সাবেকদের পরামর্শ পেয়ে স্বস্তি ফিরেছে সিইসির মধ্যে।
Published : 20 Oct 2022, 12:48 AM
গাইবান্ধায় ভোট বন্ধের নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে পরামর্শ নিতে সাবেকদের ডেকেছিল নির্বাচন কমিশন; সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাবেকরা এসে দিলেন সাহস, বললেন এমন কঠোর থেকে এগিয়ে যেতে।
আগামী সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব যাদের হাতে, কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন সেই ইসির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বুধবার নির্বাচন ভবনে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত হন সাবেক তিনজন সিইসি, চারজন কমিশনার, পাঁচজন সচিব এবং দুজন অতিরিক্ত সচিব।
প্রায় তিন ঘণ্টাকাল তাদের সঙ্গে সভা করার পর অনেকটাই নির্ভার হয়ে সাংবাদিকদের হাবিবুল আউয়াল বলেন, “উনারা আমাদের মুরব্বিজন, গুরুজন হিসেবে পরামর্শ দিয়েছেন। সততার সাথে, সাহসিকতার সাথে আমাদের এগিয়ে যেতে বলেছেন।”
গাইবান্ধায় নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে আগামীতেও পেছপা না হতে উত্তরসূরিদের প্রতি আহ্বান রেখেছেন সাবেক সিইসি ও কমিশনাররা।
তারা বলছেন, নির্বাচনী কার্যক্রমের পুরোটাই ইসির হাতে রাখতে হবে। মাঠ প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয়ে কোনো ঘাটতি থাকলে তা দূর করতে হবে। আবার অনিয়মে কেউ জড়িত হলে তাকে শাস্তি দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য কঠোর বার্তা রাখতে হবে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসিকে সতর্ক হয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন সাবেকরা।
আগামী বছরের শেষে কিংবা পরের বছরের শুরুতেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনের দায়িত্ব নিয়ে সাত মাস আগে আউয়াল কমিশনের যাত্রা শুরু করলেও সব রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জন এখনও করতে পারেনি তারা।
এরমধ্যে গত ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনে উপ-নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণে অনিয়মের চিত্র ঢাকায় বসে সিসি ক্যামেরায় দেখে ভোট বন্ধ করে দেয় ইসি। গোটা সংসদীয় আসনে ভোট বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা আগে না ঘটায় তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।
এই প্রেক্ষাপটে সাবেকদের আমন্ত্রণ জানায় ইসি। সিইসি বলেন, “আজ আমাদের পক্ষ থেকে আমরা কোনো বক্তব্যই দিইনি; তাদেরকে শুনেছি।
“গাইবান্ধাতে যে একটা ঘটনা ঘটে গেল, আমাদের প্রয়োজন ছিল আরও এনলাইটেন্ড হওয়া; উনাদের তরফ থেকে কোনো গাইডেন্স আছে কিনা, কিভাবে মূল্যায়ন করেছেন অতটুকু জেনেছি।”
গাইবান্ধায় ভোট বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষেই বলেছেন সাবেকরা, যাতে স্বস্তি ফিরেছে ইসিতে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফ এমনও বলেছেন, এমন ঘটনা ঘটলে ‘বারবার’ ভোট বন্ধ করে দিতে হবে।
মতবিনিময় সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “যখন ভোটাররা ভোট দিতে পারে না। একজনের ভোট আরেকজন দেয়, তখন নির্বাচন কমিশন বসে থাকবে কেন? স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (বন্ধ করার) এ অধিকার আছে। তাদের চোখের সামনে ধরা পড়ছে; ভোট দিতে পারছে না। কারচুপি হচ্ছে। তারা নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছে।
“আমরা বলেছি, দরকার হলে বারে বারে বন্ধ করবেন। জাতিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন।”
তবে নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যে কঠিন, তা স্মরণ করিয়ে দেন রউফ।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের ‘হাতজোড় করলেও তারা সরকারের কথাই শুনবে’, ইসির নয়।
