরিচালনা কমিটির তথ্য অনুযায়ী, এদিন নতুন বই এসেছে ১৩৮টি।
এদিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও গবেষক শাহনাজ পারভীন, কবি ও অনুবাদক সাইফুল ভূঁইয়া, কথাসাহিত্যিক শাহনাজ পারভীন স্মৃতি ও গবেষক মনিরুজ্জামান শাহীন।
'বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন' মঞ্চে বিকেলে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত, মুহম্মদ মোজাম্মেল হক রচিত মুক্তিযুদ্ধ ও আলোকচিত্র বই বিষয়ে লেখকের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
মূল মঞ্চ
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ: মোহাম্মদ রফিক এবং স্মরণ: খালেক বিন জয়েনউদদীন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যথাক্রমে আলতাফ শাহনেওয়াজ ও সুজন বড়ুয়া। আলোচনায় অংশ নেন শামীম রেজা, শোয়াইব জিবরান ও আসলাম সানী। সভাপতিত্ব করেন আবুল মোমেন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি মাকিদ হায়দার, আশিক আকবর, মাহবুব আজীজ, বীরেন মুখার্জী, আরেফিন রব, কাফি শেখ, সালেহ মুজাহিদ এবং তিথি বালা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী নূরুল হাসনাত জিলান, লুৎফুন নাহার লতা, নিমাই মণ্ডল, সাহিত্য ভঞ্জ চৌধুরী।
এছাড়া ছিল আসাদুজ্জামান মান্নার পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘কুষ্টিয়া আবৃত্তি পরিষদ’, মাসুম হুসাইনের পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘পরম্পরা নৃত্যালয়’, মাহবুব রিয়াজের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী’ এবং হাসান আবদুল্লাহ বিপ্লবের পরিচালনায় ‘ঘাসফুল’ এর পরিবেশনা।
সংগীত পরিবেশন করেন ইয়াকুব আলী খান, সালাউদ্দিন আহমদ, সুজিত মোস্তফা, নফিসা মাহজাবিন, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী, তাপসী ঘোষ, বর্ণালী সরকার, ফারহানা আক্তার ও ঝর্ণা রায় ভাবনা। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন কাজী মো. ইমতিয়াজ সুলতান (তবলা), রবিন্স চৌধুরী (কী-বোর্ড), মো. হাসান আলী (বাঁশি), ফিরোজ খান (সেতার), বিশ্বজিৎ সেন (মন্দিরা)।
রোববার যা থাকবে
রোববার বইমেলার ২৫তম দিন যথারীতি মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন কাজী নূরুল করিম দিলু। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন তানভীর নেওয়াজ ও মাহমুদুল আনোয়ার রিয়াদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন জেবুন নাসরীন আহমেদ।