১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় সিইসির দায়িত্বে থাকা বিচারপতি রউফের সময়কালে মাগুরার উপ-নির্বাচন নিয়েও এমন অভিযোগ ছিল।
বুধবারের সভায় অংশ নেওয়া সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন সেই প্রসঙ্গ টেনে সাংবাদিকদের বলেন, “১৯৯৪ সালে (মাগুরা উপনির্বাচনের সময়) যদি এটা করা হত, তাহলে আজকে পলিটিক্যাল ফিল্ডটা অন্যরকম হতে পারত।”
সেই নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে বিচারপতি রউফ বলেন, “আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই। পেছনেরটা টেনে এনে জাতিকে আর অন্ধকারে ফেলবেন না।”
২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় কমিশনারের দায়িত্বে থাকা সাখাওয়াত গাইবান্ধার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “যে অ্যাকশনটা নিয়েছে, আমি তাদের ওয়েলকাম জানিয়েছি।
“যতক্ষণ পর্যন্ত ইসি মনে করবেন যে পরিবেশ ঠিক হয়নি, ততক্ষণ পর্যন্ত বন্ধ রাখতে পারবেন; কোথাও কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশে এর আগে কোনো কমিশন এই কাজটি করতে পারেনি।”
তবে এর ধারাবাহিকতা প্রত্যাশা করছেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার।
“এই পর্যন্ত ঠিক আছে। পরের ধাপগুলো যাতে আপনারা স্লিপ না করেন। যদি করেন, তাহলে জাতির কাছে অন্যরকম একটা মেসেজ যাবে যে আপনারা এটুকু দেখানোর জন্য করলেন; বাকিগুলো করলেন না। আইন আপনাদের যে শক্ত অবস্থানে যেতে বলেছে, প্লিজ ডু ইট।”
সদ্য সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, “গাইবান্ধা নির্বাচনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।
“এখন মাঠ প্রশাসনে ভালো একটি সমন্বয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের সাথে ঘন ঘন বৈঠক করতে হবে। তাদেরকে নির্বাচনী কাজে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।”
তবে গাইবান্ধা উপ-নির্বাচনে কেন এমন হল, কারও কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।
দরকার হলে বারে বারে বন্ধ করবেন। জাতিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেনবিচারপতি আব্দুর রউফ
অনিয়মে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি মাঠ প্রশাসন-পুলিশ ও নিজস্ব কর্মকর্তাদের আস্থা অর্জনের পরামর্শ দেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত।
সংবিধান মেনে সাহসের সঙ্গে কাজ করার জন্য বর্তমান ইসিকে পরামর্শ দেন সাবেক সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ আগামীতে জেলা প্রশাসকের পাশাপাশি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদেরও কিছু আসনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম মাঠের কাজে সমন্বয়ের পরামর্শ দেন ইসিকে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম উত্তরসূরিদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, “ইসির কোনো মিত্র নেই। ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে না পারলে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ আসতে পারে।”
সাবেক ইসি সচিব এম এম রেজা সমালোচনা দেখে থেমে থাকার পরামর্শ দেন ইসিকে।
রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে জেলা প্রশাসকদের বাদ দিলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ‘কঠিন’ হবে বলে মন্তব্য করেন সাবেক ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। প্রশাসনের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাতে বিভাগীয় পর্যায়ে মতবিনিময়ের পরামর্শ দেন সাবেক এই আমলা।
সাবেক ইসি সচিব মোহাম্মদ সাদিকও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানোর পরামর্শ দেন।
সাবেক ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, উপ-নির্বাচনে দায়িত্বে অবহেলায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইসি কী চায়, তা ভোটার, প্রার্থী ও দলের কাছে স্পষ্ট করতে হবে। এখন থেকে সুষ্ঠু ও অবাধ ভোটের জন্য কাজ করে যেতে হবে।
ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান জাতীয় নির্বাচনে সব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা সংযোগ ‘অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং’ বলে মত দেন।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, পুরো নির্বাচনী কার্যক্রম ইসির পুরো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কমিশনকে সতর্ক হয়ে কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।
এনআইডি ইসির হাতে রাখার পক্ষে মত
জাতীয় পরিচয়পত্র তথ্য ভাণ্ডার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় বর্তমান ইসি কোনো আপত্তি না জানালেও সাবেকদের মধ্য থেকে বিপক্ষেই মত এসেছে।
যে ইসির সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ শুরু হয়েছিল, সেই সময়কার নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত বলেন, “এনআইডির পিছনে এতগুলো বছর একটা সিস্টেম ডেভেলপ করেছে ইলেকশন কমিশন। এটা যদি আলাদা হয়ে যায়, তাহলে কোনো এক সময়ে ইন ফিউচারে ভোটার লিস্ট নিয়ে কথা উঠবে, কারটা ঠিক?।”
সাবেক সিইসি বিচারপতি রউফ বলেন, “জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বিভিন্ন অফিসে থাকতে পারে, এতে অসুবিধা নেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যেহেতু এর প্যারেন্ট, মূলটা তারাই ইনিশিয়েট করবে।
“এটা তাদের কাছে না থাকলে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে যদি দেখেন এনআইডিতে একটা, ভোটার লিস্টে অন্যটা, তখন আরেকটা গণ্ডগোল লাগবে। আমার কথা হলো বেইজটা ইসির হাতে থাকবে। অন্যদের লাগলে সেটা নেবে।”
সাবেক সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন বলেন, “ভোটার তালিকা থেকেই এনআইডি এসেছে। এনআইডি ইসির কাছে না থাকলে লোকজন ভোটার হতে চাইবে না। মানুষের ভোটার হওয়ার অতটা আগ্রহ নেই। এখন এনআইডির জন্যই আগ্রহ বেশি।
“এই অ্যাডভেন্টেজটা এখান থেকে সরানো উচিৎ নয়। এতে গণ্ডগোল হতে পারে। এটা এখানে থাকা উচিৎ। এটাতে কোনো দুর্বলতা থাকলে সেটাকে সঠিক করতে হবে।”
সাবেক সিইসি নূরুল হুদা বলেন, “এনআইডি নির্বাচন কমিশনের তৈরি একটি জিনিস। এটা নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকলে সরকারের কোনো অসুবিধা হয় না। এনআইডির সাথে জাতীয় নির্বাচন, ভোটার তালিকার পুরোপুরি সম্পর্ক রয়েছে। এটাকে মাঝখান থেকে নিয়ে গেলে নির্বাচন কমিশনের কাজ করতে অসুবিধা হবে।”
ইভিএমে দুই ধরনের মত
বহুল আলোচিত ইভিএম নিয়েও নানা পরামর্শ দিয়েছেন সাবেকরা।
বিচারপতি রউফের মত হচ্ছে, কমিশন চেষ্টা করতে থাকুক। মানুষ যদি শিক্ষিত হয় তাহলে ইভিএম ব্যবহার হবে।
সাবেক কমিশনার সাখাওয়াত বলেন, “ভালো হোক, মন্দ হোক, দেড়শ আসনে ইভিএম না কিনে যতখানি পারেন তার চেয়ে বেটার সিসি ক্যামেরা কেনেন।”
ইভিএমের পক্ষে মত দিয়ে সাবেক সিইসি রকিবউদ্দীন বলেন, “নতুন ইভিএম অলমোস্ট ডিজিটাল। কিন্তু এটা তো লোকজনকে জানতে হবে। এটা নিয়ে ইতিবাচক প্রচারণার দরকার আছে।”
সাবেক সিইসি নূরুল হুদাও ইভিএমের পক্ষে সুপারিশ জানিয়ে বলেন, “আমাদের এখানে ভোটের পরিবেশ ভালো থাকে না। কেন্দ্র দখল হয়। ভোট ডাকাতি হয়। এখানে ১০০% ভোট হয়।
“কাজেই এখানে ব্যালটে নির্বাচনের চেয়ে ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচনী সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হবে।”